Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Azizul Islam

৯ বছর আগে লিখেছেন

ধাবমান যে প্রজন্ম (প্রতিযোগিতা)



ভোরের আলো তখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কিছুক্ষন আগে আযান হয়েছে মাত্র। মসজিদে মসজিদে এবং কিছু বাড়িতে পবিত্র ফজর ওয়াক্তের নামাজের প্রন্তুতি চলছে। একটি/দুটি মসজিদ থেকে কেরাতের সুমধুর সুর ভেসে আসে। পরিবেশ অতি শান্ত এবং শীতল। কোমনীয় এই পরিবেশে হঠাৎ করে গগনবিদারী চিৎকার ভেসে আসে একটি বাড়ী থেকে। বাড়ীর একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ট্রাকচালক মো: হারুন মিঞা চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মারা গেছেন হরতালের পক্ষের কিছু দুবৃত্তের ছোঁড়া ইটের আঘাতে। মোবাইলের মাধ্যমে খবরটি এসে পৌঁঁছতেই শুরু হয়ে যায় কান্নাসহ বিরাট হুলস্থুল । খবরটা শুনে হারুন মিঞার আপনজন এই বাসার তিনটি প্রানের একটি কখাই শুধু মনে হয়েছিল, জলজ্যান্ত মানুষ হারুন মিঞা আর কোনদিন এবাসায় আসবেনা, আসবে তাঁর লাশ? ভাবতেই চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠেন সবাই একযোগে। হারুন মিঞার স্ত্রী মূর্ছা খেয়ে পড়ে আছেন, আশপাশের দুয়েকজন জন মহিলা এসেছেন, তাঁরা ধরে আছেন তাকে। মুখে-চোখে পানির ঝাপ্টা দিচ্ছেন। একবার তিনি চোখ খুললেও বিলাপ করে কি কি বলে আবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন।

হারুন মিঞার বাড়ি চট্টগ্রামেরই আরেক উপজেলা সিতাকুন্ডে। ঢাকা থেকে কক্্রবাজার ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করার কিছুটা আগে কিছু দুর্বত্ত চলমান উক্ত ট্রাকে ইটের একটি বড় দলা ছুঁড়ে মারে এবং দলাটি সরাসরি হারুন মিঞার মাথায় আঘাত করে। বেশিক্ষন বাঁচেননি তিনি। সিতাকুন্ডে বাসায় থাকে তাঁর স্ত্রী, এক কন্যা মিতা এবং এক ছেলে, নাম তরু। তরুই সবার ছোট এবং সবার বড় মেয়ে অনু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। পরিবারে মিতা মেয়েটাই সবচেয়ে ঠান্ডা এবং শান্ত । বয়স আঠারো পেরিয়েছে, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলো কেবল । কখাও বলে মেপে মেপে এবং কম। তবে প্রয়োজনীয় কখাই বলে সে। আজ এই মেয়ের কণ্ঠ থেকেই বিলাপ শোনা যাচ্ছে বেশী। আর বছর সাতেকের তরু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকছে একবার মা, একবার বোনের মুখের দিকে। অতি করুন তার চোখদুটি।

আস্তে আস্তে পাড়া-পড়শীর উপস্থিতিতে ভরে উঠছে বাড়ী। তাদের প্রিয়তম মানুুষ হারুন মিঞা আর এবাসায় আসবেনা, ছুটির দিনগুলিতে পাড়াময় তার ঘুরে বেড়ানোও আর কেউ দেখবেনা কখনও। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে পুরো এই গ্রাম। একসময় লাশ আসে মানুষটির এবং যথারীতি সকল মানুষের আন্তরিক সহায়তায় দাফন সম্পন্ন হয়।

দাফনের আগে অনুও এসে উপস্থিত হয়। বাবার মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছিলনা তাকে। এসে বাবার লাশ দেখে তার অবস্থা যা হয়েছিল, তা আর বলতে চাচ্ছিনা প্রিয় পাঠক। ওদের বয়সে আমি পিতৃহীন হইনি, আমার পক্ষে এ-বর্ননা দেয়া সম্ভব হবেনা। সে উদ্দেশ্যে এ-গল্পের অবতারনাও নয়। আুিম হরতালের সাথে ডিফার না করলেও হরতালে সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও, এ-ধারণাকে প্রচন্ডভাবে ডিফার করি। আর হিংসাত্মক কর্মকান্ড করলে জনসমর্থন কমে আসে বলেও আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি। ব্যাপক গনমানুষের সম্পৃক্ততা না হলে কোন আন্দোলন সফল হয়না, হওয়া সম্ভবও নয়।

