উত্তরের বাণিজ্যিক শহর সৈয়দপুর। নীলফামারী জেলার এ উপজেলা শহরটি বাঙালি-বিহারীর এক বৈচিত্র্যময় শহর। স্বাধীনতার পর থেকেই এই শহরে প্রচার-প্রচারণায় বাংলার পাশাপাশি উর্দু চলে। এই নীলফামারী-৪ আসনের সংসদ নির্বাচন ও পৌরসভার নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ভর করে অবাঙালি ভোটারদের ওপর।
প্রচলিত প্রবাদ আছে— রঙের রংপুর শখের সৈয়দপুর। এক সময়কার সিটি শহর সৈয়দপুরে রয়েছে অনেক দর্শনীয় ও ব্রিটিশ আমলের তৈরি বেশ কিছু অবকাঠামো। এখানে রয়েছে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা, বিমানবন্দর, সেনানিবাস, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের এসপি অফিস, রেলওয়ের বিভাগীয় হাসপাতাল, ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদ, দর্শনীয় গির্জা, মুর্তজা ইন্সটিটিউট, বিশ্বের অন্যতম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল, হরেক রকম কুটির শিল্প, জুট মিল, বেনারসি পল্লী, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস, সৈয়দপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাব, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক শতবছরের পুরাতন শিল্প-সাহিত্য সংসদ অন্যতম। পাশাপাশি দেখা যাবে বাস-ট্রাকের পরিত্যক্ত টায়ার জ্বালিয়ে জ্বালানি তেল তৈরি, এর একপাশে তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের নোহা প্রেসার কুকার, ননস্টিক প্যান, ওভেন ও অন্যান্য তৈজসপত্র। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে পাশের ভারত, নেপাল ও ভুটানে রফতানি করা হচ্ছে। সৈয়দপুর প্লাজার দোতলায় তৈরি হচ্ছে পরচুলা ও শহরের বাঙালিপুরে হচ্ছে জুতার চামড়ায় নকশা। যাচ্ছে বিদেশের বিভিন্ন দেশে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন কয়েকশ’ নারী শ্রমিক।
রেলওয়ে কারখানা : দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা এখানে অবস্থিত । ১৮৭০ সালে ১শ’ ১০ একর জমির ওপর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ কারখানার ২৬টি শপে শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন। নাট-বল্টু থেকে শুরু করে রেলওয়ের ব্রডগেজ ও মিটারগেজ লাইনের বগি মেরামতসহ সব কাজ করা হয়। পলিটেকনিক ও কারিগরি শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা সফর বা পরিদর্শন করে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করেন। এ কারখানার প্রধান হলেন বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। তারই অফিসের সামনে সবুজ চত্বরে রাখা আছে ব্রিটিশ আমলের ন্যারোগেজ ইঞ্জিন। ৭২ সালে সর্বশেষ ইঞ্জিনটি চলতো বাগেরহাট-রূপসা সেকশনে। ১৯০১ সালে ইংল্যান্ডের ভলকান কোম্পানির তৈরি এই ইঞ্জিনটিসহ এ ধরনের ৩টি ইঞ্জিনের ঠাঁই হয়েছে এখন সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার লোকো ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়ামে। কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই ইঞ্জিনগুলো। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে নতুন প্রজন্মের অনেকে আসে স্বচোখে দেখতে একনজর এই কয়লার ইঞ্জিন।
চিনি মসজিদ : সৈয়দপুর শহরের গোলাহাটে শতাব্দীর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মসজিদটির নির্মাণ কারুকাজ ও মনোরম সৌন্দর্য দেখে ইসলাম ধর্ম অনুসারী মানুষের প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এ সময় এক আধ্যাত্মিক অনুভূতির সৃষ্টি হয় মানুষের মনে। এলাকার বাসিন্দা হাজী বকর আলী ও হাজী ময়খু মহলাবাসীকে ডেকে ৬ জন সর্দার নির্বাচন করে প্রতিঘর থেকে দৈনিক এক মুঠো চাল সংগ্রহ করার নির্দেশ দিলেন। সংগৃহীত চাল বিক্রি করে জমাকৃত টাকা দিয়ে এক সময় মসজিদটি দালানে পরিণত হয়। মসজিদটি নির্মাণ করেন শইখ নামের হিন্দু মিস্ত্রী। সে সময় কোনো সিমেন্ট ছিল না। তাই চুন ও সুরকি দিয়ে গাঁথুনি দেয়া হয়। মহল্লার মহিলারা ঢেঁকি কুটে সুরকি তৈরি করতেন। মহল্লার কিছু লোক কলকাতা বেড়াতে গিয়েছিলেন। তারা সেখানে দেখলেন চীনা কোম্পানির চিনামাটির তৈরি প্লেটের টুকরা পড়ে আছে। কোম্পানির অনুমতি সাপেক্ষে তারা সেগুলো নিয়ে আসেন এবং ওই মিস্ত্রীর সহায়তায় মসজিদের দেয়ালে লাগান। মসজিদেও প্রথম ভাগটির মেঝেতে লাগানো মর্মর পাথর কলকাতার কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এখানে এসে পাথরগুলো বসিয়ে যান। মসজিদে ও দেয়ালে লাগানো চিনামাটির টুকরার প্রতি খেয়াল রেখে এর নামকরণ করা হয় চিনি মসজিদ। চিনি মসজিদের গোটা অবয়ব উজ্জ্বল রঙিন চীনা পাথর দ্বারা আবৃত। অত্যন্ত নয়নাভিরাম এ মসজিদে ৩২টি মিনার ও ৫টি গম্বুজ রয়েছে।
