যেদিকে তাকায় পানি ছাড়া আর কিছু ই নজরে আসেনা সোহেলীর। অনেকক্ষন ধরে দুরের পানির দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে। এখানে সে এসে বসেছে সকাল আটটায়।এখন বাজে বেলা বারটা।ক্ষিধেয় পেট যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তার বাবা সেই সকালে ডুব দিয়েছে পানিতে এখন উঠে আসেনি। ঘরে আজ চুলায় পাতিল চড়েনি।কোন খাওয়ার নেই।
মা মারা গিয়েছে তার গত বছর। আগে মা এটা সেটা করে খাওয়ার এনে দিত। মা মারা যাওয়ার পর প্রায় সময় সে আধপেটা খেয়ে থাকে। এক দিন খায় তো আরেকদিন কোন ও খাওয়ার থাকেনা। তার বাবা এখানের দ্বীপে মাছ ধরে। এই পানির মাছ কেও খেতে চায়না। সামুদ্রিক মাছগুলি সাধারনত কেটে রোদে শুকান হয় যা পরে বড় বাজারে চালান হয় শুটকি হিসাবে। দিনে দুইবার বড় ট্রলার এ করে একপাল জেলের সাথে তার বাবা ও মাছ ধরে। মাঝে মাঝে ট্রলার ছাড়া তার বাবা আসে মাছ ধরতে অনেক বিপদজনক জানার পরে ও। যখন খাওয়ার কিছু থাকেনা তখন বাবা আসে অন্য জেলেদের লুকিয়ে। দুই একটা ধরে আলাদা করে বিক্রি করে ওইদিনের ভাত ডালের খরচ টা ম্যানেজ করে হতভাগ্য গরীব বাবা। আজ সেরকম ই একটি দিন।
ভর থেকে জরুরি বার্তা দেওয়া হয়েছে খুব দরকার না হলে কেও যেন বিচের কাছে একা নিরস্র অবস্থায় না যায়। এক জেলে আহত হয়েছে কুমিরের কামড়ে। সাধারনত যখন তারা ট্রলার এ করে মাছ ধরতে আসে হাতে থাকে বর্ষা ,চাকতি , দা। বর্ষা হাতে আছে আজ ও তার সাথে জাল নিয়ে বিপদজনক খরস্রোতা পানিতে অনেক টা ঝাপ দিয়ে পড়ল আইনুদ্দি সোহেলীর বাবা।
বিরাট এক মাছ পাইছিরে সোহেলী বলে এক চিত্কার দিয়ে উঠলেন প্রথমে খুশিতে। একটু ক্ষণের জন্য বাবার মুখ টা দেখল। পরক্ষণে সেই যে বাবা ডুব দিল এরপরে আর দেখেনি গত চার ঘন্টা। অসহায় হয়ে একপর্যায়ে কাদতে শুরু করল সোহেলী। একজন জেলে দেখে দৌড়ে এলো ।
কি গো মা তুমি কার মেয়ে কাদ কেন গো ? আর ও দুই একজন জেলে এসে জিজ্ঞাসা করলো ব্যাপার কি ? সব শুনে তারা মুখ চাওয়া চাওয়ী শুরু করল।
একজন জিজ্ঞাসা করলো তোমার বাপের নাম কি ? জানেনা এখানে যে এইভাবে মাছ ধরা বিপদজনক। এখানে আছে রাক্ষুসে মাছ ,হাঙ্গর ,কুমির।
পাশের আরেকজন ইশারায় থামিয়ে দেয়। এবার সে চিত্কার করে কাদতে থাকে। একজনের মন সহানুভূতিতে আদ্র হয়ে।
আহাগো কিছু খাইছ নি ? না ফোফাতে ফোফাতে সে বলে। চারজন জেলে চারিদিকে দিয়ে খুজলো অনেকক্ষণ। কোথাও কোন মানুষের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেলনা। তারা একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেল এই হতভাগ্য জেলেটি বেচে নেই যদিও তারা মেয়েটির কাছে গোপন রাখল তা।
এক জেলে সাথে করে নিয়ে আসলেন সোহেলীকে। তার স্ত্রী সন্তানহীনা। মেয়েটি কে পেয়ে খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
মুড়ি গুড় এনে খেতে দিল ওর সামনে। যখন শুনলো সকাল থেকে না খাওয়া। আমার বাবা আমার বাবা বলে তখন ও সে কেদে ই যাচ্ছে।
স্ত্রী লোকটির খুব মায়া লাগল মেয়েটির জন্য। সোহেলীকে কোলে নিয়ে চোখ মুছিয়ে খাইয়ে দিতে লাগল। ক্ষিধের তাড়নায় মেয়েটি খেতে শুরু করল। একপর্যায়ে কোলে ঘুমিয়ে পড়ল।
বিকাল এর দিকে বিচের কাছে খুব শোরগোল শোনা গেল। সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখে একলোক সজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছে।
বাবাগো বলে সোহেলী মরা চিত্কার দিয়ে উঠল। সবাই দেখে আহা বলে সহানুভূতি প্রকাশ করলো। আর বেশি কিছু বলার মত কার ও মনের অবস্থা রইলনা।
হতভাগ্য লোকটির এক পা শরীর থেকে কেটে বিছিন্ন হয়ে আছে। হাঙ্গর ধরনের মাংশাসী কোন প্রাণীর কামড়ে তার শরীরের জায়গায় জায়গায় অনেক গভীর ক্ষত গর্ত দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন দৌড়ে এসে দেখল এখন ও চেতনা আছে লোকটির। গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সবাই যতটুকু সম্ভব পাতার রস এনে লাগিয়ে দিল ক্ষততে , কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ এর মত করে বেধে দিল। আস্তে আস্তে বাবা আবার চেতনার অতলে তলিয়ে গেল।
দিন যায় মাস আসে ,ঘুরে বছর সোহেলীর এখন আর জেলে র কাজ করেনা। স্ত্রলার এ করে মাছ ধরার কাজ সে হারিয়েছে। ক্রাত্চ এ ভর করে তাকে চলতে হয়। পা হারিয়ে পঙ্গু অবস্থায় পর্যটন অফিসের কোনায় বসে গান গায় করুন স্বরে। কখন ও ভিক্ষা করে। কোন টুরিস্ট কখন ও দয়া পরাবশত কখন দিয়ে যায় একটাকা দুইটাকা। এইভাবে চলে তাদের কষ্টের জীবন। সোহেলী স্কুল এ যাওয়ার বদলে ছোটখাট কাজ করে যারা বিচ এ আসে তাদের ছোটখাট ফরমায়েশ খাটা, পানি এনে দেওয়া এইধরনের কাজ। বাবা এখন পুরাই ভিখারী হয়ে গিয়েছে ,একসময়ে সে ও যে কত ট্রলার এ বাবার সাথে ঝাপাঝাপি করে মাছ ধরা দেখত তা আর মনে ই পড়েনা ।