Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শামিম রহমান আবির

৯ বছর আগে লিখেছেন

চাঁদের আলোয় ছয় জন যুবক

 

 

 

 

 

মিরপুরের সাগুফতায় আমরা ছয় যুবক রাত নামার অপেক্ষায়। 
আমি, মেহেদী, হৃদয়, নবী, ফাতিন ও রেজা। রাত বাড়ছে; জহির রায়হানের হাজার বছরের সেই পুরনো রাত নয়। এ রাত আমাদের রাত। এ রাত পূর্ণিমার রাত। আমরা পূর্ণাঙ্গ চাঁদ দেখব বলে অধীর হয়ে আছি। সুপার মুন নামটা কেমন যেন। আমার কাছে বড্ড বেমানান। তাই আমি এ চাঁদের নাম দিয়েছি পূর্ণাঙ্গ চাঁদ। বছরে এই দিনটি একবারই আসে, চাঁদ তার পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে হাজির হয়। এ সময় বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। তাই আজ পূর্ণাঙ্গ চাঁদ দেখতে আকাশে চোখ রেখেছি আমরা। 

তবে আকাশ মেঘলা। খণ্ড খণ্ড মেঘমালা চাঁদের সাথে যেন দ্বন্দ্বে নেমেছে ।
বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। বৈদ্যুতিক বাতির বানানো শহরে চাঁদের রাত উপভোগের তেমন সুযোগ থাকে না। যে অন্ধকার কাটিয়ে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, কার্যত শহরে সে অন্ধকারই নেই। চাঁদ তাই গ্রামে যে অপরূপ রূপ নিয়ে হাজির হয়, শহরে তা তেমন দৃশ্যত নয়। গ্রামে জ্যোৎস্নার সঙ্গে যুক্ত হয় জোনাকির উৎসব, ঝিঁ ঝিঁর ডাক। মাঠে অথবা পথে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য যেন অন্য এক আবহ সৃষ্টি করে। তাই সোডিয়ামের আলোকে পাশ কাটিয়ে জোছনা গায়ে মাখব বলে শহরের অদূরে এই মুমূর্ষু গ্রাম্য পরিবেশে এসেছি আমরা। 

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। শহুরে সোডিয়াম বাতিগুলো যেন চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের ঘোলাটে হলুদ আলোকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জলতর করে চলেছে। মেহেদী নিকোটিনের রসদ জোগাতে দোকানে এসেছে। আমাকে জোর করে তার পিছু পিছু পাঠান হয়েছে, যেন আমি সাথে গলা ভেজাবার জন্য এক বোতল ফুস পানি কিনে আনি। দোকানে দাড়াতেই এক রুগ্ন কুকুর চোখে পড়ল। কি মনে করে যেন তাকে কাছে আসার ইশারা করলাম। ইশারা করতেই সে ছুটে কাছে চলে এলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মেহেদী ভয় পেয়ে ছিটকে সরে গেল। কিন্তু কুকুরটির আর কোন ক্ষিপ্র গতিবিধি না থাকায় মেহেদীর ভয় নিমিষেই কেটে গেল। আমরা দু জন মিলে তাকে দুইটা সল্টেস্ট বিস্কিট খাওয়ালাম। যখন ফিরছি দেখলাম কুকুরটিও আমাদের অনুসরণ করছে। আড্ডা স্থলে ফিরে সবার সাথে কুকুরটাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। দুটো বিস্কিট খেয়ে বেচারা অস্থির হয়ে তার কৃতজ্ঞতার জানান দিচ্ছে। সে তার প্রভুভক্ততা প্রকাশ করতে আমার পায়ে মুখ ঘষতে শুরু করল। তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে চোখ বন্ধ করে পরম আনন্দে আদরটুকু উপভোগ করল। তাকে বসতে বললে কি বুঝল কে জানে; একটু দূরে গিয়ে হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের মত থাবা গেড়ে বসে রইল। 

বিরূপ পরিবেশ চাঁদ দেখার উত্তেজনায় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। চাঁদের তৃষ্ণায় তৃষিত যুবকেরা একে একে চাঁদের তৃষ্ণাকে দমিত করতে নিকোটিনের তৃষ্ণায় মত্ত হল। সবার হাতেই আগুন; আমি ছাড়া। অধূমপায়ী হওয়ায় নিজেকে বড্ড দলছুট মনে হতে লাগল। তাই প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিলাম। আগুন বিহীন সিগারেট হাতে নিয়ে বসে রইলাম। আলোচনা জমে উঠতে শুরু করল। গল্প-কবিতা, চলচ্চিত্র, ব্লগ, ফেসবুক, গাজা-ফিলিস্তিন, রুদ্র মুহাম্মাদ-তসলিমা নাসরিন, ভ্যান গগ; বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তু নিয়ে জমপেশ আড্ডা চলতে লাগল।

হঠাৎ কে যেন গুনগুনিয়ে উঠল, ভালো আছি, ভালো থেকো... 
সঙ্গে সঙ্গে সবাই তার সাথে বেসুর গলায় গলা মিলিয়ে গাইতে শুরু করলাম- 
ভালো আছি,
ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালা খানি ।।
বাউলের এই মনটারে
ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে ... 

