এই জগতে সূর্যের কোন অস্তিত্ব নেই আছে শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার আর সুনসান নীরবতা । শতাব্দীর পর শতাব্দী অবহেলায় অনাদরে পরে থাকা ষ্টেশনটার যাত্রী ছাওনির নিচে একটা টুল রাখা আছে । টুলটার দুই দ্বারে দুইটা সোডিয়াম লাইট জ্বলছে । কিছুক্ষণ আগেই আকাশ ঝেঁকে বৃষ্টি নেমেছিল । হিম শীতল বাতাসে কেমন জানি একটা মিষ্টি গন্ধ মিশে আছে ! হেলেন টুলটাতে একা বসে আছে । অজানার উদ্দেশ্যে হারিয়ে যাবার অপেক্ষা , এটা যে কতটা ভয়ানক তা এই মূহুত্যে ওর থেকে ভাল কেইবা বলতে পারবে । কতই বা বয়স ওর , বড়জোর উনিশ বা বিশ ! সব কিছুই কেমন জানি তাড়াতাড়ি ঘটে গেল ! হেলেনের প্রচণ্ড ভয়ে কান্না পাচ্ছে । “ঘটনাটা কিভাবে ঘটল?” পিছন থেকে কেউ একজন প্রশ্ন করল । হেলেন চমকে পিছনে তাকাল, তার চোখে মুখে রাজ্যের ভয়। শরীর দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল ।
“কে ?”
“আমি এলেক্স , আপনার মতই একজন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি । বললেন না ঘটনাটা কিভাবে ঘটল! এখানে সাধারণত কম বয়সীরা তেমন আসে না! ” বলল লোকটি ।
“গাড়ি এক্সিডেন্ট । তারপর আর কিছু মনে নেই । আপনি এলেন কিভাবে ?”
“বাদ দেনতো । ভাল লাগছে না বলতে ! তারপর বিয়ে থা করেছেন? ”
লোকটির প্রশ্ন শুনে হেলেনে যেন ধাক্কা খেল ! এই রকম পরিস্থিতিতে কেউ কি বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে পারে ! লোকটার কমন সেন্স বলতে কিছুই নেই ! রাগে চুপ করে রইল হেলেন ।
“আমার প্রশ্ন শুনে কি মাইন্ড করলেন ! আসলে ভয় বা চিন্তা করেই বা কি হবে বলেন ! কপালে যা আছে তাই হবে , ট্রেন আসলে চলে যাব , যা হবার পরে দেখা যাবে ! কি বলেন?”
“আপনি মনে হয় খুব ফুর্তিতে আছেন ! কোন কথা বলবেন না আমার সাথে । ” কিছুটা রেগে বলল হেলেন ।
“আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন ? টেইক এই ইসিলি! আমরা কিই বা করতে পারি এখানে ! আমাদের কোন কিছুতেই হাত নেই । ”
হেলেন এবার চোখ গরম করে তাকাল এলেক্সের দিকে । এলেক্স কিছু বলতে গিয়েও ভয়ে কিছু বলল না !
***
এলেক্স একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করত । জীবনে কি সুন্দর একটা স্বপনই না ছিল তার । সব কিছুই কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গেল । বাবা নেই, মার চেহারাটা আর দেখা হবে না তার, ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন জানি ধক করে উঠল । মার সাথে বিয়ের কনে দেখতে যাবার কথা ছিল আজ । তাই অফিস শেষে তাড়াতাড়ি বের হয়েছিল । বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যায় সর্বনাশা কারটা রাস্তা মনে করে ওর ওপর দিয়ে উঠিয়ে দিল । তারপর সব শেষ । আচ্ছা ওর মা এখন কি করছে ? নিশ্চয়ই এতক্ষণ ব্যাপারটা তার কানে পৌঁছে গেছে । এলেক্স একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল ।
“ আচ্ছা আমাদের এখন কি হবে ? ” বলল হেলেন ।
“জানি না ! ভয় লাগছে ?”
“হুম ! জানেন আমি বাবা-মার একমাত্র মেয়ে । যখন যা চাইতাম তাই তারা দিতেন । আমার জন্য তারা অনেক করেছেন । তাদের জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে , কেমন জানি ভয় লাগছে আমার । এই জগতটা এত নীরব কেন? আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে ! ” বলেই হেলেন কেধে উঠল ।
মেয়েটার জন্য এলেক্সের কেন জানি গভীর মায়া অনুভূত হল । পরম মমতায় মেয়েটার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে চেয়েও কি মনে করে যেন দিল না । এভাবেই কথা বলতে বলতে ওরা দুজন –দুজনের অনেক কথা শেয়ার করল । ট্রেনের অপেক্ষায় চলে গেল অনেক রাত । আস্তে আস্তে ওদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকল । হঠাত দূর থেকে ট্রেনের শব্দ শুনতে পেল ওরা , নিশ্চয়ই ওদের নিতে আসছে ট্রেনটা, আচ্ছা ট্রেনটা ওদের নিয়ে কোথায় যাবে ? ওদের কি পালানো উচিৎ । না এখান থেকে পালানোর কোন উপায় নেই ! তাদের যে যেতেই হবে ! নিয়তি কাউকেই পরোয়া করে না । সে তার আপন গতিতে বয়ে চলে গন্তব্যের দিকে ।
টুনটুন শব্দ হল, এলেক্স পকেটে হাত দিয়ে একটা মুঠোফোন আবিষ্কার করল । আশ্চর্য তার পকেটে মুঠোফোন আসল কিভাবে ? একটা মেসেজ পরেই উত্তেজনায় ঘামছে এলেক্স!
