Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

জেসমিন

১০ বছর আগে লিখেছেন

দেশপ্রেম, ত্যাগ এবং প্রাপ্তি ( প্রতিযোগিতার জন্য)

 

 

সময়ঃ ১৯৭০ ডিসেম্বর মাস

জামিল সাহেব তার মেয়ে রুবাকে  নিয়ে জাদুঘরে এসেছেন। মেয়ের অনেক দিনের আবদার পূরণ করার জন্যই এই আসা । স্ত্রীকে আসতে বলেছিলেন কিন্তু তিনি রাজি হননি। তাই বাপ বেটি দুজনেই এলেন । এখনও মেয়ের আজব সব আবদার পূরণ করা লাগে তবুও মেয়ে যে আর ছোটটি নন তিনি তা মেয়েকে মনে করিয়ে ক্ষেপানোর চেষ্টা করেন।  যাই হোক , শীতের বিকেলে বাবা মেয়ে জাদুঘরেরে নিচ থেকে দেখতে দেখতে দোতালায় উঠলেন। ঠিক তখনি বন্ধু খালেদের সাথে দেখা হয়ে গেল । প্রায় দশ বছর পর বন্ধুর দেখা পেয়ে দুজনে বেশ আপ্লুত হয়ে গেলেন। দুজন পরস্পরের এবং  পরিবারের খোজ নিলেন। বেশ কিছুক্ষণ একসাথে কাটিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। কিছুদিন পর বন্ধু খালেদ অফিসে চলে এলেন একটি প্রস্তাব নিয়ে । তার ছোট ছেলে আসিফের  সাথে রুবার বিয়ে দিতে চান। জামিল সাহেব মেয়ের বিয়ের কথা সেভাবে ভাবছিলেন না মেয়ের পড়ালেখা চলছিল বলে। তবুও বন্ধুর প্রস্তাব তিনি একেবারে না করতে পারলেন না ছেলের সামাজিক অবস্থান এবং নিজেদের মাঝে পুরনো সম্পর্ক মজবুত করার আশা দেখে । বাসায় এসে বিষয়টি হেনার সাথে আলাপ করায়  হেনা বলল , মেয়ে যদি আপত্তি না করে ভেবে দেখতে পার। মেয়েকে জিজ্ঞেস করায় মেয়ে জানাল , তোমরা যা ভাল মনে কর ।  ব্যাস , এক মাসের মধ্যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। এর মাঝে অবশ্য রুবার সাথে আসিফের দুবার দেখা হল ।

আসিফের সাথে রুবার যেদিন দেখা হল এক দেখাতেই মানুষটার প্রতি ভাল লাগা তৈরি হল। আসিফের ব্যক্তিত্ব তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল । জানুয়ারিতে যখন তাদের বিয়ে হল তখন দেশ এক আশংকায় কাঁপছে। চারদিকের আবহাওয়ায় কেমন একটা গুমোট ভাব। একটা যে পরিবর্তন আসবে তা মানুষ টের পাচ্ছে । তার মাঝেই মানুষ নিজেদের নিত্য নৈমিত্তিক কাজগুলো করছে । তেমনি এক পরিবেশে আসিফ রুবা তাদের সুখের নৌকা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল নানান স্বপ্ন দিয়ে । বিয়ের দেড় মাসের মাথায় রুবা আসিফের কানে কানে নতুন খবর দিল। দুই পরিবারের সবাই খুব খুশি আনন্দের এই খবর শুনে। জীবন এত সুন্দর হতে পারে ভেবে রুবা পুলকিত হয়। কিন্তু তার সাথে সাথে দেশের অবস্থাও মনকে ভাবনায় ফেলে দেয়। কি হবে দেশের ? এভাবে আর কত মানা যায় পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ । আসিফের সাথে দেশের সংকটময় অবস্থা নিয়ে নানারকম আলাপ হয়। দিন দিন আসিফকে বেশ চিন্তিত দেখায় । অফিস থেকে ফেরার পর বন্ধুদের সাথে গোপনে কি যেন আলাপ আলোচনাও করে । একদিন বিকেলে আসিফ অফিস থেকে ফিরে রুবাকে বলেই ফেলে , এভাবে আর চুপ থাকা যায় না । আমারও কিছু করা উচিত ।

রুবার মন গোপন এক আতংকে কেঁপে উঠে । সে ধীরে ধীরে জানতে চায় আসিফের কাছে, কি করতে চাও তুমি ?