এর পর একের পর এক গান গেয়ে ক্লান্ত হয়ে আকাশের পানে তাকাতেই দেখতে পেলাম, মেঘ অনেকটাই কেটেছে। মেঘের গায়ে বাতাসের তোড় দেখে বোঝা যাচ্ছে আকাশ পরিষ্কার হতে বেশী দেরী নেই। সিদ্ধান্ত হল আমরা আরও ভেতরে যাব। যেখানে শহুরে সোডিয়াম আলোর কোন বালাই নেই। ওদিকে কুকুরটা আমাদের আলোচনায় ইন্টারেস্টিং কিছু না পেয়ে দিব্বি ঘুমিয়ে গেছে। আরাম করে ঘুমোচ্ছে দেখে আমরা তাকে আর বিরক্ত করলাম না। তাকে রেখেই আমরা অধিকতর অন্ধকারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম পবিত্র আলোর পূজারি হবার প্রত্যাশায়। 

হাঁটতে হাঁটতে আমরা এসে এক বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে এসে পৌঁছুলাম। এখানে শহুরে আলোর আগ্রাসন নেই বললেই চলে। হঠাৎ মেঘ কেটে আমাদের সামনে নিজেকে নির্লজ্জ ভাবে মেলে ধরল ভরাট চাঁদটি। রচিত হতে লাগল জোছনা মাখা এক আলোকিত রাতের কাব্য কথন। হিমেল হাওয়া আর জোছনা প্রাণের মাঝে সঞ্চারিত করতে লাগল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। অথচ মনের মধ্যে উত্তাল হাওয়া। মুগ্ধ নয়নে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমরা কজন। অন্য রকম এক অলৌকিক অনুভূতি। এক অন্য রকম সুখ। সকল ক্লান্তি ভুলে ইস্পাত হৃদয়ে এক দারুণ প্রশান্তি পরশ যেন প্রাপ্তির আনন্দকে আলোকিত করে অপ্রাপ্তি গুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে। বাতাসের ঝিরিঝিরি শব্দও যেন জোছনা হত; ঠিক আমাদের মত। আলো-আঁধারি অদ্ভুত পরিবেশে গায়ে মেখে নতুন করে স্বপ্ন হারা চোখে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হল এক আলোকিত স্বপ্নিল পৃথিবী! 

এরই মাঝে বন্ধু হৃদয় ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি করতে শুরু করল তার প্রিয় জীবনানন্দ দাশের কবিতা-

আকাশে জ্যোৎস্না- বনের পথে চিতা বাঘের গায়ের ঘ্রাণ;
হৃদয় আমার হরিণ যেনঃ
রাত্রি এই নীরবতার ভিতর কোন দিকে চলেছি!
রূপালি পাতার ছায়া আমার শরীরে,
কোথাও কোনো হরিণ নেই আর ...

আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতার বই মাথার নিচে দিয়ে সবুজ ঘাসের উপর গা এলিয়ে দিলাম।
গায়ে পূর্ণিমার রহস্যময়ী চাঁদের চাদর টেনে নিয়ে নির্লজ্জ চাঁদটার পানে চেয়ে রইলাম । 
যে চাঁদটার কোন কৃত্রিম চমক নেই, চটুলতা নেই। আছে করুণ মধুর একটা শান্ত ধ্যানের আবেগ। যে আলোয় আছে জীবনের সব ব্যথা, বেদনা উল্লাস ও উচ্ছ্বাসের সংযত সমাবেশ। আছে কল্যাণময় বৈরাগ্য ও শান্তির এক সমাহিত শান্ত রূপ। হঠাৎ মনে হল চাঁদটা যেন অনেক নিচে নেমে এলো। যেন চাইলেই আমি ছুঁয়ে দিতে পারি। চাঁদটাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে মেঘেরা। কখনও বা চাঁদটাকে একটু একটু ছুঁয়ে মেঘেরা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরিয়ে যাচ্ছে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে; চোখের জলে না বৃষ্টির জলে তা বুঝতে পারছি না। সহস্র বছর আগে তার খোঁপায় গোজা গোলাপের ঘ্রাণ পাচ্ছি। অনুভবের মাঝে তার অস্তিত্বের পুনরুত্থান টের পাচ্ছি। বুকের ভিতরটা ছলকে উঠছে। মনের না পাওয়া সকল বেদনা যেন আকুলি বিকুলি করছে।

একি! আমার মুখ নীল শাড়ীর আচলে ঢেকে দিল কে? 
আমি চাঁদ দেখতে চাই। জীবনানন্দ দাশের কবিতা শুনতে চাই। আমি তোমাকে ভুলতে চাই! আমি... 

দূরে কোথাও গির্জার ঘণ্টা ধ্বনি কানে আসছে। গীটারে কে যেন প্রাণ-ছোঁয়া কোন এক গানের সুর তুলতে চেষ্টা করছে। যে গান, যে সুর, যে অনুভূতি অস্তিত্বকে অমরত্বের স্বাদ দেয়। যা এক অলৌকিক প্রাপ্তি।

♫♪যখন নিঝুম রাতে
সব কিছু চুপ,
নিষ্প্রাণ নগরীতে
ঝিঝিরাও ঘুম!
আমি চাঁদের আলো হয়ে,
তোমার কালো ঘরে;
জেগে রই সারা নিশি
এতটা ভালবাসি….
এ কি অপরূপ সুন্দর
তার স্বপ্নের বর্ষা রাতে;
আমি ভিজে ভিজে মরি
মিছে মগ্ন প্রভাতে…
দেখি ভীষণ অন্ধকার মাঝে
আলো ছায়ায় তার নূপুর বাজে!
আমি যে ভেবে ভেবে শিহরিত…
আমি সূর্যের আলো হয়ে
তোমার চলার পথে
ছায়া হয়ে তোমায় দেখি
এতটা ভালবাসি।
হুম….. এতটা ভালবাসি….♫♪

(https://www.youtube.com/watch?v=CliDIZOnPgM)

Likes Comments
০ Share