Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

কে এম রাকিব

১০ বছর আগে লিখেছেন

এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার চিঠি( প্রতিযোগিতা, চিঠি বিভাগ)

                                                                                                                       খুলনা, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ইং

আমাগের ভায়েরা,

তোমরা এই যুগের ছাওয়াল পাওয়াল।আমাগের বয়েস হয়ি গেছে, ঘটে তোমাগের মত বিদ্যাবুদ্ধি নেই, আধুনিকতা বুঝিনে।তাই কি বলতি হয় বুঝিনে, কেমন করে বলতি হয় তাও বুঝিনে।তারপরে গুছায়ে কথা বলতিও পারিনে, এদিক সেদিক হইয়ে যায়, বোঝইতো, এক পা কবরে দিয়ে বইসে আছি।লালনের মত ‘আমি অপার হয়ে বইসে আছি’ না বলিলেও, বইসে তো ঠিকই আছি! এই বুড়ার কথা শোনবার জন্যি তোমাগের এত আগ্রহ দেইখে আমার চোহি পানি চইলে আসে।এই পানি চইলে আসাটাতেও তোমাগের যে বিরক্ত লাগবি তাতে আর আশ্চর্যের কি! তারপরও এই বুড়া কিছু বলতি চেষ্টা করিবে।

 

এখন তোমাগের যেমন রক্ত গরম আমাগেরও তেমন ছেল একসময়। আবার এখন আমাগের যেমন ঝিমায়ে পড়া অবস্থা হইয়েছে, তোমাগেরও সেই অবস্থা হবি একদিন। এইটে মনের মধ্যি রাখলি পরে, ভাল হয়।তোমরা ভাবতি পারো, বুড়া উপদেশ ঝারিতে চাচ্ছে।হতি পারে,নাও হতি পারে।মনে কয়, এ বয়সে কথাবলতি গেলে, এমনি এমনি উপদেশ বারোয়ে যায় অথবা এমন কইরে কথা ফুটেওঠে আমাগের মুখে, যারে উপদেশের মত লাগে। সেইটে তোমাগের এট্টু সহ্য করা লাগবি।যাহোক, কথাতে ফিরে আসি।মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার কেমন লাগে, (তোমরা বলো, অনুভুতি কী), এ বিষয়ে কিছু বলার আছে কিনা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন কি ছেল, কতটুক পায়েছে মুক্তিযোদ্ধারা- এইসব জানতি চায়েছ। যতই বলি না কেন, পন্ডিতেরা আরো ভাল বলতি পারবে।আমি কিছু বলতি গেলে পর, খালি আবেগে ভাইসে যাই! আমি রাজনীতি বুঝিনে, অর্থনীতি বুঝিনে, নকল কইরে মেট্রিক পাস দিছি কিন্তু লেহাপড়ি তো করিনি, জ্ঞান আসিবে কোথাত্তে? সেই জন্যে যাই বলি, তাতে গুরুত্ব নাদিলিও চলবি।

 

স্বপ্নের কথা বলতি গেলে আগে বলতি হয়, আমরা আগেও বলার মত ভাল ছেলামনা,  এখনো নেই। এই দেশ বানের জলে ভাইসে যাওয়া দেশ, ঝড়ে ভাইঙ্গে পড়াদেশ, এই দেশে চিরটাকাল কতনা বর্গি আসিল, আবার চই্লে গেল,  কত রক্তপাত হইল, দুর্ভিক্ষে কতনা মানুষ মরিল,  বিদেশিরা শাসন নির্যাতন কইরে গেল, এরই ভিতরে এঅঞ্চলের মানুষ দিনাতিপাত করিছে।এর মধ্যে ভাল মন্দ মানুষের মিশোল ছেল, এখনো আছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাগের যে স্বপ্নটা দেহালো সেইটা বড় ঘোরলাগানি স্বপ্ন।আমরা কেমন কইরে যেন বিশ্বাস কইরে ছেলাম, এইবার আসিছে যেন মুক্তির পহর।সেই মুক্তি কেমন হবি? অন্যেরা কেমন বুঝিছে আমি জানিনে, কোন খ্যামতার গন্ধ তারা খুজিছে কিনা জানিনে, আমাগের মত আরো অনেকে তখন ভাবিছে, এইবার বদলাচ্ছে তা’লে দেশ। এইবার আমরা এট্টু সুখ পাব। এই বার মুক্ত হবি, সব জ্বালা থেকে, ভাত-রুটি আলু-পটলের উপরে উঠিয়া মানুষেরা মানুষ হবার যুয়োগ পাবি।আমার যে বন্ধু যুদ্ধে পা হারায়েছে, হাত হারায়েছে, কিংবা জীবন হারায়েছে, তারা এমন কইরেই ভাবিছে। জিজ্ঞাসা করিলে, হাইসে বলত, এইবার হবি। একাত্তুরের আগেও বহুত দেশপ্রেমিক জেবন দিয়েছেল, বহুত যুদ্ধ করিছে এদেশের মানুষ।কিন্তু এই একাত্তুর আইনেছেল দেশের ধমনীর রক্তের মইধ্যে আগুন।আমরা কেমন কইরে যেন বিশ্বাস কইরে ছেলাম, সব ভাল হইয়ে যাবে। কেমন কইরে ভাল হবে সে আমরা জানতাম না। সব যে ভাল করা যায়না সেইটেও কি তখন বুঝতি পারিছি? আমরা ধইরে নিয়েছেলাম,  হবে, সব ভাল হবে, -আমাগের সাহসে, ভালবাসায়। অকাতরে রক্ত বেলোতে তাই ভাবতি হয়নি।তারপর আমাগের স্বাধীন জমিন হল।আমরা কি মুক্তি পালাম? -কবার মত? এতদিন রক্ত চুষিত বিদেশী বেনিয়া, এখন আমাগের দেশের লোক? আমাগের ভায়েরা? তা’লে কেমন মুক্তি হল? এইসব ভাবতি ভাবতি হতাশ হইয়ে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের ভাতা আনতি গেলাম না দুঃখে। আরো দেখিলাম আমাগের সেই সব ভায়েদের নাক মুখ-চক্ষু কেমন বদলায়ে গেল, তাদের কথাবার্তা দলায়ে গেল।তারা একাত্তুরে যেমন  ভাই ছেল তেমন যেন আর রইল না।আর যারা আমাগের জমিন স্বাধীন হউক চায়নি, যারা মায়ের বইনের সর্বস্ব  লুটে নিয়েছেল, বাড়িঘরে আগুন লাগায়ে নির্যাতন কইরে, পশুরেও হার মানায়েছেল, তারা সুযোগ পাইয়ে ক্ষমতা দখল কইরে নিল,  তারা পতাকা ওড়াল, সেই পতাকা যা তারা একদিন পায়ে দইলে চইলে গেছেল।তখন আমাগের অবস্থা কেমন হয়েছে ভাবো তো,- যারা দলবাজি করিনা, যারা ভালবাইসে এই মাটিরে, পতাকারে, যারা যুদ্ধ কইরেছি, যারা মুক্তি শব্দটারে নতুন অর্থ দিয়ে দাগায়ে রাইখে ছেলাম বুকের মইধ্যে? কেমন লাগিছে?  তোমরা কি বুকের মইধ্য অনুভব করতি পারো? স্বপ্ন ভাইঙ্গে দুঃস্বপ্ন হইয়ে গেলে কেমন ঢেউখান লাগে?  এসব কথা বলতি গেলি পর, চোহি পানি আইসে পড়ে। তোমাগের তা ভাল লাগবিনা।

