Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

১০ বছর আগে লিখেছেন

কফি খাওয়ালেন বস

আজকাল সরকারি অফিস আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার দেখে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু এর শুরুর দিকটা খুব একটা মসৃণ ছিল না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটা ঘটনা বলি। ১৯৮৭ সালে এক সরকারি আদেশে জানিয়ে দেওয়া হলো যে, এখন থেকে সকল সরকারি দপ্তরে টেলিগ্রাম, টেলেক্স ও বৈদেশিক যোগাযোগ ছাড়া দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলো। এই আদেশ অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আমার ডিপার্টমেন্টে প্রায় সব কাজই ইংরেজিতে করা হতো। মেমোরেন্ডাম, করেসপন্ডেন্স, সার্কুলার, ড্রাফট্, নোট ইত্যাদি কাজে বাংলার ব্যবহার প্রায় ছিল না বললেই চলে। তো সরকারি আদেশের এই চিঠিটি পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমার অধীনস্থ একজন কর্মচারী নথিতে নোটসহ আমার কাছে পেশ করলেন। আমি দেখলাম নোটশিটে ইংরেজিতে লেখা আছে, Submitted for next disposal. আমি খুবই বিরক্ত হলাম। নোটশিটের নিচে আমি বাংলায় লিখলাম, “সরকারি আদেশ অমান্য করে ইংরেজিতে নোট লেখায় নথি পেশকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নথিটি প্রশাসনিক শাখায় হস্তান্তরের আদেশ দেওয়া হলো।”

পরে এ নিয়ে আমার বস (অফিস প্রধান)-এর সাথে আমার তুমুল ঝগড়া হলো। বসের বক্তব্য হলো, কর্মচারী বেখেয়ালে ইংরেজিতে নোট লিখে ফেলেছে। এই সামান্য অপরাধের (?) জন্য তার শাস্তির সুপারিশ করা আমার ঠিক হয়নি। আমি বললাম, ‘কর্মচারীরা যাতে খেয়াল করে, সে জন্য একজনকে শাস্তি দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া উচিৎ। অন্ততঃ ন্যুনতম শাস্তি সেন্সর (তিরস্কার) দেওয়া প্রয়োজন।’

আমার বস বললেন, ‘Submitted for next disposal-এর বাংলা কী?’

আমি বললাম, ‘পরবর্তী বিন্যাসের জন্য পেশ করা হলো।’

‘পরবর্তী বিন্যাস বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন?’

‘সেটা পত্রভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে। এই পত্রটির ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট আদেশ সার্কুলার আকারে জারি করে আমাদের অধীনস্থ সব অফিসকে জানিয়ে দেওয়াই হবে পরবর্তী বিন্যাস।’

বস শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি পণ্ডিত মানুষ। যা বলবেন বা ব্যাখ্যা করবেন সেটাই ঠিক।’

আমি বললাম, ‘জি না স্যার। আপনি বস মানুষ। বস ইজ অলওয়েজ রাইট। আমি যতই সুপারিশ করি, আপনি শাস্তি না দিলে কর্মচারীর শাস্তি হবে না।’

বস টেবিল চাপড়ে বললেন, ‘অফ কোর্স!’

আমি আর তর্ক বিতর্ক না করে বসের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। এক সপ্তাহ পর বসের স্বাক্ষরে আমার নামে একটা শো-কজ নোটিশ এলো। তাতে লেখা হয়েছে, “দাপ্তরিক নথিপত্র বাংলায় লেখার নির্দেশ সম্বলিত সরকারি আদেশের পত্রটি অধীনস্থ অফিস সমুহকে তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করা আপনার উচিৎ ছিল। কিন্তু আপনি তাহা না করিয়া একজন কর্মচারীর অতি সামান্য ভুলের জন্য তাহার শাস্তির সুপারিশ করিয়া সংশ্লিষ্ট নথিটি প্রশাসনিক শাখায় হস্তান্তর করিয়াছেন। ফলে সরকারি আদেশ সম্পর্কে অধীনস্থ অফিসগুলি অবহিত না থাকায় তাহারা অদ্যাবধি ইংরেজিতে চিঠিপত্র লিখিয়া অত্রাফিসে প্রেরন করিতেছে। অফিসগুলি কর্তৃক সরকারি আদেশ অমান্য করার সকল দায় দায়িত্ব আপনার উপর বর্তায়। এমতাবস্থায় কেন আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না, তাহা এই পত্র প্রাপ্তির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিম্নসাক্ষরকারীকে অবহিত করার জন্য আপনাকে নির্দেশ দেওয়া হইল।”

আমি শো-কজের জবাব দিতে গিয়ে লিখলাম, “সরকারি আদেশ সম্বলিত ডেমি অফিসিয়াল (ডি,ও) পত্রটির মেমোরেন্ডাম নম্বর ও তারিখসহ পূর্নাঙ্গ আদেশ সার্কুলার জারি করিয়া অধীনস্থ সকল অফিসকে তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করা হইয়াছে। এমতাবস্থায় অফিসগুলি হইতে কেন অদ্যাবধি বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে পত্র যোগাযোগ অব্যাহত আছে, তাহা নিম্নসাক্ষরকারীর বোধগম্য নহে। এ বিষয়ে সকল দায় দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অফিসগুলিকে বহন করিতে হইবে। নিম্নসাক্ষরকারীর এ বিষয়ে কোন দায় নাই।”

শো-কজের জবাব পাওয়ার পর বস আমাকে ডেকে পাঠালেন। ‘দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার’ শীর্ষক নতুন নথি নিয়ে আমি বসের সাথে তাঁর চেম্বারে দেখা করলাম। তিনি নথি খুলে মনোযোগ দিয়ে সার্কুলারটি দেখলেন। তারপর হতাশভাবে চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডি,ও লেটারের ফাইল তো এ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ ব্রাঞ্চে। আপনি সার্কুলার ইস্যু করলেন কীভাবে?’

