চা বাগানের কথা উঠলেই মনে হয় সিলেট বা শ্রীমঙ্গলের কথা। উচু নিচু সবুজে ঘেরা টিলা আর পাহাড় তার গাঁয়ে সারি সারি চা গাছ। কিন্তু সমতল ভূমিতেও যে চা বাগান হতে পারে তা পঞ্চগড় না এলে বোঝা যাবে না। দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে গড়ে উঠেছে এমন অর্গানিক চায়ের প্রাণজুড়ানো সবুজ বাগান। এ দেশে অর্গানিক ও দার্জিলিং জাতের চায়ের চাষ হয় একমাত্র তেঁতুলিয়ার বাগানগুলোতেই। ইতিমধ্যে এ চা দেশের বাইরেও সুনাম অর্জন করেছে। পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়ার দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটারের মতো। পঞ্চগড়ের অধিকাংশ চা বাগান এই তেঁতুলিয়াতেই অবস্থিত। এখানকার চা বাগানের মধ্যে কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট, ডাহুক টি এস্টেট, স্যালিলেন টি এস্টেট, তেঁতুলিয়া টি কোম্পানী প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সমতল ভূমিতে সুন্দর পাকা রাস্তা। যতই এগুবেন সবুজ আপনাকে ক্রমেই মোহিত করতে থাকবে। সীমান্তের কাঁটাতারও যেন ঢাকা পড়েছে সবুজে। ওপার থেকে একটি খাল নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়েছে আমাদের সীমানার ভেতরে। খালটির দুই পাশের শস্যরাশি মায়া ছড়াচ্ছে। এ এক অন্য রকম ভালোলাগার রাজ্য।
রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ সবুজ। মুহূর্তেই যাবেন সবুজের সমারোহে। দলে দলে নারী কাঁধে সাদা ব্যাগ ঝুলিয়ে অবিরাম চা পাতা তুলছেন। নয়নাভিরাম দৃশ্য! এখানকার চা বাগান কিন্তু সিলেট বা চট্টগ্রামের মতো উঁচু-নিচু নয়, একেবারেই সমতল, দেখতেও অন্য রকম। রাস্তার দুই পাশে যেন সবুজ মখমলের চাদর বিছানো। বাগানের ধার ঘেঁষে অসংখ্য জারুলগাছে বেগুনি ফুল ফুটে আছে।
সন্ধ্যার পরে এসব চা বাগানের নেমে আসে ভিন্ন এক স্বগীর্য় সৌন্দর্য। আহামরি সে সুন্দর। সন্ধ্যার পরে যখন চাঁদ আসে তখন মনে হবে আপনি যেন ভেসে বেড়াচ্ছেন নীল পরীর দেশে। চা পাতায় চাঁদের আলো পড়ে সৃষ্টি হয় মায়াবী রূপ। জোনাকিরা বাগান সাজায় আপন মনে। মনে হবে এ যেন মর্তের বাহিরে অন্য কোন জায়গা, ভিন্ন কোন জগত। সত্যিই যেন রূপকথার দেশ। সময় করে ঘুরে আসুন, অবশ্যই ভাল লাগবে।
ইতিহাস
এ দেশে চা চাষ শুরু হয়েছিল ১৮৪০ সালে। সিলেটে নয়, চট্টগ্রামের ক্লাব প্রাঙ্গণে। সিলেটে উৎপাদন শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। আর পঞ্চগড়ে ১৯৯৮-তে, প্রায় ১৫০ বছর পর। পঞ্চগড়ের অধিকাংশ জমিই একসময় অলস পড়ে থাকত। সে সময় শিল্পপতি কাজী শাহেদ আহমদ পঞ্চগড় অঞ্চলের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ভারতের চা বাগান দেখে অনুপ্রাণিত হন। তিনি তেঁতুলিয়ায় কিছু জমি কিনে অর্গানিক পদ্ধতিতে চা চাষ শুরু করেন। এ অঞ্চলে চা চাষের ক্ষেত্রে কাজী টি এস্টেটই অগ্রপথিক।
পরবর্তী সময়ে তেঁতুলিয়া চা করপোরেশন লিমিটেড, স্যালিন্যাল টি এস্টেটসহ বহু প্রতিষ্ঠান এখানে চা চাষ শুরু করে। পঞ্চগড় জেলা পরিষদের তথ্যমতে, বর্তমানে পঞ্চগড়ে দুই শতাধিক বাগানে ২২৫৫ দশমিক ৫৪ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ২০০৯ সালে পঞ্চগড় থেকে উৎপাদিত হয়েছে ৬,৫৬,০২৪ কেজি মেড টি।
যেভাবে যেতে হবে
সড়ক পথই তেঁতুলিয়ার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম। ঢাকা থেকে পঞ্চগড়গামী দূরপাল্লার বাসে পঞ্চগড়ে এসে নামার পর তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধাগামী লোকাল বাসে ৪৫ টাকা ভাড়া দিয়ে এক ঘণ্টায় তেঁতুলিয়া পৌঁছানো যাবে। এখান থেকে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো কিংবা পিকনিক কর্নার ৫ টাকা রিকশা-ভ্যান ভাড়া এবং চা বাগান ও কমলা বাগান দেখার জন্য অতিরিক্ত ১৫০-২০০ টাকা যাতায়াত করা যাবে। এছাড়া বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর বাসযোগে ২০ টাকা এবং সেখান থেকে জিরোপয়েন্টে বিজিবির অনুমতি সাপেক্ষে ৩০-৫০ টাকায় ভ্যান-অটোরিকশা যোগে স্থলবন্দরে যাতায়াত করা যাবে।
কোথায় থাকবেন
তেঁতুলিয়ায় আবাসিক কোনো হোটেল না থাকায় জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে প্রাচীন কালে নির্মিত ডাকবাংলো এবং অন্য পাশে তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নার রাত যাপনের একমাত্র সম্বল। পাশে বনবিটের বাংলো থাকলেও নানামুখী সমস্যার কারণে তা ব্যবহৃত হচ্ছে না। রাত যাপনের জন্য পিকনিক কর্নারে প্রতি কক্ষ ২০০ টাকা এবং জেলা পরিষদ ডাকবাংলো ৪০০ টাকা দিতে হবে। এসব বাংলোয় রাত যাপন করতে হলে অফিস সময়ে জেলা পরিষদ সচিব, পঞ্চগড় কিংবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার তেঁতুলিয়ার কাছে আবেদন করে কয়েক দিন আগে বুকিং নিতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ সময় এ বাংলো দু’টি বুকিং থাকায় পর্যটকরা বেড়াতে এসে পড়েন বিপাকে। আগন্তুক পর্যটকদের রাত যাপনের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বুকিং না পাওয়ার কারণে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা সম্ভব হয় না। ফলে রাত যাপনের জন্য পর্যটকদের ফের ফিরে যেতে হয় পঞ্চগড় জেলা শহরের আবাসিক হোটেলে।