Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

মুখোশের ফেরীওয়ালা

৯ বছর আগে লিখেছেন

পুতুল খেলার ইতিকথা

মায়ের কারনে খুব ভোরেই ঘুম ভাঙ্গে মুনিয়ার। ঘুম থেকে উঠেই মা লেগে যান ভাত রাঁধতে, আর ও মাথার উপরে তেরপল গুটিয়ে রাখে। তাড়াহুড়ো করে খাওয়া দাওয়া সেরে মা বেড়িয়ে যায় কাজে, আর মুনিয়া ওর চটের ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভিক্ষা করতে। কিন্তু সবসময় ওদের অবস্থা এমন ছিল না মা প্রায়ই বলে। না দেখা বাবাকে নিয়ে অনেক গালমন্দও করে। কিন্তু একটু আড়াল হলেই দেখে মা কাঁদছে। ও বোঝে না, ঠিকমত জানেওনা বাবা কোথায়। শুধু জানে, ওর বাবা নাকি বড় মাছের ব্যাবসায়ী ছিল। ওদের নাকি পাকা বাড়িও ছিল। ও তখনও পৃথিবীর আলো দেখেনি। বাবা নাকি একরাত্রে কয়েকজন লোকের সাথে বাইরে গিয়ে আর ফেরেনি। বিকেল থেকেই চোখরাঙ্গানো মেঘদুত সেই রাত্রে কালবৈশাখের রুপ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। মা ওকে পেটে নিয়েই অনেক দৌড়াদৌড়ি করেও কোন খোঁজ পায় না। ওর জন্মের পরে মা আর খোজেননি। তখন তিনি প্রায় নিঃস্ব, বেচে থাকার তাগিদে ভালবাসা আর খুজতে যাননি মা। আর এখন অবস্থার বিবর্তনে ঠাই হয়েছে পান্থকুঞ্জের ফুটপাত।

দুপুরের দিকে মানুষের দেয়া পাউরুটি আর কলা খেয়ে পার্কের মাঝেই বসে ব্যাগ থেকে ওর কাঠের বাক্সটা বের করে মুনিয়া। বাক্স খুলে একে একে বের করে তিনটা পুতুল আর রান্নাবাটি খেলার সরঞ্জাম। সবগুলোর মহিলার পোষাক পরা পুতুলকে রান্না করতে বসিয়ে পুতুল লোককে বাজার করতে পাঠায়। গাছ লতা পাতা ইটের গুঁড়ো কুড়িয়ে এনে রান্নাবাটি খেলতে থাকে আপন মনেই। নিজের দুপুরের সময়টা কেটে যায় কোনদিক দিয়ে ওর খেয়ালই থাকে না। আশে পাশে পার্কে বেড়ানো লোকগুলো মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে ওর খেলা। কেউ কেউ এসে কথাও বলে, জানতে চায় পুতুলগুলো কে। ও হেসে বলে বাবা-মা  আর আমি। জীবনের কষ্টটা এই সময় একটুও স্পর্শ করে ওকে। একদিকে মা বেচে থাকার দৌড়ে সব হারাচ্ছে, আরেকদিকে ও একে একে সাজিয়েই চলেছে ওর পুতুল সংসার। দুপুরের সুর্য্যটা পশ্চিমে ঢলে গেলেই ও ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়ে। হাতে পুতুল বাবাকে নিয়ে পার্কের গেট দিয়ে বেরিয়ে বাংলামোটোরের দিকে এগোতে থাকে।

বাংলা মোটর মোড়ে এসে দেখে অনেক মানুষ জটলে করে আছে। পুলিশের গাড়ীও দেখা যায় একটা। গম্ভীর মুখে ওয়াকিটকিতে অনবরত কথা বলে চলেছে। ও পুলিশের চোখ এড়িয়ে মানুষের জটলায় গুঁতো-গাতা এগোতে থাকে। অনেক কষ্টে ঢুকতেই দেখে কেন্দ্রে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ রক্তের জটলার মাঝে শুয়ে আছে। চোখদুটো খোলা, আর চিরে দেওয়া গলা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ও সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। হঠাত দুইবছরের এক বাচ্চার কান্নার আওয়াজ কানে যেতেই খুজতে থাকে। এর মাঝেই এম্বুলেন্সের লোক এসে ডেডবডি সরাতে গেলেই হঠাত কিছুটা রক্ত ফিনকি দিয়ে ওর জামায় পড়েচমকে সরে গিয়ে বাচ্চাটাকে খুজতে থাকে। বাচ্চাটাকে দেখে হাত ধরে জটলা থেকে বের করে নিয়ে আসে। আশে পাশের সবাই উত্তেজনায় খেয়াল করে না ওদের দুজনকে। ভীড় থেকে বের হয়েই মুনিয়া জামা দিয়ে ছেলেটার চোখ মুছিয়ে দেয়। ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ছেলেটি কান্না থামিয়ে, ঘটনার আকস্মিকতা থেকে আস্তে স্তে বেরিয়ে এসে ধাতস্ত হয়। হঠাত কেউ চিতকার দিলে ও চমকে দৌড়ানো শুরু করে। ওকে দৌড়াতে দেখে, বাচ্চাটাও ওর পেছনে দৌড়ানো শুরু করে। পেছনে কে আসছে না আসছে সেদিকে একটুও খেয়াল করে না। পার্কের ভেতরে ঢুকতেই ও বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে। ওর পাশে ছেলেটিকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে লোকটা কে ছিল। ছেলেটি মাথা নিচু করে শুধু একটাই শব্দ উচ্চারন করে, “বাবা”। মুনিয়ে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর হাত ধরে এগতে থাকে বাড়ির দিকে। হঠাত ছেলেটি জিজ্ঞেস করে পুলের গায়ে কি লেগে আছে। ও পুতুলটা সামনে আনতেই দেখে কিছুটা রক্ত ওর পুতুল বাবার গায়ে লেগে আছে। ও কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর কিছু না বলে ছেলেটির হাত ধরে এগোতে থাকে। আর মনে মনে বলে, মাকে আর কখনোই জিজ্ঞেস করবে না ওর বাবা কোথায়।

কয়েকদিন পরে, একই পার্কে বসে রান্নাবাটি খেলতে থাকে মুনিয়া। সেদিনের ঘটনা কিছুই হয়তো মনে নাই। তবে ওর পুতুল পরিবারে নতুন একটা পুতুল যোগ হয়েছে। ও সবকিছু সাজানোর মাঝেই পেছন থেকে, “বুবু” ডাক শুনে তাকিয়ে দেখে, সেইদিনের ছেলেটা লতা-পাতা হাতে নিয়ে আসছে। ও হেসে তাড়াতাড়ি আসতে বলে। ছেলেটি দৌড়ে আসতেই দুজনে মিলে রান্নাবাটি খেলায় ডুবে যায়। পাশ দিয়ে চলমান মানুষগুলো দেখতে থাকে ওদের খেলা। 

Likes Comments
০ Share