অনু, মিতারা খুবই ভালো ছাত্রী। ছাত্র পড়িয়ে অনুর আয় করার অভিজ্ঞতা অনেক বছরের। মেধায় স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে সে নিজের খরচ নিজে চালাতে সক্ষম হয় শুধুমাত্র টিউশনির কারনে। অনেক আত্মবিশ্বাসী মেয়ে অনু। রাজনীতিও করে ও, ছাত্র ইউনিয়ন। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে পারে। কলেজে তার বক্তৃতার সময় হলে অনুভুতিসম্পন্ন কিছু শিক্ষক এসে তা শুনতেন। বলতেন, তোমার কখা শুনতেই আসি শুধু, বিষয়ব¯তু যা-ই হোক না কেন। কাউকে কেয়ার করে কখা বলেনা ও, তবে গ্রামের সবাইকে ভক্তি করে খুব। সবাই তার উপর অতিমাত্রায় সন্তুষ্ট। বয়োজ্যেষ্টরা বলেই রেখেছেন তাকে, মা, রাজনীতি করলে এই গ্রামেই করিও, আমরা তোমাকে ছাড়তে চাইনা। কিছুই বলেনি অনু, শুধু চেয়ে থেকেছে মুখগুলি, ধৈর্য্য-কষ্ট-দু:খের এক একটি অভিব্যক্তিগুলি। ইনাদেরও তার অতি ভালো লাগে, অতি আপনজন মনে হয়। এঁদের সামনেইতো তার বেড়ে ওঠা। অভিভূত হয়ে পড়ে সে।

দুটি মাস পার হয়ে গেল ওদের বাবার মৃত্যুর পর । জগতের এটাই নিয়ম, কারো জন্য কিছু আটকে থাকেনা । হারুন মিয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েেেছ, যদিও এই পরিবারটিতে একের সাথে অন্যের সম্পর্কটা ছিলো অত্যন্ত সহমর্মীতার । যা হোক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো মিতা, সেটাও হয়েছে সহজেই । আসলে ছাত্রী হিসাবে মিতাই ভালো অনূর চেয়ে । বাবার মৃত্যু-পরবর্তী এই সময়টায়, বইয়ের পোকা মিতার বইয়ের সাথে একেবারেই সম্পর্ক ছিলোনা । বাবার মৃত্যু এতোটাই মূষড়ে দিয়েছিল তাকে যে, ভর্তির কোন প্রস্তুতি-ই নেয়নি সে । পরিবারের অন্যরা ভাবতো ওর পড়াশোনায় হয়তো ছেদ-ই না পড়ে যায় । কিন্তু আত্মবিশ্বাসী বোন অনূর কারনে ছেদ পড়েনি, পড়তে দেয়নি অনূ ।

এই গ্রামেরই আরেক ছেলে, নাম ঝন্টু, প্রথম আলো পত্রিকা যাদের বলে ‘অদম্য মেধাবী’, সেই ঝন্টুও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। গ্রামে ভ্যান চালাতো ঝন্টু। সংসার বড় হওয়ায় বাবাকে ক্ষেতের কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি ভ্যান চালিয়ে সংসারে আর্থিক সাহায্য করতো ও নিজের পড়াশুনার খরচ চালাতো ঝন্টু। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজাল্টের পর তার অত্যধিক ভালো রেজাল্ট তাকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে দৈনিক প্রথম আলো প্রত্যক্ষ সহায়তা। অনূ, ঝন্টু এবং মিতা প্রায় একই বয়সী। একসাথেই এই গ্রামে বড় হয়েছে ওরা। দু-চার বছরের হেরফের তাদের, বয়সে এবং লেখাপড়ায়ও। এরকমটা নয় যে তারা একসাথে চলাফেরা করতো, তবে তাদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ন একটা ভদ্র সম্পর্ক সবার সামনে পরিলক্ষিত হতো সবসময়। একের সাথে অন্যের দেখা হলে  সেভাবেই তারা কথা-বার্তা বলতো, একের প্রয়োজনে অথবা দুই পরিবারের মধ্যে কোন পরিবারের প্রয়োজনে তাদের মধ্যকার সহযোগিতার ভাব, সহমর্মিতার ভাব  পরিবার দুটিকে বেশ কাছাকাছি এনে ফেলেছে।

ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে অনূ এবং ঝন্টুর মধ্যে কথা বিনিময় স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে। দুজনকেই টিউশনি এবং নিজেদের পড়াশুনাতে ব্যস্ত  থাকতে হয়, কারো সময়ই হয়না একখানে বসে কখা বলার। জরুরী কিছু থাকলে মোবাইলেই সেরে নেয় কথাটা ওরা। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অনূ সিপিবির অফিসে গেলে ঝন্টুকে ডাকে। আসলে অনূ চায় ঝন্টু ওর মতো সিপিবির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হোক। কারন গত দুই দশকের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি ধরে সে মনে করে, দেশের মঙ্গল এবং রাজনীতির গুনগতমান অর্জন করতে চাইলে দেশের বামপন্থী শক্তির উন্মেষ ঘটাতে হবে। কারণ হিসেবে সে বাম চিন্তা-ভাবনার মানুষের মধ্যে অপেক্ষাকৃত উন্নত এবং স্বচ্ছ চিন্তা-ভাবনা কাজ করে বলে মনে করে। এই দলের মানুষগুলিকে তার ত্যাগী, কমপক্ষে ত্যাগ করার মানসিকতাসম্পন্ন বলে মনে হয়। এসমস্ত কারনে বামপন্থী রাজনীতির শক্তি বৃদ্ধি করতে চায় অনূ এবং স্বপ্ন দেখে একদিন এই বামপন্থীরাই দেশকে সকল দিক থেকে সমৃদ্ধ করে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারবে।

ঝন্টুও চায় দেশের মঙ্গল এবং গভীরভাবেই চায়। মানুষে মানুষে, বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের মধ্যে চলমান যে হানাহানি  নিরন্তর এদেশে, তার সমাধান রাজনীতির মাধ্যমেই সম্ভব বলে সে মনে করে, তবে তা চলমান রাজনীতি দিয়ে সম্ভব নয় বলেও সে শুধু মনেই করেনা, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করে। গ্রামে ভ্যান চালাতে চালাতে অনেক মানুষের কথাবার্তা শুনেছে সে, ভ্যানে চড়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষের বিভিন্নরকমের কথাবার্তা শুনেছে সে। রাজনীতির আলোচনাগুলি ইচ্ছা করেই শুনতো ও, শুনতে ভালোই লাগতো। দুহাজার চার থেকে নয়, এই পাঁচ/ছয়  বছরে তিনটি সরকারের বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ড, কর্মকান্ডের বিশ্লেষন শুনেছে ও এভাবেই, গনমানুষের কাছ থেকে। আলোচনাগুলির কোথাও সে ওদের মতো দরিদ্র মানুষের সুখবর আছে, এমন কোন কথা বড় মানুষদের কেউ কোনও ফোরামে আলোচনা করেছেন বলে শুনেনি। শুনতে পেযেছে শুধু ওদের নিজস্ব দ্বন্দগুলি, যেমন কে কাকে ল্যাং মেরে ফেললো, কে কোন কৌশল অবলম্বন করে কাকে ঘায়েল  করে এগিয়ে গেলো ইত্যাদি ইত্যাদি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর রাজনীতির পাঠ নিতে গ্রামের চায়ের দোকানে রাত জেগে অনেকদিন টক্ শো শুনেছে ও। কিন্তু না! যা শুনতে চেয়েছে, দুয়েকজনের কথাবার্তা ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে তা শুনতে পায়নি। কঠিন একজন মেধাবী ছাত্র আসলে ঝন্টু, কষ্টকর শ্রম করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক, উভয় পরীক্ষাতেই ও গোল্ডেন এ-প্লাস অর্জন করেছে। যূক্তি ছাড়া কোন কথা মানতে রাজী নয় সে। রাজনীতি খুব একটা যে বুঝে, তা-ও নয়, তবুও তার মনে হয়, চলমান এই রাজনীতিতে দেশের আপামর মানুষের জন্য কিছুই নাই। মানুষ, বিশেষত: দরিদ্র যারা, আপামর সেই সমস্ত মানুষের জন্য এই রাজনীতি কিছুই দিতে পারবেনা, দিবেওনা। দেয়ার ও নেয়ার যা কিছু, তা শুধু হবে নিজেদের মধ্যে। সহানুভূতি জিনিসটা আস্তে আস্তে মানুষের মধ্য থেকে উঠেই যাচ্ছে, বিশেষ করে ক্ষমতাশালীদের মধ্য থেকে। অনূও জানে এসমস্তই। অনূর কলেজে এবং ঢাকাতেও তাদের মধ্যে এবিষয়গুলি আলাপ হয়েছে। অনূ তবুও ভাবে, ঝন্টুকে পেলে বামপন্থার রাজনীতির ভালো হবে এবং সেইজন্য তাকে আহ্বান করে সে।

