বয়ঃসন্ধিকালের প্রেম
বানরের যা স্বভাব, টোকা দিয়ে তালে তাল মিলিয়ে চলা। এসব ইতরবাচক প্রাণীর কিছুটা বৈশিষ্ট্য কতক দু’পায়া সেরা প্রাণীদের মধ্যেও বিদ্যমান। ধ্রুব অবশ্য ব্যতিক্রম। কথাবার্তা-চালচলনে বেশ অমায়িক। পোষাক-পরিচ্ছেদে সবসময় মার্জিত। এককথায় সাবলীল বলতে যা বুঝি, ঠিক তাই। বয়ঃসন্ধিকাল পেরুনোর সাথে সাথে এক শ্রেণির মেয়েরা প্রেমে পড়ার প্রতিযোগিতার হিরিক বসিয়ে দেয়। যত্রতত্র একের পর এক প্রেমিকের পসরা সাজিয়ে রাখে। মোহনা ওই কাতারের চোখ জুড়ানো দৃষ্টিনন্দিত একজন। তিনিও ডজনখানেক প্রেমিক তার মোহে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তবে ওসব প্রেমিক মোহনার যৌবনে আকৃষ্ট ছিল। তাদের প্রেম প্রকৃত ছিল না। হয়তো মোহনার ওসব বুঝার বয়স ছিল না। নতুবা নাই মামার চেয়ে পিড়িতের প্রেতও ভালো সেদিক বিবেচনা করে মোহনা তাদের আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু ধ্রুব ছিলেন মোহনার অনন্য আকর্ষন। মোহনা নিজেই ধ্রুবর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রেমের সমূদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকেন। মোহনার বাঁকা দৃষ্টি আর অঙ্গভঙ্গি দেখে ধ্রুব বুঝতেন পারেন, মোহনা তার প্রতি দুর্বল। তিনি কালবিলম্ব না করে মোহনাকে নিজের প্রেমের জালে জড়িয়ে নেন। চিঠি দেয়ানেয়া, বিদ্যালয়ে যাবার পথে দাঁড়িয়ে থেকে চোখে চোখ রেখে ইশারায় কথা বলা, ফুলের পাপড়ি ছিটাছিটি সব মিলিয়ে প্রেমের পালকিতে হুনহুনা করতে করতে ধ্রুবর বেকার সময়টা ভালোই কাটছিল। তবে কখনো হাতে হাত রেখে মনের কথাগুলো বলতে পারেননি। অজপাড়াগাঁয়ে ওই সুযোগটা পাওয়া যায় না বললেই চলে। মাস চারেক এভাবে তাদের প্রেম চলতে থাকে। আত্মীয়-স্বজনরা টের না পেলেও পাড়ার বাঁদর ছেলেদের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি ওরা। চার মাসের মধ্যে প্রতিবেশিরাও কিছুটা আঁচ করতে পারে। আঁচ করাটাই স্বাভাবিক ছিল। ধ্রুব এতোটাই উন্মাদনা করতেন, যখন-তখন মোহনার বাড়ির পাশে ঘোরাঘুরি করতেন। সেদিনও ধ্রুব মোহনার বাড়ির পাশে পায়চারি করছিলেন। হঠাৎ হট্টগোল লেগে যায় মোহনা বমি করছে আর কেমন যেন করছে। মোহনার দুর্দশা দেখে দ্রুত গ্রাম্য চিকিৎসক ডেকে আনা হল। চিকিৎসক চিকিৎসা করছিলেন। এর মধ্যে চেনা-অচেনা প্রতিবেশিরা জড়ো হতে থাকে, মোহনার কী হয়েছে? তা দেখতে। ভালোবাসা বা কৌতুহল, যা-ই বলিনা কেন, ধ্রুবও যায় সেখানে। চিকিৎসক চিকিৎসা শেষে জানিয়ে দিলেন, মোহনা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এসংবাদে পরিবারের অবস্থা কী আর বলবো, ধ্রুবর মাথায়ও যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মোহনার প্রতি ঘৃণা নিয়ে ধ্রুব ফিরে আসছিলেন। কিন্তু ফিরতে পারলেন না। প্রতিবেশিরা তাকে আটকে রাখেন। কেননা তারা জানেন, মোহনার সাথে ওরই প্রেম রয়েছে। অথচ মোহনা বানরের স্বভাবটা দেখিয়েছিল বাড়ির পাশের