Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

হরি দাস পাল

৮ বছর আগে

হাতেম আলীর জীবন(প্রতিযোগীতা/২০১৬, ক্যাটাগরি২)

মেহের চত্বরে কয়েকজন লোক রিক্সার জন্যে দাড়িয়ে আছে। হাতেম আলী খালি যাচ্ছে দেখে একজন উঁচু গলায় ডাক দিল, ওই খালি! হাতেম আলীর এখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। না খেয়ে সে আর রিক্সা চালাতে পারবেনা। নতুন কলা ভবনের সামনে এসে আর একজন ডাক দিল। একটি মেয়ে। হাতেম আলী রিক্সা স্লো করে বল্লো, কই যাইবেন? মেয়েটি হাত দিয়ে তার সামনের কিছু চুল এপাশ থেকে ওপাশ দিয়ে বল্লো, প্রীতিলতা হল। হাতেম আলীর না খেয়ে আর খেপ টানার ইচ্ছা, এবং শক্তি কিছুই ছিলনা। তবুও এই মেয়েটিকে সে না করতে পারলো না। রিক্সার হ্যান্ডেল ঘোরাতে ঘোরাতে সে আড়চোখে মেয়েটির দিকে আর একবার তাকালো। এই মেয়েটির চেহারার সাথে তার নিজের মেয়েটির চেহারার আশ্চর্য মিল খুঁজে পেল হাতেম আলী।
হাতেম আলী উত্তর বঙ্গের লোক। আষাঢ় শ্রাবন মাসে ধান লাগানো হয়ে গেলে হাতে আর তেমন কোন কাজ থাকেনা। ধান কাটা হবে সেই কার্তিক অগ্রহায়ন মাসে। এই সময়টা বসে না থেকে ঢাকায় এসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রিক্সা চালায় হাতেম আলী। নিজের থাকা খাওয়া বাদে দৈনিক দু’শ থেকে আড়াই’শ টাকা সঞ্চয় হয়। মাস শেষে যা জমে তাই নিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসে সে। সে সময় বাড়িতে ভাল বাজার আসে, ছেলেপুলেরা মন ভরে খায়, বউয়ের জন্যে তাঁতের শাড়ি, ছেলেদের জন্যে নতুন প্যান্ট, কখনো মেয়েটার জন্যে এক গোছা কাচের চুড়ি কিনে বাড়িতে যায় হাতেম। দুই ছেলে এক মেয়ে হাতেম আলীর সংসারে। মেয়েটি সবার বড়। এবছর নবম শ্রেনীতে উঠলো। মেয়েটি লেখা পড়ায় ভাল। মেয়েকে নিয়ে মনে মনে একটি বিরাট স্বপ্ন দেখে হাতেম আলী। তার মেয়ে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে রিক্সায় বসে থাকা ওই মেয়েটির মতো।
গতবার বাড়ি থেকে আসার সময় নতুন জামা আর জুতোর আবদার করেছিল তার মেয়ে। এবার বাড়ি গিয়ে হাতেম মেয়ের আবদার পুরন করবে। সাথে কাঁধে ঝোলানোর একটা লাল ব্যাগও কিনে দিবে। ছোট ছেলেটার শরীর খারাপ অনেকদিন ধরে। ওকে এবার ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে। সেইজন্যে অতিরিক্ত পরিশ্রম করেছে হাতেম। এক মাস তেরদিন হয়ে গেল সে বাড়িতে যায়নি। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত রিক্সার প্যাডেল ঠেলেছে। অতিরিক্ত একটি পয়সাও খরচ করেনি। মাঝে একবার জ্বর হয়েছিল। হাতেম একটি পয়সার ঔষধ কিনে খায়নি। যার ফলে অন্যান্য বারের তুলনায় এবার টাকা জমেছে একটু বেশি। ট্রাংকে তুলে রাখা টাকার পরিমানটা মনে মনে উচ্চারণ করে হাতেম, বার হাজার, তিন’শ, সত্তর ট্যাকা। এবার বাড়ি গেলে ছেলে মেয়েরা খুব খুশি হবে। ওদের হাসিমুখগুলোর কথা মনে করে হাতেমের শরীর থেকে পরিশ্রমের কষ্ট মুছে যায়। গুনগুন করে একটা গান ধরে হাতেম। রিক্সায় বসে থাকা মেয়েটির বোধহয় একটু তাড়া ছিল। সে খানিকটা বিরক্ত গলায় বল্লো, মামা! একটু জোরে চালান নাহ!
দৈনিক থাকা-খাওয়া বাবদ এক’শ বিশ টাকায় একটি মেসে থাকে হাতেম। টিনের ছোট্ট ছোট্ট ঘর। চৌকির উপর একথালা ভাত, ভাতের উপর করল্লা ভাজি আর বাটিতে পাঙ্গাস মাছের ঝোল। হাত-মুখ ধুয়ে গো গ্রাসে তাই খেয়ে নিল হাতেম। খাওয়ার পরে শরীরটা কেমন এলিয়ে পড়তে চায়। ঘুমে চোখ বুজে আসে। হাতেম ঘুমাতে চায় না। পরশু বাড়ি যাবে সে। তখন দু-তিন দিন যত খুশি ঘুমানো যাবে। এই দুটো দিন আর একটু পরিশ্রম করলে ক্ষতি নেই। ঘর ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে একটি খুটিতে হেলান দিয়ে বসলো হাতেম। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দু’শ নব্বই টাকা রোজগার হয়েছে। এই কয়দিন রোজগার খুব ভাল হচ্ছে। নব্বই টাকা নিজের পকেটে রেখে বাকি দু’শ টাকা ট্রাংকে রাখার জন্য ঘরে ঢুকলো হাতেম। চৌকির নিচ থেকে ট্রাংক’টা টেনে বের করতেই হাতেমের বুকের মধ্যে যেন বোমা ফেটে উঠলো। ট্রাংকের তালা খোলা কেন? তার টাকা? পাগলের মতো ট্রাংকের এমাথা থেকে ওমাথা খুঁজেও একটি টাকার হদিস মিল্লনা। তার দিন রাত এত পরিশ্রমের টাকা! এত প্রয়োজনের টাকা! তখন হাতেমের মনে হল ইসমাইলের কথা, ইসমাইল কই? ওপাশের চৌকিটা ফাঁকা সে আগেই খেয়াল করেছে। কিন্তু এই সময়ে ইসমাইলের তো ঘরে থাকার কথা।
