বাংলাদেশের মানচিত্র দেখার সময়ে খেয়াল করেছেন কি, একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ছোট্ট ছোট্ট দুটি বিন্দু? একেবারেই বেরসিক মানুষ না হলে আপনার জানার কথা যে ওটাই হল সেইন্ট মার্টিন’স আইল্যান্ড বা বাংলায় বলা “নারিকেল জিঞ্জিরা” ।
হুমায়ুন আহমেদের মতো সাহিত্য করে দারুচিনি দ্বীপ ও বলতে পারেন। তবে নামে কি আসে যায়? নাম পরিবর্তন করলেই কি এর মহিমা কমে যাবে? একটু ও না। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপের রূপে-গুণে মুগ্ধ পর্যটকের সংখ্যা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে।
কক্স’স বাজারে বেড়াতে আসা সমুদ্রপ্রেমীদের অনেকেরই পরবর্তী গন্তব্য হয়ে ওঠে সেইন্ট মার্টিন’স দ্বীপ। টেকনাফ থেকে ট্রলারে অথবা জাহাজে করে যেতে পারেন সেইন্ট মার্টিন’স এ। দ্বীপে পৌঁছানোর পর কোনও মোটরচালিত যানবাহনের দেখা পাওয়ার আশা করবেন না যেন! গুটিকয়েক রিকশাভ্যান ছাড়া আর কিছু নেই এখানে। হোটেলগুলোর নিজস্ব জেনারেটর ছাড়া কোনও বিদ্যুতের উৎস ও নেই এই দ্বীপে। সভ্যতার কোরাল গ্রাস থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে আপনি নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারবেন প্রকৃতির একেবারে কাছাকাছি।
১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই দ্বীপে শুধুমাত্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি ছিল। এর পর থেকে এখানে বসতি স্থাপনেরও অনুমতি দেওয়া হয়। বর্তমানে এখানে প্রায় ৭০০০ মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তাদের বেশিরভাগেরই পেশা হল মৎস্যশিকার। শৈবালের প্রাচুর্য থাকায় এগুলো রোদে শুকিয়ে মায়ানমারে রপ্তানি করেও জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন অনেকেই। এই দ্বীপে বসবাসকারীদের জীবন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বর্ষাকালে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মূল ভূখণ্ডে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব এবং এ সময়ে কেউ গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের জীবন বাঁচানোর কোনও উপায় থাকে না যেহেতু এই দ্বীপে নেই কোনও ডাক্তার।
পর্যটকদের জন্য এই দ্বীপটি আকর্ষণীয় মূলত এর অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে। যাত্রাপথ বেশ লম্বা এবং বিপদদঙ্কুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা হয় এখানে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি হলো এখানে বেড়াতে আসার সর্বোত্তম সময়। এ সময়টাতে সাগর থাকে তুলনামুলকভাবে শান্ত এবং ভ্রমণের আনন্দ ভালোভাবেই উপভোগ করতে পারবেন আপনি। তবে এ সময়টাতেই পর্যটকদের ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি তাই রাত কাটানোর পরিকল্পনা থাকলে অবশ্যই দ্বীপের কোনও একটি হোটেলের সাথে যোগাযোগ করে রিজার্ভেশন নিয়ে রাখবেন, নতুবা বিপদে পড়তে হতে পারে!
দ্বীপে পৌঁছে যাবার পর কি করবেন তা নিয়ে আপনাকে আর চিন্তা করতে হবে না। হোটেলে মালপত্র রেখে সোজা চলে যাবেন দ্বীপের চারপাশ ঘিরে থাকা, কেয়া গাছের প্রাচুর্যে পূর্ণ সৈকতে। সৈকতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রচুর প্রবালের টুকরো তাই পা থেকে স্যান্ডেল খুলবেন না, পা কেটে রক্তারক্তি হয়ে যাবে। দরকার হলে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল কিনে নিয়ে যেতে পারেন। সমুদ্রে পা ভেজাতে চাইলেও প্রবালের ব্যাপারে সাবধান থাকুন। আর এতেও যদি মন না ভরে তবে নৌকো ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারেন দ্বীপের চারিপাশে। ছেঁড়া দ্বীপেও পা রাখতে পারেন। দ্বীপ থেকে অনেকেই কুড়িয়ে নিয়ে যান প্রবালের টুকরো এমনকি কিনেও নিয়ে যান। এ কাজটি কিন্তু অনুচিত। সেইন্ট মার্টিন’স গড়েই উঠেছে প্রবালের ওপর ভিত্তি করে। আপনার মতো হাজার হাজার পর্যটক যদি একটা করেও প্রবালখণ্ড তুলে নিয়ে যান তবে হুমকির মুখে পড়বে এই ছোট্ট দ্বীপটি।
দিনের বেলায় যতটা না সুন্দর, রাতের বেলায় তার চাইতে অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর এই দ্বীপ। ঠিক সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের সময়ে চারদিক রঙের ছটায় ভরে যায়। আর সারাদিনের পর্যটকদের ভিড় ভাট্টা কমে এলে, রাত একটু গভীর হলেই দেখবেন নৈঃশব্দ্যের কি অপূর্ব মায়া! সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত আকাশে এত তারা আর কোথাও খুঁজে পাবেন না। মনে হবে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য এক জগতে এসে পড়েছেন আপনি।
আর সারাদিন ঘুরোঘুরি করে যদি খিদে পেয়ে যায় তবে চিন্তার কিছু নেই। এখানে সবগুলো হোটেলেই খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা আছে। সি-ফুডের স্বাদ নিতে চাইলে টাটকা মাছের বিভিন্ন পদ পাওয়া যায়। সাধারণ সব খাবারও পাবেন এখানে কারণ পর্যটকদের চাহিদা মেটাবার জন্য দ্বীপের বাইরে থেকে শাকসবজি, মাংস সবই নিয়ে আসা হয়।