“কি হয়েছে ?” বলল হেলেন ।
“এবরিথিং ইজ ফেয়ার হিয়ার ”
“মানে ? ”
“মেসেজটা পড়ে দেখ ! তুমি যদি মনে কর তোমার এই জগতে আসাটা ভুল বসত হয়েছে বা এখনই আসাটা ফেয়ার হয়নি তাহলে আপিল করতে পার । ”
“একটু বুঝিয়ে বলবে? ” কৌতূহলী হয়ে বলল হেলেন ।
“প্যারালাল জগত বলে একটা কথা আছে । তোমার আমার মত অবিকল মানুষ প্যারালাল জগতে বাস করে । এমনও হতে পারে ভুলবশত আমাদের এখানে আনা হয়েছে । হয়তবা অন্য জগতের হেলেনকে আর এলেক্সকে আনতে গিয়ে তোমাকে আর আমাকে এখানে আনা হয়েছে !”
হেলেনের চোখ দুটি খুশীতে চক চক করে উঠল । যেন অথই সাগরে এক টুকরো কাঠ পেল আকরে ধরার জন্য ।
“ভুলবশত আমাদের নিয়ে আসা হলে ফিরত দিয়ে দিবে সেই ক্ষেত্রে আমরা এখানকার সমস্ত ঘটনাই ভুলে যাব।”
হেলেনের কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে গেল ! আচ্ছা সে যদি আগের জগতে ফিরে যায় তাহলে কি এলেক্সেও ভুলে যাবে ! এই প্রথম একটা মানুষকে তার ভাল লেগেছে অথচ নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিণতি , জীবনে ফিরে গেলে তাকে দেখলেও আর মনে করতে পারবে না। এলেস্কের মত প্রাণবন্ত মানুষ জীবনে দ্বিতীয়টি দেখে নি হেলেন ! আচ্ছা হেলেনের মত এলেক্সও কি হেলেনকে একই ভাবে ফিল করছে ! কে জানে !!
***
কফি-সপে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ধাক্কা খেল দুজন ছেলে-মেয়ে । ছেলেটি উঠে মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় কেন জানি যেতে পারল না ! মেয়েটিকে কেমন জানি চেনা চেনা মনে হল তার ! মনে হচ্ছে জর্ম জম্মান্তরের পরিচিত তারা ! “হাই, আমি এলেক্স । আপনাকে কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে , মনে হচ্ছে আমরা আগে থেকেই পরিচিত !” বলল ছেলেটি ।
“আমি হেলেন !” বিস্ময়ে চেয়ে আছে হেলেন। ওর কাছে ছেলেটিকে কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে । বুকের ভিতরটা কেমন জানি টিক টিক করছে !
কবি সাহিত্যিকেরা প্রায় তাদের লেখায় লেখেন এমন মেয়ে বা ছেলেকেই বিয়ে কর যাকে দেখলেই মনে হয় অনেক দিনের চেনা ! মনে এর জন্যই হয়ত এতদিন অপেক্ষা করছিলে ! আমাদের জীবনে কোন না কোন পর্যায়ে এমন কেউ না কেউ আসে যাকে দেখলে মনে হয় জর্ম জম্মান্তরের পরিচিত আমরা । কে জানে এর মাঝেও হয়ত লুকিয়ে আছে এমনই কোন আত্মিক বন্ধন বা অজানা কোন কাহিনী।
বিঃদ্র – ষ্টেশনে সেই রাতে হেলেন এবং এলেক্স দুজনই আপিল করেছিল ! মানুষই এক মাত্র প্রাণী যে কিনা সমস্ত আশা শেষ হবার পরও আশা করতে পারে । তারা সৌভাগ্যক্রমে বা দূভাগ্যক্রমে যেভাবেই হোক, সেই যাত্রায় ট্রেনে উঠার হাত থেকে বেচে গিয়েছিল ! (সমাপ্ত)
Comments (0)
দাদা
আজ কাল যি কবিতা লেখছেন
অসাধারণ --অভিনন্দন
ধন্যবাদ
বাহ দারুন কবি,,,,,,চৈত্র শুভেচ্ছা,,,,,,
ধন্যবাদ কবি