ওদের মতো মিতা রাজনীতি নিয়ে ভাবেনা। অনূ তাকে রাজনীতির বিভিন্ন কথা বলতো, বলতো রাজনীতি করিসনা, বিষয়টা কি শুনে-বুঝে দেখ, দেশ-সমাজ সম্পর্কে জানা, বোঝা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। চলমান রাজনীতির সাথে বামপন্থী রাজনীতি তথা সিপিবির রাজনীতির পার্থক্যটা বেশ ভালোভাবে বুঝিয়ে দিত অনূ তাকে। তবুও তাকে টানতে না পেরে শেষে বলতো, তোর মত ভীতুর ডিম দিয়ে রাজনীতি হবেনা; যা, বাবা-মার সেবা করিস তুই।

আর তুমি! প্রশ্ন করতো মিতা।
আমাকে দিয়ে বোধহয় ওসব হবেনা রে। দেশের লক্ষ-কোটি বাবা-মা আমাকে টানে যে। তাদের কথা আমার চিন্তায় আসে। ভয় পেয়ে যায় মিতা, বলে আমাদের ভুলে যেওনা আপু, আর, বাবা-মা ---, আর বলতে পারেনা ও; কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মুখ লুকায় বোনের কাঁধে।

ঝন্টুর কথা ভালো লাগে মিতার। গ্রামে বেশী কথা বলতে পারতোনা । তবু স্কুলে যাওয়া-আসার পথে, এবং কখনও হঠাৎ যদি দেখা হয়ে যেত, কথা হোত দু-একটাই, বেশী নয় । আগে কোন একদিন হরতালের সময় কোন বাস না পেয়ে পথে দাঁড়িয়েছিল মিতা। ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছিল ঝন্টু ওদিক দিয়েই। কষ্ট হবে তাকে টানতে বলে মিতা উঠতে চায়নি, কিন্তু ঝন্টুর মতো ছেলের সাথে পারবে কেন ও! উঠতেই হয়েছে শেষমেষ। অনেক কথাই বলেছিল সেদিন তাকে ঝন্টু। হরতালের দিন ছিল বলে কথাগুলি রাজনীতি সম্পর্কিত-ই ছিল।