কি কব তোমাগের আর? চারদিকে দেখি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলতিছে বাণিজ্য। আমার স্ত্রী মইরে যাবার আগে অভাব দেইখে গেছে, ঠিকমতো খাতিও পারত না।সে বলিত, তুমি যুদ্ধ কইরে পাপ করিছ, সেই পাপের জন্যি ঠ্যাং হারায়েছ, এখন না খায়ে মরো। বেচারি দুঃখে কয়েছে একথা। আমি কিন্তু এটি ভাবতি পারিনে। মনে হয় এই পাপটু আরো ভাল কইরে করতি পারলি শান্তি পাতাম। তবু এই পঙ্গু বুড়া কি হতাশ হয়ে পড়িছে?  জেবন থাকলি তো হতাশ হতিই হবি।তার চায়ে মনে কয়,যা করিছি ভাল করিছি, মানুষের সবচায়ে যে বড় জিনিস সেই বিকেকের কাছে তো ধবধবা থাকলাম। আর কি পালাম না পালাম সে ভাবি আর কি হবি?  একদিন দুনিয়া যদি দুনিয়ার মত হইয়ে যায় মানুষের কাজে কামে,  সেইদিন আমাগেরে মনে রাখিতে হবে, আমাগের তরে যে ভালবাসাটা রাখিবে সে ভালবাসা খ্যামতার  মাছিরা কেমন কইরে পাতি পারে? সেই জন্যিই তো একলা অন্ধকারে বইসে থাকলিও মনের মইধ্যে গর্ব লাগে।

 

তোমরা যুদ্ধের বীরত্বের কথা জানতি চায়েছ, আমিও যুদ্ধ করেছেলাম, বন্দুকের গুলিতে মাইরে ছেলাম শত্রুগেরে। এখন কিন্তু বুঝি ভিন্ন জিনিশ, বীরত্ব থাকে আমাগের মানুষের বুকের মইধ্যে,  বীরত্ব থাকে স্বপ্ন দেখায়, থাকে অসম্ভবরেও সম্ভব করতি পারা যায় এই বিশ্বাসে। সেই বিশ্বাসরে সত্যি বানাতে ঝাঁপায়ে পড়ায়। সেই বীরত্ব আমাগের মানুষের একদিন ছেল,  আবার হারায়ে ফেলিছি আমরা। কি কব তোমাগের? চক্ষু ধইরে আসে।আমরা কিছু চাইনে, খয়রাত চাইনে, চাই আমাগের স্বপ্নের দাম দেয়া হউক।

 

শ্যাষ করতি হবি।এই বুড়া বুঝতি পারিছে, মুক্তিযুদ্ধ কোন কালে শ্যাষ হয়না, মুক্তি যুদ্ধ চইলতেই থাকে। তোমাগের মইধ্যে হইতে নতুন দিনের মুক্তিযোদ্ধা বারোয়ে আসুক,  সেই বাসনা মনের মইধ্যে রাইখে দেলাম।আর তোমাগের সকলের জন্যি রাইখে  দেলাম  দোয়া।

ইতি
একজনপঙ্গুমুক্তিযোদ্ধা

  

 # চিঠিতে যে ডায়ালেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে, বয়স্ক ব্যক্তিরা ভাইদের যেমন ভায়া বলে, ছোটদেরকেও আদরার্থে ভায়া বলে থাকে।

Likes ২৯ Comments
০ Share