আখড়াই গান
আখড়াই গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি আঞ্চলিক শ্রেণীর গান। ধারণা করা হয়ে থাকে যে, এই গানটির উৎপত্তি বৈষ্ণবদের আখড়ায় হওয়াতে একে "আখড়াই গান" বলা হয়। এটি কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সমূহে প্রচলিত ছিলো; তবে এদের মধ্যে শান্তিপুর ও চুঁচুড়াই প্রধান। এতে ‘খেউড়’ ও ‘প্রভাতি’ পর্যায় দুটি থাকায় এটিকে কবিগানের পূর্বরূপগুলোর একটি বলে মনে করা হয়। মহারাজ নবকৃষ্ণ দেবের সভাগায়ক কলুই চন্দ্র সেন এই গানের উদ্ভাবক বলে মনে করা হয়। রামনিধি গুপ্ত যিনি “নিধু বাবু” নামে সমধিক পরিচিত, তিনি আখড়াই গানের শ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন।
কবিগান
কবিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। গাযককে কবি হতে হয়। তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে গেয়ে থাকেন। কবিগান পরিবেশনকারীদের বলা হয় কবিয়াল। কবিগান সাধারণত দুটি দলের দ্বারা গীত হয়। প্রত্যেকটি দলের নেতৃত্বে থাকেন একজন "কবিয়াল" বা "সরকার"। তাঁর সহকারী গায়কদের বলা হয় "দোহার"। এঁরা সাধারণত নেতার কথাগুলিই পুণরাবৃত্তি করেন। কবিগান শুরু হয় "বন্দনা" বা "গুরুদেবের গীত"-এর মাধ্যমে। "বন্দনা" অংশটি সরস্বতী, গণেশ, জনতা ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। এটি কবিয়াল যেমন উপযুক্ত করেন, তেমনভাবে গান। এরপর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান গাওয়া হয়। এটিকে কেউ কেউ "আগমনী" বলেন। এরপর চারটি বিষয়ভিত্তিক গান গাওয়া হয়ঃ "সখী সংবাদ", "বিরহ", "লহর" ও "খেউড়"। এরপর প্রতিযোগিতামূলক অংশটি শুরু হয়। কবিগানের আসরে এই অংশটিকে "কবির লড়াই"-ও বলা হয়। এই অংশে একজন গীতিকার-সুরকার মুখে মুখে গান বেঁধে অপর গীতিকার-সুরকারকে আক্রমণ করেন এবং তিনিও গানের মাধ্যমে সেই আক্রমণের প্রত্যুত্তর দেন।
কীর্তন
কোন দেব-দেবীর নাম, গুণাবলী বা কীর্তিকাহিনী সম্বন্ধিত গান ।
গম্ভীরা
গম্ভীরা বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের অন্যতম ধারা। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। গম্ভীরা দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। এটি বর্ণনামূলক গান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অঞ্চলের গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি খুব জনপ্রিয়। সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম দেবতা শিব। শিবের অপর এক নাম‘গম্ভীর’। শিবের উৎসবে শিবের বন্দনা করে যে গান গাওয়া হত- সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায়‘গম্ভীরা’। শিব> গম্ভীর> গম্ভীরা। পরবর্তী সময়ে গম্ভীরা গানের ধরন যায় বদলে। গানের সুরে দেবদেবীকে সম্বোধন করে বলা হয় গ্রামীণ দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের সুখ-দুঃখ। কখনও সারা বছরের প্রধান ঘটনা এ গানের মাধ্যমে আলোচিত হত। পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্য তুলে ধরা হত। চৈত্র-সংক্রান্তিতে বছরের সালতামামি উপলক্ষে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হত।
ঘাটু গান
ঘাটু গান বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চলের একটি বিলুপ্ত প্রায় পল্লী সংগীত বিশেষ। ঘাটে নৌকা ভিরিয়ে এই গান গওয়া হয় বলে একে ঘাটু গান বলে। অঞ্চলভেদে ‘ঘাটু’ শব্দটির উচ্চারণগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়; এই শব্দটি "ঘাঁটু", "ঘেটু", "ঘেঁটু", "গেন্টু", "ঘাডু", "গাড়ু", "গাঁটু", "গাডু" প্রভৃতি বলা হয়। যেমন: নেত্রকোনা অঞ্চলে এটি ‘গাডু’ নামেই পরিচিত, তবে শিক্ষিতজনরা ‘ঘাটু’ বলেন; আবার, সুনামগঞ্জ অঞ্চলে একে ‘ঘাডু’ বলে।
জারি গান
জারি গান বাংলাদেশের এক প্রকারের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতরীতি। ফার্সি জারি শব্দের অর্থ শোক। মুহাররম মাসে কারবালার বিয়োগান্তক কাহিনীর স্মরণে মূলত এই গানের উদ্ভব। ১৭শ শতক থেকে বাংলায় এই গানের ধারা শুরু হয়।
টপ্পা গান
টপ্পা গান কলকাতা অঞ্চলের একটি লৌকিক গান। এটি পাঞ্জাব অঞ্চলের মূল গানের সাথে মিল থাকলেও বাংলায় এটি রাগাশ্রয়ী গান হিসেবে পরিচিত। রামনিধি গুপ্ত (নিধু বাবু) এর উদ্ভাবক বলে পরিচিত।
ধামাইল গান