হরতাল কেমন বুঝছো মিতা ?
বুঝ্ছি, ঝন্টু ভাই, মানুষের কষ্ট শুধু শুধু । হরতালে মানুষ অথবা দেশের কোন লাভ হয়েছে বলে শোনা যায়না, শোনা যায় শুধু নেতাদের লাভ, হয়  অর্থের না হয় ক্ষমতার ।
ঠিক বলেছো মিতা, এটাই হয় আসলে হরতালে । দেখ, হরতাল আমার ইচ্ছা হলে আমি করবো, নাহলে না করবো । তবে চাপ দিবে কেন, বাস ও গাড়ী পোড়াবে কেন ? হরতালকারীদের দাবীর সাথে মানুষ একাত্ম হলে মানুষই তা পালন করবে । তবে দাবীর সাথে একাত্ম না হলে জোর করে হরতাল পালন করানোর দলগুলির যে প্রবণতা, সেটা থেকেই দলগুলির স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় । বলে ঝন্টু ।
একদম ঠিক কথা বলেছেন ঝন্টু ভাই । মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করবে, হরতাল হবে কি হবেনা । আর হরতাল তথা রাজনীতিতে এতো ধ্বংসযজ্ঞ, এইজন্যই আসলে আমি রাজনীতিকে ভয় পাই ও দূরে থাকি । ছোট করে মিতা উত্তর দেয় ।
কিন্তু মিতা, ভয় করে কি তুমি হরতালের সহিংসতা থেকে রেহাই পাবে ? এই যেমন এখন তুমি বাস না পেয়ে দাঁড়িয়েছিলে, হরতালের কারনেইতো, না-কি? গাড়ী পোড়ানোর কারনে যারা আহত অথবা নিহত হচ্ছে, তারা কোন রাজনীতি করত, বলতে পারো?
তবুও আমার ভয় করে ঝন্টু ভাই । আপুর জন্য আমার অত্যন্ত ভয় করে ঝন্টু ভাই ।
শিরদাঁড়া খাড়া করে ভ্যান চালাতে চালাতে ঝন্টু একসময় বলে ওঠে, তোমাকে দুটো টিপস  দেই মিতা -
(১) দরিদ্র, অসহায় শ্রমজীবি মানুষের ঘর্মাক্ত, মলিন মুখগুলির দিকে তাকিয়ে থাকবে, অনূধাবন করার চেষ্টা করবে তাদের দুঃখকষ্টগুলোকে ; আর
(২) জন্মসূত্রে আমাদের এদেশের উপর একধরনের ঋণ রয়েছে; এই ঋণ আমাদের শোধ করে যাওয়ার কথা । কি জবাব দিব আমরা আমাদের উত্তরসূরীদের নিকট, যদি রাজনীতি শুদ্ধ করে যেতে আমরা না পারি?

জগন্নাথে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সবার নজরে চলে আসে মিতা। তার সহজ সরল কথা-বার্তায় সবাই তার সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে আসে অথবা আসতে চায়। কিন্তু কোথা থেকে যেন একটা গ্যাপ সৃষ্টি হয়ে যায়, অন্তরঙ্গতাটা আর হয়ে ওঠেনা, যেন ধরা যায়না মিতাকে। ইউনিভার্সিটিটাও হয়েছে তার এমন জায়গায়, যেখানে শ্রমজীবি মানুষগনকে জমায়েত হতে হয় প্রতিনিয়তই। এসমস্ত স্থানে এলেই তার মনে পড়ে যায় ঝন্টু ভাইয়ের একনম্বর টিপসের কথা। তার বাবার মতো যেসমস্ত ড্রাইভার সাহেবগন বাস নিয়ে যাতায়াত করেন সদরঘাট থেকে গুলিস্থান হয়ে উত্তরা-টঙ্গী হয়ে গাজীপুর, তাদের এখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে হয়। মিতা দেখে তাঁদের শ্রান্ত-ক্লান্ত ঘর্মাক্ত অবয়বগুলো। যেন তার বাবারা, ভাইয়েরা প্রখর রোদে জীবনের জন্য অবিশ্রান্তভাবে শ্রম করে যাচ্ছেন নিরন্তর। সার্বক্ষনিক প্রচন্ড জ্যমে থেমে থেমে চলতে বাধ্য হওয়া রিক্সাচালকগনের একজন একদিন তাকে হাত দেখিয়েছিলেন, রিক্সার ব্রেক চাপতে চাপতে যে হাত আর হাত হয়ে নেই, শক্ত হয়ে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এসমস্ত মূহুর্তেই মিতার মনে হয় বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী যে কারণসমূহ, সেগুলি মোচনের কোন ব্যাবস্থা কি আছে ? কোন দ্বন্দগুলি আজ রাজনীতিতে, সমাজে বিদ্যমান যার জন্য সহজ-সরল-অসহায় মানুষ তার বাবা এবং বাবার মতো অসংখ্য মানুষ অকারনে মারা যান? এই দ্বন্দগুলি কি রাজনীতি-সমাজ শুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় যে দ্বন্দসমূহ তা, না-কি এগুলি একান্তই অকারণ দ্বন্দ, অর্থের এবং ক্ষমতার? বিষয়গুলির কোন কূল-কিনারা পায়না সে। অব্যক্ত এক বেদনা ছেপে ওঠে তার সমস্ত হৃদয়জুড়ে, বাবার জন্য ডুকরে কেঁদে ওঠে সে!