“রুবা আমাদের মত তরুণদের এখন আর ৯-৫ টার অফিসে মানায় না । দেশের হাজারো তরুণ এখন দেশের অস্তিত্বের লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে। আমারও তাই করা উচিত । আমিও চাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য কিছু করতে ।”

“কিন্তু তুমি চলে গেলে এই অবস্থায় আমি একা কিভাবে থাকব ? আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না । ”- রুবা 

“না রুবা , এভাবে বল না।আর সব মায়েদের কথা , স্ত্রীদের কথা ভাব। তারা যদি প্রিয়জনদের সম্মতি দেয় তুমিও পারবে। আমাদের সন্তানের জন্যই আমাকে যেতে হবে । আমাদের  সন্তান কোন পরাধীন দেশে বড় হোক তা আমি চাই না। আমি তাকে মুক্ত স্বাধীন একটি দেশ উপহার দিতে চাই। যেখানে সে নিঃশ্বাস নিতে পারবে স্বাধীনভাবে ।”

রুবা কিছু বলার মত খুঁজে পেল না । এটাও তো ঠিক দেশের এই অবস্থায় সে আসিফকে কি করে আটকায় ।

অবশেষে এক গভীর রাতে আসিফ তার আরও কিছু বন্ধুর সাথে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বের হয়ে এল। রুবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল , আমার ভালবাসা তোমার কাছে রেখে গেলাম। নিজের যত্ন নিও। ইনশয়াল্লাহ স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়েই তোমার কাছে ফিরে আসব। রুবা এক বুক কষ্ট নিয়ে আসিফের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল ।

সন্তানসম্ভবা রুবা তার বাবা মায়ের  সাথে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য রাতের আধারে অনেক ঝামেলা পোহায়ে  গ্রামের বাড়ি চলে গেল । তাদের গ্রাম বেশ দুর্গম এলাকায় হওয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখানে সেভাবে হামলা চালাতে পারেনি। এক একটা মাস যায় আর রুবার প্রতীক্ষা বাড়তে থাকে । এর মাঝে আসিফ দুইটি চিঠি দিয়ে তার খোঁজ জানিয়েছিল। কিন্তু চিঠি পৌঁছান দুরহ  এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাও দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। রুবার প্রতিক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত আসিফের ভাবনায় কাটে । সঙ্গী হয় চোখের জল। কিসের এক অভিমান তার প্রতিটি ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নভেম্বরের এক বিকেলে আসিফের লেখা শেষ চিঠি হাতে পায় রুবা। তাতে সে দেশ স্বাধীন হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ও তাদের বিভিন্ন অপারেশনের সাফল্যের কথা লিখে। দেশ স্বাধীন হলে দেশের সামনে এগিয়ে যাওয়া কেউ দমাতে পারবে না তাও লিখে। দেশের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা একটাই বিশ্বাস নিয়ে দেশের আনাচে কানাচে লড়াই করছে । তা হল দেশপ্রেম। এই প্রেম  দেশকে সাফল্য এনে দিবেই , এটাই আসিফের বিশ্বাস। সেই সাথে রুবার জন্য ও তাদের অনাগত সন্তানের জন্য তার মনের মাঝে যে অপরিসীম ভালবাসা জমে আছে তার কথা জানায়। এবং কষ্ট করে আর কটা দিন অপেক্ষা করতে বলে রুবাকে। আসিফের চিঠি রুবার মনে অপেক্ষার তীব্রতা বাড়িয়ে তোলে ।