ধামাইল গান সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত একজাতীয় কাহিনী সম্বলিত নৃত্য যা এই অঞ্চলের লোকসাহিত্যের একটি অংশ। যে কোন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেই এই গীত-নৃত্য পরিবেশনা স্বাভাবিক বিষয় হলেও বর্তমানে সাধারণতঃ সনাতন ধর্মীদের বিয়ের অনুষ্ঠানেই এর অধিক প্রচলন দেখা যায়। রাধারমণ দত্ত কর্তৃক এই গান সর্বাধিক প্রচারিত ও প্রচলিত হওয়ায় তাঁকেই এর স্রষ্টা বলে গণ্য করা হয়।
পাঁচালি গান
পাঁচালি গান বাংলার প্রাচীন লৌকিক সংগীতগুলোর অন্যতম। এই গান প্রধাণতঃ সনাতন ধর্মীদের বিবিন্ন আখ্যান বিষয়ক বিষয়বস্তু সম্বলিত ও তাদের তুষ্টির জন্য পরিবেশিত হয়। লক্ষীকান্ত বিশ্বাস কর্তৃক এই গান সর্বাপ্রথম প্রচলিত হওয়ায় তাঁকেই এর স্রষ্টা বলে গণ্য করা হয়।
বাউল গান
মূলতঃ বাউল সম্প্রদায়ের গানই হচ্ছে বাউল গান। বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ। বাউলরা তদের দর্শন ও মতামত বাউল গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে থাকে। বাউল মত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালন সাঁইয়েরগানের জন্য ঊনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনিই শ্রেষ্ঠ বাউল গান রচয়িতা। ধারণা করা হয় তিনি প্রায় দু'হাজারের মত গান বেধেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বাউল গান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন যা তার রচনাতে লক্ষ করা যায়। ইউনেস্কো ২০০৫ সালে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষনা করে।
ভাওয়াইয়া
ভাওয়াইয়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত এক প্রকার পল্লীগীতি। মূলত রংপুর এলাকার প্রত্যন্ত জনপদে এ গানের সৃষ্টি ও চর্চা রয়েছে। এসকল গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ গানগুলোতে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে। যেমনঃ গরুর গাড়ি চালক বা গাড়িয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলছে -
“ | ওকি গাড়িয়াল ভাই, আস্তে বোলাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিবার নাও মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল। | ” |
আবার রংপুরের ঐতিহ্যবাহী চিড়িয়াখানা নিয়েঃ
“ | নিয়া ভাই একনা কতা কবার চাও, অংপুর মুই যাবার চাও, চিড়িয়াখানা দেখিয়া আনু হয়। | ” |
ভাটিয়ালী
ভাটিয়ালী বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান। বিশেষ করে নদ-নদী পূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালী গানের মূল সৃষ্টি, চর্চাস্থল এবং সেখানে এ গানের ব্যপক প্রভাব রয়েছে। বাউলদের মতে ভাটিয়ালী গান হলো তাদের প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান। ভাটিয়ালী গানের মূল বৈশিষ্টা হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ নারীর প্রেমপ্রীতি, ভালবাসা, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলন। যেমন -
“ | আষাড় মাসে ভাসা পানি পূবালি বাতাসে, বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি, আমার নি কেউ আসে। | ” |
কিংবা,
“ | নাই বাইয়া যাও ভাটিয়ালী নাইয়া ভাটিয়ালী নদী দিয়া আমার বন্ধুর খবর কইয়ো আমি যাইতেছি মরিয়া। |
মাইজভান্ডারী গান
মাইজভান্ডারী গান মাইজভান্ডারী ধারার অনুসারীদের গাওয়া মরমী গান। এ ধারার প্রবর্তক সৈয়দ আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী। একশ বছরের ও আগে চট্টগ্রাম জেলারফটিকছড়ি উপজেলায় এ ধারার উদ্ভব হয়। আজ পর্য্যন্ত শতাধিক ভক্ত কবি হাজারের ও বেশি গান রচনা করেছেন। রমেশ শীল, আবদুল হাদি, বজলুল করিম, মাহাবুব উল আলম (সাহিত্যিক) প্রমুখ মাইজভান্ডারী গান রচনা করে সুনাম অর্জন করেন।
মারফতী
মারফতী শব্দটি এসেছে মা'রাফত শব্দ থেকে। মা'রাফত অর্থ খোদা তায়ালা সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান।যে সব সাধক বা ফকির আত্ম তত্ত্বের উপলব্ধি দ্বারা খোদার আনন্দ ময় সত্তার অনুভূতি লাভ করে তাদের মারফতী ফকির বলা হয়। এসব গানের মূল উপাদান রহস্যবাদ। তবে কিছু কিছু মারফতী গানে রহস্যবাদ একটু শিথিল।
Comments (2)
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা জানবেন ভালো থাকবেন। আপানার ঈদ হোক আনান্দের ও সুুখের। ঈদ মোবারক।