দুতিন বছর আগে মিতা টিপস দুটি যখন পায় ঝন্টুর কাছ থেকে, তখন থেকেই ঝন্টুর উপর একটা অন্যরকম অনূভুতি কাজ করে বলে মনে হয় তার। ভ্যান চালাতে চালাতে কি অবলীলায় কথাগুলি বলে গেল তার ঝন্টু ভাই, ভাবলেই অবাক হয়ে যায় সে, মানসিকভাবে একটু দুর্বলও হয়ে পড়ে সে ঝন্টু ভাইয়ের উপর। তবে সেটা ঠিক কি কারনে, তা নিয়ে তার মধ্যেও সন্দেহ থাকে। হতে পারে সেটা মানব-মানবীর স্বাভাবিকভাবে তৈরী হওয়া যে সম্পর্ক তা, অথবা ঝন্টুর রাজনৈতিক সত্ত্বাকে শ্রদ্ধাপ্রদান অথবা দুটোই। এটা নিয়ে সে কিছুটা ভেবেছে, তবে তার মনে হয়েছে, যেটাই হোক, ঝন্টু ভাইয়ের উপর তার দুর্বলতা রয়েছে। আরো তার মনে হয়েছে, ঝন্টু ভাই কি যেন খোঁজে। তার চোখের তারার দিকে তাকালেই বোঝা যায় তা।

একদিন বলেই ফেলে মিতা, কি খোঁজেন সারাক্ষন আপনি ঝন্টু ভাই?

এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ঝন্টু অথবা হয়তো সে নিজেও জানেনা যে সে কিছু খুঁজে ফেরে সারাক্ষন। বলে, দেখ আমি কিছু খুঁজে ফিরি, তা কিন্তু আমি নিজেই জানিনা। তবে তুমি যা বলছো, সে সূত্রে বলি, আমি কিছু খুঁজি কি-না জানিনা, তবে আমার ভিতর দেশ-সমাজ নিয়ে চিন্তা-ভাবনাগুলি আসে প্রায় প্রতিনিয়ত। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অসঙ্গতিগুলো সবসময় কেন জানি আমার ভাবনায় আসে। সমাজের এবং রাষ্ট্রের অসঙ্গতিগুলি কিভাবে দুর করা যায়, সেগুলোও আমার ভাবনায় ঘুরপাক খায়। এটা কি রাজনীতি দিয়ে দুর করা যায়, গেলে কোন ধরনের রাজনীতি দিয়ে সেটা দুর হতে পারে, এসবই হয়তো আমি খুঁজে ফিরতে পারি, যেমনটি তুমি বলছো।

এই রকমই প্রিয় তার ঝন্টু ভাই, ভাবে মিতা। গ্রামে একদিন শুনেছিলো ওরই কাছে, অসঙ্গতিগুলো কি কি। এই ধরো, আমরা পাশ করার পর আমাদেরকে চাকরীর বাজারে প্রবেশ করতে হবে। একেতো দেশে সন্ত্রাাসের কারনে বিদেশী বিনিয়োগ নাই বলে কর্মসংস্থানের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত, আবার সরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে বিরাজ করছে চরম দুর্নীতি ও দলপ্রীতি। গাদি গাদি টাকা নিয়ে যাও, না হলে মেধা যতই থাকুক না কেন চাকরী হবেনা। মনে হয় মেধার কোন প্রয়োজন নাই, মেধাহীন লোকেরই প্রয়োজন বেশী দেশে । কেমন করে চাকরী পাবো আমরা, বলতে পারো মিতা ? আবার দেখ, দেশে নানা ধরনের অন্যায়, অবিবেচক কাজ দিনকে দিন এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে, মনে হচ্ছে এসব বন্দ হবেনা আর কোনদিন। কোথাও কোন সুশাসন নাই, সবখানে শুধুই দু:শাসন।

থামিয়ে দিয়েছিল সেদিন ঝন্টু ভাইকে মিতা। বলেছিল, দেশের এতো বড় বড় সব বিশৃংখলা আপনি কিভাবে মিটাবেন জনাব, শুনি? একটু যেন ঠাট্টাই করল মিতা বলে মনে হয়েছিল ঝন্টুর কাছে সেদিন।