ইসমাইল মেসে উঠেছে এই মাসেই। হাতেম’ই তাকে নিয়ে এসেছিল এখানে। একদিন সন্ধ্যায় ইসমাইলের সাথে হাতেমের পরিচয়। ইসমাইল বলেছিল সে গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছে। ঢাকায় নতুন। আপাতত তার এক দূরসম্পর্কের ভাইয়ের সাথে আছে। কিন্তু ভাইয়ের সাথে বউ বাচ্ছা আছে, তাই নিজের জন্য আলাদা একটা জায়গা না হলে আর হচ্ছেনা। সব শুনে হাতেমের মনে দয়া হয়। তাছাড়া তার নিজের ঘরেই একটা সিট খালি ছিল অনেকদিন ধরেই। হাতেম সেখানেই ওঠায় ইসমাইলকে। কিন্তু শেষের দিকে ইসমাইলকে একটু সন্দেহজনক’ই মনে হয়েছিল। সারাদিন শুয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করলে বলতো, শরীর খারাপ তাই গার্মেন্টস থেকে ছুটি নিয়েছে। কোন গারমেন্টস তাকে এতদিন ছুটি দিল? গভীর সংশয় ঘনীভূত হয়ে পাক খেতে থাকে হাতেমের মনে। ট্রাংকের তালাটা হাতে নিয়ে ভাল করে দেখলো হাতেম। না, তালা খোলা নয়; ভাঙা। কেউ তালা ভেঙে তার টাকা চুড়ি করে নিয়ে গেছে। সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন ঠেকে হাতেমের কাছে। সে গুঙিয়ে উঠে বার বার বলে ওঠে, ইসমাইল! ইসমাইল!......ইসমাইল!
হাতেমের গোঙানি শুনে আশ-পাশ থেকে দু’একজন যারা দুপুরে খেতে এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলো তারা ছুটে আসে। হাতেমের নাম্বারে বারবার ফোন দেওয়া হয়, সংযোগ পাওয়া যায়না। কেউ একটু শান্তনা দিল, কেউ অপরিচিত একজনকে বিশ্বাস করার জন্য তিরষ্কার করলো, তারপর যে যার কাজে চলে গেল। পরে রইলো শুধু হাতেম আর হাতেমের ভাঙা ট্রাঙ্ক। কি করবে কিছু ভেবে পায়না হাতেম। হঠাত তার মনে হল পরশুদিন বাড়ি যাওয়ার কথা। মেয়ের নতুন জামা কিনতে হবে, ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে হবে। দিশাহীনভাবে কিছুক্ষন ছুটাছুটি করে হাতেম বুঝতে পারলো কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়। সে আবার রিক্সা নিয়ে বের হল। দ্রুত প্যাডাল ঘোরাতে চায় সে, আরো দ্রুত। যেন এই দেড় মাসের ক্ষতি এক দিনেই উঠিয়ে নেবে সে। একটার পর একটা ক্ষ্যাপ নিয়ে পাগলের মতো ছুটে যায় হাতেম আলীর রিক্সা।ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে আসে। প্যাডেলে পা পড়তে চায়না ঠিক মতো। তবুও থামেনা হাতেম আলীর রিক্সার চাকা। তাকে টাকা উপার্জন করে বাড়ি ফিরতে হবে। ছেলেপুলেদের নিয়ে বাজারে যেতে হবে, মেয়ের জন্য নতুন জামা কিনতে হবে, বউয়ের পরনের শাড়িটাও কেমন মলিন হয়ে গেছে, ছোট ছেলেটাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। সবকিছুর জন্য টাকা চাই, টাকা। অনেক টাকা! কিন্তু হাতেম আলীর পকেটে পড়ে আছে মোটে সাড়ে তিন’শ টাকা। যা দিয়ে তার বাড়ি যাওয়ার গাড়ি ভাড়ার টাকাটাও হবেনা।
জীবন নামের এক কঠিন যুদ্ধক্ষেত্রে হাতেম আলী এক নীরিহ যোদ্ধা। জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সে। রিক্সার চাকা ঘুরছে। হাতেম আলীর জীবনি শক্তি ফুরাচ্ছে। ফিকে হয়ে যাচ্ছে দু’চোখের স্বপ্ন। রিক্সার চাকা ঘুরছে। হাতেম আলী বুঝতে পারে তার প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। বুঝতে পেরে সে আরো মরিয়া হয়ে ওঠে। রিক্সার চাকা ঘোরে। হাতেম আলী জন্মের পাপ শুধরায়। ভয় হয় হাতেম আলীর। খুব ভয় হয়।
হাতেম আলী জানে এই কঠিন সময়ে তার পাশে দাড়ানোর কেউ নেই। সে একা। বিদ্যুতের তারে ঝুলে থাকা মৃত বাদুরটার মতো একা। সময় গড়ায়, গড়ায় হাতেম আলীর রিক্সার চাকা।
০ Likes ০ Comments ০ Share ৩৭৬ Views