দেশ বিজয়ের কিছুদিন আগে রুবা কন্যা সন্তান জন্ম দেয় । সন্তানের মুখ তাকে আসিফের খুশি ভরা মুখের কথা মনে করিয়ে দেয়। মা মেয়ে অপেক্ষায় থাকে আসিফের ফেরার । ১৬ ই ডিসেম্বর আসে। বাংলাদেশ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। পরিচিত অনেকেই ফিরে আসে। আবার অনেকের খোঁজ পাওয়া যায় না। আসিফেরও কোন খোঁজ পায় না রুবা । এখানে ওখানে খবর নেওয়ার চেষ্টা করে। সঠিক খবর পাওয়ার জন্য তারা আবার ঢাকায় চলে আসে । অনেক দৌড়াদৌড়ি করেও যখন কি করবে বুঝতে পারছিল না তখন আসিফের এক সহযোদ্ধা এল দুঃসংবাদটি নিয়ে। বিজয়ের মাত্র দুইদিন আগে এক অপারেশনে গুলি লাগায় প্রচুর রক্তক্ষরণে আসিফের মৃত্যু হয়। স্ত্রী সন্তানকে দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ।

রুবা খবরটি শুনে শুন্য চোখে পাথর হয়ে বসে থাকে। আসিফ তার জীবনে আর আসবে না বা তার সন্তান কখনও বাবার মুখ দেখার সুযোগ পেল না তা ভাবতেই পারে না রুবা । সে তো জীবনে বেশি কিছু চায় নি তবুও কেন এমন হল। রুঢ় বাস্তবতা জীবনকে থামিয়ে রাখে না । শত কষ্টের মাঝেও মেয়েকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়ে ।

 সময়ঃ ২০১৪ , ২৫ শে মার্চ

৬৭ বছরের বৃদ্ধা রুবা আলমারি থেকে মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর ছবিটা বের করেন। কাঁপা হাতে আঁচল দিয়ে যত্ন করে মুছে দিলেন। চোখের পানি টপ করে ছবির উপর পড়লো । মাত্র কয় মাসের স্মৃতিতে ঘেরা স্বামীর প্রতি কিসের যেন অভিমান এখনো রয়ে গেল।

আগামীকাল ২৬ শে মার্চ । স্বাধীনতার আরও একটি বছর পূর্ণ হবে । কিন্তু পূর্ণ হয়েছে কি দেশের সকল সমস্যার সমাধান ? কেন চারদিকে এত বিতর্ক? স্বাধীন দেশে বাস করেও কেন মানুষ জীবনের নিরাপত্তা পায় না , শিশুর মুখে ভেজালমুক্ত খাবার তুলে দেওয়া যায় না ? এত বছর পরও কেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয় , এখন তো আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলার কথা । দল মত নির্বিশেষে   সবার তো ভাবনা হওয়া উচিত আমরা বাংলাদেশপন্থী। আমাদের সব কাজের প্রধান উদ্দেশ্য থাকবে দেশপ্রেম । তবেই তো আমাদের মত রুবারা তাদের ত্যাগের সার্থকতা খুঁজে পাবে । আসবে কি সেই দিন ?

রুবা অপলক নয়নে জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজে ফিরে তার প্রশ্নের উত্তর .........  

Likes ১৮ Comments
০ Share

Comments (18)

  • - আলমগীর সরকার লিটন

    দাদা

    সুন্দর এক আধুনিক কবিতা বেশ ভাবনাময়

    অভিনন্দন-------

    • - কেতন শেখ

      অনেক ধন্যবাদ লিটন ভাই।

    - জাকিয়া জেসমিন যূথী

    কবিতায় উঠে এসেছে অনেক ভাবনা, অনেক কিছু। ভালো লাগলো। 

    • - কেতন শেখ

      অসংখ্য ধন্যবাদ যূথী, শুভেচ্ছা রইলো।