হেসেই জবাব দিয়েছিল ঝন্টু, দেখ রাজনীতিকে তুমি ভয় পাও, তাই আর কিছু বললামনা। আমি যে টিপসগুলি দিয়েছি, সেভাবে ভাববে যখন, তখন বলবো। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল মিতা তখন, কথা আর এগোয়নি।

দিন, মাস এগিয়ে যায়। হারুন মিয়ার মৃত্যুর পর ভেঙ্গে যাওয়া সংসারের হাল তাঁর দুই মেয়ে তাদের টিউশনির আয়ের মাধ্যমে মোটামুটিভাবে ধরে রেখেছে। নিজেরা তারা পড়াশুনাটা ঠিক রেখেছে আবার বাড়ীতে মা-ভাইয়েরও কোন অসুবিধা হতে দিচ্ছেনা। পারছেনা শুধু মায়ের কান্না থামাতে। এ বড়ই কঠিন কাজ, জানে ওরা। বছরখানেক হয়ে এলো হারুন মিঞার গত হওয়া, এখনও মেয়েরা বাসায় এসে পরম আদরে মাকে জড়িয়ে বসে থাকে অনেক, অনেকক্ষন করে। অনূ বলে, তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাব মা, চাকরী একটা পেয়ে নিই আগে। বছরখানেক অপেক্ষা কর আর। হাহাকার করে ওঠে মায়ের মন।

ধীরে ধীরে আরো কঠিন হয়ে ওঠে মিতার মন। এর মধ্যে একদিন দীর্ঘক্ষন কথা হয় ঝন্টুর সাথে। ব্যস্তভাবে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল ঝন্টু একদিন। সদরঘাটে সস্তায় বই প্রকাশ করে দেন কিছু লোক। তাদেরই একজন সেলিম ভাই, ভ্যানে করে বই বিক্রি করেন তিনি, সস্তায় বই প্রকাশও করে দেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর্থিক কারনে যারা বই প্রকাশ করতে পারেননা, তাদের ভরসা ইনারাই। মাঝারী মানের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে যেখানে খরচ হয় প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা, ইনারা সেখানে পাঁচ-সাত হাজারের মধ্যে প্রকাশ করে দিতে পারেন, তবে মান অবশ্য নিম্নই হয়। ঝন্টুর সাথে একটা ছেলেও ছিল সেদিন। ছেলেটা সেরকম একজনের কাছে যাচ্ছিল কবিতার একটা বই ছাপবে বলে। পথে দেখা হয়ে গেল মিতার সাথে। ফেরার সময় মিতার সাথে কথা বলবে বলে ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল ঝন্টু।

ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া পার্কে বসে কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে। সাথের ছেলেটা ছিলনা তখন। মিতাই প্রথমে বলে, অনূর রাজনীতি তোমার অপছন্দ কেন ঝন্টু ভাই? সে-ও তো গনমানুষেরই কথা বলে।

দেখ মিতা, শুরু করে ঝন্টু, ব্যাপক মানুষ তথা খেটে খাওয়া মানুষের উপর অনূর সহমর্মিতার কোন অভাব আছে তা আমি বলিনা। তবে অনূর রাজনীতিতে গনমানুষের কোন লাভ হবে বলেও আমি মনে করিনা। আমাদের এখন অনূধাবনের সময়, স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পার হতে যাচ্ছে, অথচ আমাদের রাজনীতি আমাদের অর্থাৎ আমরা তরুন প্রজন্ম কি চাই, সেটাই বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। আজও এদেশে রাজনীতি হয় ব্যাবসায়িক মনোভাব নিয়ে অর্থাৎ রাজনীতি যেন ব্যাবসায়িক বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে। আর এই ব্যাবসায়িক মনোভাবের জন্যই রাজনীতিতে এতো হানাহানি, এতো সহিংসতা, যা আমাদের গোটা সমাজজীবনে ছড়িয়ে পড়েছে।  

এসব আমাদের অজানা নয় ঝন্টু ভাই। আর কি বলবেন আপনি ?

আমি বলতে চাই মিতা, রাজনীতি আমাদের চাহিদামতো হতে হবে। আমরা চাই দেশ ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে চলুক, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হোক, কিছু সুবিধাভোগী মানুষের পরিবর্তে সকল শ্রেণী-পেশার সব মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করুক। শুধুমাত্র রাজনীতির কারনে কেন এতো অশান্তি থাকবে মানুষের জীবনধারনে, মানুষের জীবনযাপনে?