আমি বসকে সার্কুলারের নিচে রাখা ডি,ও লেটারের ফটো কপি দেখিয়ে বললাম, ‘ফাইল ট্রান্সফারের আগে ওটার একটা ফটো কপি করে রেখেছিলাম। এই কাজের গুরুত্ব বোঝার মতো যথেষ্ট চাকরি আমার হয়েছে স্যার।’

বস কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘তাহলে ওরা এখনো বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে লিখছে কেন?’

আমি বললাম, ‘সেটা ওদেরকে শো-কজ করে জানা যেতে পারে।’

বস আরও ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘আমি ওদের সব ক’টাকে পানিশমেন্ট দেব। কী পেয়েছে ওরা?’

আমি গম্ভীর মুখে বললাম, ‘এতগুলো শো-কজ করার দরকার হতো না স্যার। এক সপ্তাহ আগে মাত্র একজনকে শো-কজ করলেই সব ঠিক হয়ে যেত। বাসর রাতে বিড়াল মারার কথা মুরুব্বীরা বহুদিন আগে থেকে বলে আসছেন।’

আমার শেষ কথায় বসের রাগ পড়ে গেল। তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘ইউ আর এ ফানি ম্যান। হাউ মেনি ক্যাটস্ হ্যাভ ইউ কিলড্ ইন ইওর ব্রাইডাল চেম্বার?’

আমি বললাম, ‘নট এ সিঙ্গেল ওয়ান স্যার।’

‘ওহ্ মাই গড! এনি রিগ্রেট?’

‘লিটল বিট স্যার। লাইফ লং শো-কজেস আর নট এনি হ্যাপী প্র্যাকটিস।’

‘হাঃ হাঃ হাঃ।’ বস হাসতে হাসতে বললেন, ‘আচ্ছা হেনা সাহেব, আমরা ইংরেজিতে কথা বলছি কেন?’

আমি বললাম, ‘ডি,ও লেটারটা আমি ভালোভাবে পড়ে দেখেছি স্যার। সেখানে ইংরেজিতে কথা বলায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, শুধু লেখালেখি করা যাবে না।’

বস কারো ওপর খুশি হলে সাধারণতঃ তাকে কফি খাওয়ান। তিনি তাঁর পিওনকে ডেকে দু’কাপ কফি দিতে বললেন।

 

ফুটনোটঃ বাংলায় দাপ্তরিক কাজকর্ম করার জন্য কড়াকড়ি আরোপ করায় অফিসের অনেকেই আমার ও বসের ওপর নাখোশ ছিলেন। সম পদমর্যাদার একজন ফাঁকিবাজ অফিসার একদিন অফিস ক্যান্টিনে আমাকে বিদ্রুপ করে বললেন, ‘হেনা সাহেব, আপনার বসকে সব অফিসে একটা করে ইংলিশ টু বেঙ্গলী ডিকশনারি সাপ্লাই দিতে বলেন।’

এই অফিসার ভদ্রলোক তাঁর চেম্বারে বসে লোকজনের সাথে গল্পগুজব করতে খুব পছন্দ করতেন। ভেবে দেখলাম, তাঁকে একটা গল্প বলা দরকার। প্রস্তাব দিতেই তিনি খুশি মনে রাজী হয়ে গেলেন। আমি গল্প বলা শুরু করলাম।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পাওয়ার পর বিলেতে গেছেন। সেখানে একজন অভিবাসী বাঙালী যুবক তাঁর সাথে কথা বলতে চায়। বাঙালী কবির বিশ্বজয়ে যুবক আবেগাপ্লুত। কবিগুরু তার সাথে কথা বলতে রাজী হওয়ায় সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জানালো, দীর্ঘদিন বিলেতে থাকায় সে মাতৃভাষা বাংলা প্রায় ভুলেই গেছে। কবিগুরু অনুমতি দিলে সে তাঁর সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে চায়।

কবিগুরু অনুমতি দিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, যুবকটি হয়তো তাঁর সাথে সাহিত্য নিয়ে আলাপ করবে। কিন্তু দেখা গেল যুবকের কথাবার্তা প্রায় সবই সাহিত্য বিবর্জিত এবং কবিগুরুর তোষামোদ সূচক। মনে মনে বিরক্ত হলেও কবিগুরু তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং কথাবার্তা শেষ হলে বললেন, ‘তোমার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে।’ যুবক উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘দেখো, দীর্ঘদিন বিলেতে থাকার কারণে তুমি তোমার মাতৃভাষা বাংলা ভুলে গেছ এ জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে না। দুঃখ হচ্ছে এ জন্য যে তুমি ইংরেজি ভাষাটাও ঠিক মতো রপ্ত করতে পারোনি।’

রচনাঃ ১৪-০৩-২০১৪

******************************************************

Likes ২২ Comments
০ Share