খ্রিস্টান কবরস্থান : চিনি মসজিদের দেয়াল ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে এই অঞ্চলের সর্ববৃহত্ খ্রিস্টান কবরস্থান। সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য নজির। রেলওয়ে কারখানা স্থাপনের পরপরই করা হয়। ব্রিটিশ সরকার রেলওয়ে কারখানা স্থাপন করার সুবাদে এখানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে ব্যাপক হারে।
দর্শনীয় গির্জা : উত্তরের ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র সৈয়দপুর শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল ব্রিটিশ কোম্পানি শাসনামলে। সেসময়ে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সৈয়দপুর ছিল একটি ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন। রেলওয়ে কারখানা স্থাপনে ব্রিটিশরা বিবেচনায় নিয়েছিল এর অবস্থান, জলবায়ু ও পরিবেশগত অবস্থান। এ কারখানায় বাঙালি-বিহারির সঙ্গে কাজ করত বহু ব্রিটিশসহ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান। এদের বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হয় বেশ কটি আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে সাব-অর্ডিনেট কলোনি, সাহেবপাড়া ও অফিসার্স ক্লাব অন্যতম। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তাদের ধর্মীয় উপাসনার জন্য ব্রিটিশ সরকার সাহেবপাড়ার দু’প্রান্তে দুটি গির্জা নির্মাণ করে। এর একটি ছিল রোমান ক্যাথলিক ও অপরটি প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের। এছাড়াও এখানে সেন্ট জোরোজা নামে একটি স্কুল রয়েছে।
মুর্তজা ইন্সটিটিউট : সৈয়দ বংশীয় ইসলামি চিন্তাবিদ ও ধর্মপ্রচারকের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে সৈয়দপুর। বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানার কর্মকর্তারা সেসময় বেশিরভাগই ছিলেন ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের। কুলি-মজুরসহ নিম্ন শ্রেণীর পদে কর্মরত ছিল অবিভক্ত ভারতীয়রা। রেলওয়ে কারখানা ছাড়াও ভারতের দার্জিলিং, জলপাইগুঁড়ি, হলদিবাড়ি, শিলিগুঁড়ি এবং দেশের খুলনা পর্যন্ত সরাসরি চলাচলরত বিদেশি সাহেব ও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে চিত্তবিনোদনের জন্য ১৮৭০ সালেই নির্মাণ করে ‘দ্য ইউরোপিয়ান ক্লাব’। পরবর্তীতে নিয়ম-কানুন শিথিল করায় ভারতীয়রা সদস্যপদ লাভের সুযোগ পায়। পরবর্তীতে দ্য ইউরোপিয়ান ক্লাব নাম পরিবর্তন করে বিআরসিং ক্লাব করা হয়। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার পর ইন্সটিটিউটের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি ও তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় মুর্তজা ইন্সটিটিউট।
বেনারসি ও কারুপণ্য : সৈয়দপুরে রয়েছে সম্ভাবনাময় বেনারসি শিল্প। শহরের গোলাহাট, কাজীহাট, হাতিখানাসহ বেশ কিছু এলাকায় গড়ে উঠেছে বেনারসি শিল্প। সেখানে কারিগরদের নিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে বেনারসি শাড়ি। মনকাড়া ডিজাইনের এসব বেনারসি তৈরি হয়ে চলে যাচ্ছে ঢাকার বড় শপিং মলসহ মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে।
বিমানবন্দর ও সেনানিবাস : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে পাক সেনারা স্থানীয় বাঙালিদের আটকিয়ে নির্যাতন করে সৈয়দপুর বিমাবন্দরের মাটি ভরাটসহ প্রাথমিক কাজ করে নেয়। পরবর্তীতে সরকার এটির অবকাঠামো নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করে বিমান চলাচলের উপযোগী করে তোলে। প্রথম অবস্থায় বাংলাদেশ বিমান চলাচল করলেও পরে বন্ধ হয়ে যায় এবং বর্তমানে বেসরকারি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বিমান সপ্তাহে চার দিন চলাচল করছে।