কি করবেন আপনি, আপনারা?
 দেখ মিতা, শিক্ষিত তরুন-তরুনীসহ দেশের আপামর জনগনের আজ পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি শুদ্ধ করার। আমরা দেশে সহিংসতা, হানাহানি বন্দ করে সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্বক্ষেত্রে ন্যায়ভাবে, নায্যভাবে কাজ করতে বাধ্য করব। যেখানেই কোন অন্যায় দেখব, গর্জে উঠব আমরা এবং উক্ত অন্যায় কাজ বাতিল করে সঠিক ন্যায়ানূগভাবে কাজটি যতক্ষন না সমাধা হচ্ছে, চাপ অব্যাহত রেখেই যাব আমরা, থামবনা।

এতো সহজ কাজ তো এটা মোটেই নয় ঝন্টু ভাই। আপনারা এটা করতে গেলে এর ফলে যারা ক্ষতিগ্রন্থ হবে, তারা এটা আপনাদেরকে করতে দিবে কেন? বিবাদ লেগে যাবেনা দেশব্যাপী?

আমাদের একটা খোলা ডাক দিতে হবে মিতা। সেই ডাকে কেউ সাড়া দিবেনা বলে আমি মনে করিনা। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ তাতে সাড়া না দিয়ে পারবেনা। মানুষকে সংগঠিত করে কংক্রিটের মত জমাট বাঁধিয়ে ফেলতে হবে। আর কিছু করতে হবেনা। এই জমাট এতো শক্তিশালী হবে যে, সুবিধাভোগী সকল শক্তিই এটার কাছে অতি তুচ্ছ হয়ে যাবে। মানুষের সন্মিলিত শক্তি অপরাজেয়। অপ্রতিবোধ্য হয়ে উঠবে এই শক্তি। দরকার শুধু শুরুটা করাটা। আর বিবাদ বলছো! ধবংস ছাড়া কোন সৃষ্টি হয় কি? রাতের আঁধার না কাটলে কিভাবে সূয আলো ছড়াতো, বলতো। এ হবে আরেক যুদ্ধ মিতা। একাত্তরে ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং লাখ মা-বোনের চরমতম অপমানের বিনিময়েইতো স্বাধীন হয়েছে আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমি। এই চরম ক্ষতিগুলি যদি না হোত, কেমনে তবে আমরা স্বাধীন হতাম? অনেক ধ্বংস, অনেক ক্ষতি না হলে কিভাবে আমরা শুদ্ধ হবো? অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পরেই না আকাশে উঠবে আগামীর ঐ রক্তিম সূয।

তন্ময়তার কেমন যেন একটা ভাব এসে গিয়েছিল মিতার মধ্যে, কথাগুলো শুনতে শুনতে। সেই ভাবটা কাটতেই আবার শুরু করে ঝন্টু, বলে, হারুন চাচার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইতে তুমি, মিতা। তিনি এবং তাঁর মতো মারা যাচ্ছেন যারা একান্তই অকারনে, তাঁদের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে আমাদের সবার এই সন্মিলিত কার্যক্রমে। আসবেনা মিতা তুমি সন্মিলিত এই কার্যক্রমে? ভালো করে ভেবে দেখ, আর কি কোন পথ আছে আমাদের সামনে এছাড়া?
হাঁ ঝন্টু ভাই, আমাদের সবাইকে আসতে হবে এই উদ্যোগে, সবাইকে আমাদের, বিশেষত: আমাদের আজকের এই প্রজন্মকে ধাবিত হতে হবে সে ই রক্তিম সূর্যের দিকে, এভাবেই।
আসলেই তাই মিতা, আমরা সেভাবেই ধাবিত হবো; চল, উঠতে হবে আমাদের, সন্ধা প্রায় পার হয়ে গেল।  
কি যেন কি পড়ে গেল মিতা, চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝন্টু।পরক্ষনেই ঝট করে বলে উঠলো,চলেন ঝন্টু ভাই।
ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো দু'জন,চলে গেল দু'দিকে, মিতা জগন্নাথের, আর ঝন্টু ফুল্বাড়িয়া, তার মেসের দিকে। (সমাপ্ত)।
Likes Comments
০ Share