প্রতিবেশির বাসায় চোখ পলান্তি খেলতে গিয়ে। খেলার ছলে এক যুবক শূরশূরি দিলে দুজনের সম্মতিতে ঘটনাটি ঘটে যায়। ওটা প্রেম ছিল না। গোলাপের কুঁড়ি লাল বর্ণ ধারণ করার মুহূর্তে সাময়িক মোহ ছিল। ঘটনার প্রকাশের আকস্মিকতায় মোহনা হতভম্ব হয়ে যান। সত্য বলার মতো পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিল না। যেহেতু ধ্রুবকে মোহনার পছন্দ ছিল, তাই তিনি সত্য বুকে চেপে রেখে নীরব থাকেন। তার নীরবতায় স্পষ্ট হয় ঘটনার খলনায়ক ধ্রুবই ছিলেন। ধ্রুবকে আটকে রেখে মোহনার আত্মীয়-স্বজন বিষয়টা জানিয়ে ধ্রুবর বাসায় সংবাদ দেয়। তাদের ইচ্ছা ছিল, ধ্রুবর মা-বাবা এলে কাজী ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দিবেন। ওই অবস্থায় ভেবে চিন্তে বিকল্প সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো উপায় ছিল না। সংবাদ পেয়ে ধ্রুবর বাসা থেকে ঊনিশ-কুড়ি বছরের একজন মহিলা দুটি বাচ্চাসহ এলেন। এসে কান্নাভরা কণ্ঠে বলছিলেন, ওর অপকর্মের বিচার করতে হয় করুন কিন্তু আমার সংসারটা ভাঙ্গবেন না। অল্প বয়সে প্রেম করে বেকার ছেলেকে বিয়ে করে দুই সন্তান নিয়ে এমনিতেই কষ্টে আছি। উপস্থিত কারো বুঝতে বাকি রইল না, ভদ্র মহিলা ধ্রুবর স্ত্রী। মোহনার পরিবারের লোকজনের মহিলাটির প্রতি মায়া হল। কিন্তু পরিস্থিতি মেনে নেয়ার মতো অনুকূলে ছিল না। তাই তারা যেভাবেই হোক ভদ্র মহিলাকে বুঝিয়ে রাজি করালেন ধ্রুবকে দ্বিতীয় বিবাহের সম্মতি দিতে। সব শোনে ভদ্র মহিলা সম্মতি দিতে বাধ্য হলেন এবং ব্যথাভরা মনে চলে গেলেন। ধ্রুব পড়েছেন মাইনকা চিপায়। মুখোশধারী বানরের স্বভাবে চললে মাইনকা চিপায় না পড়ে উপায় আছে? কাজী ডাকা হলো। সর্বসম্মতিতে বিবাহ সম্পন্ন হলো। ধ্রুব তার পিড়িতের ময়না মোহনাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ বাড়িতে গেলেন। সেখানেও লোকের ভীড় দেখতে পেলেন। এক ভীড়ের ঠেলায় মোহনা তার ঘাড়ে। এখানে আবার কিসের ভীড়? দুই নব দম্পতি এগিয়ে গিয়ে আতকে উঠেন। কেননা বাড়ি ফিরে ধ্রুবর প্রথম স্ত্রী সন্তানসহ আত্মহত্যা করেছেন। স্ত্রী-সন্তানদের লাশ দেখে ধ্রুব নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। নিজের বানররূপী স্বভাবের জন্য এতোক্ষণের চেপে রাখা সত্য আর ক্ষোভ ঘৃণাভরা উঁচুকণ্ঠে মোহনাকে শোনাচ্ছিলেন। মোহনা লজ্জায় নিজেকে আড়াল করতে ওখান হতে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। কোথায় যাচ্ছিলেন মোহনা? তিনিওকি--? তা জানার ফুসরত আমার ছিল না। নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানোর এতো সময় কোথায়? তবে একটি তথ্যতো অবশ্য আমার কাছে আছে, তা হলো, বয়ঃসন্ধিকালে কোনো প্রেম-টেম নয়, শুধুই লেখাপড়া আর পড়ালেখা। এবং অভিভাবকদের উচিৎ ওই সময় সন্তানের পালে যেন গরম হাওয়া না লাগে তাই বন্ধুর মতো সঙ্গ দেয়া। ব্যস এটুকুই।
Comments (1)
চমৎকার লিখেছেন দাদা।
ভাল লাগল