দেখে মনে হতে পারে কোন জলপ্রপাত। প্রায় ১০ ফুট উঁচু হাওয়ায় ফুলানো রাবারের বেলুনের উপর দিয়ে প্রচন্ড গর্জন ও তীব্র বেগে আছড়ে পড়ছে জলধারা।
জলপ্রপাত যারা দেখেননি, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর এর কাঁকড়া নদীতে সেচ কাজে নির্মিত রাবার ড্যামের অবিরাম জলবর্ষনকে তারা জলপ্রপাত মনে করতে পারেন। এই রাবার ড্যাম প্রকল্প শুস্ক নদীর দু’কূলের প্রায় ৫ হাজার কৃষক পরিবারের ৫০ হাজার মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে, পাশাপাশি কর্মসংস্থান হয়েছে আরো ১০ হাজার মানুষের।
জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এলাকায় এনেছে নান্দনিক সৌন্দর্য। যা কেও দেখে হয়ত মনে মনে দেশাত্মকবোধক গানের দু/এক কলি গুন গুন করে উঠবেন।
যদিও কৃষকদের চাষাবাদের বিষয়টি চিন্তা করে ২০০১ সালে কাঁকড়া নদীর উপরে দিনাজপুর এলজিইডি ৮ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৩০ ফুট দীর্ঘ রাবার ড্যামটি নির্মান করে। এই রাবার ড্যাম নির্মানের ফলে চিরিরবন্দর উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আত্রাই ও কাঁকড়া নদীর ১০ কিলোমিটার এবং পাশ্ববর্তী ১২ কিলোমিটার কয়েকটি শাখা খাল বছরের পুরো সময় পানিতে ভর্তি থাকে। ২ হাজার ২০৫ হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। কুশলপুর, খোচনা, পশ্চিম সাইতাড়া, দক্ষিণ পলাশবাড়ী, উত্তর ভোলানাথপুর, আন্দারমুহা, অমরপুর, ভিয়াইল, কালিগঞ্জ, তালপুকুর, পুনট্টি, উচিতপুর, তুলসীপুর, নারায়নপুর ও গোবিন্দপুর গ্রামের ৪ হাজার ৯৫০ জন কৃষক ড্যামের পানি তাদের জমিতে সেচ কাজে ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এ অঞ্চলের জমি উর্বরা হওয়া সত্বেও সেচের অভাবে অনাবাদি ছিল। রাবার ড্যাম নির্মিত হওয়ায় এখন নিয়মিত ৪টি ফসল হচ্ছে। আমন, ইরি, আলু, সরিষা, ভুট্টা, গমসহ অন্যান্য ফসলের চাষ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। নদী ও খাল থেকে পানি তুলে কৃষকেরা অনায়াসে জমিতে সেচ দিচ্ছেন। আগে এক বিঘা জমিতে ১৫ থেকে ২০ মন ধান উৎপন্ন হত। রাবার ড্যাম হওয়ায় সেচ সুবিধার কারণে এখন প্রতি বিঘায় ৩৫ থেকে ৪০ মন ধান উৎপন্ন হচ্ছে। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে তারা সুখে দিন কাটাচ্ছেন। এসব কথা জানালেন কৃষক মন্টু চন্দ্র রায়, পরেশ চন্দ্র রায়, মশির উদ্দিন, চন্দ্র মোহন বাবু, মহেন্দ্রনাথ রায়, আবুল কালাম।
রাবার ড্যাম প্রকল্প পরিদর্শন করে দেখা গেছে, উত্তর থেকে দক্ষিন দিকে বহমান কাঁকড়া নদীর উপরে রাবার ড্যামটি নির্মিত হওয়ায় নদীর উত্তর দিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। কোথাও ১৫ ফুট আবার কোথাও ২০ ফুট পানির গভীরতা। দেখে মনে হয় যেন বর্ষাকালের পানিতে টইটম্বুর নদী। গাঢ় সবুজ রঙের পানিতে ছুটে চলছে ছোট-বড় অনেক নৌকা। এসব নৌকা দিয়ে মানুষ ঘাটে ঘাটে পারাপার হচ্ছে এবং মাছ ধরার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। রাবার ড্যামের উপরে একটি ফুট ব্রীজ ও পাশে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে সিমেন্ট কংক্রিটের মনোরম ছাতা, বসার বেঞ্চ ও বাংলো টাইপ ঘর নির্মিত হয়েছে।
রাবার ড্যাম প্রকল্প এ এলাকার চিত্র বদলে দিয়েছে। রাবার ড্যামের তীরে গড়ে উঠেছে বাজার। এই বাজারে হোটেল, মনিহারী, চিকিৎসালয়, সার, কীটনাশক, জ্বালানীসহ সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্রায় ২শ দোকান গড়ে উঠছে। ফলে এলাকার একটি বড় অংশের মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। রাবার ড্যামের উপরে ফুট ব্রীজ নির্মিত হওয়ায় সাইতাড়া, আব্দুলপুর ও আউলিয়াপুকুর এলাকার মানুষের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই রাবার ড্যাম প্রকল্প এলাকা। কাঁকড়া নদীতে নিয়মিত নৌকা চলাচলের কারণে নদীর উভয় পাশের মানুষ যাতায়াতে উপকৃত হয়েছেন এবং নদীতে প্রচুর মাছ চাষ হচ্ছে। প্রায় ২ হাজার জেলে পরিবার ড্যাম এলাকায় মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ সিকান্দার আলী জানান, প্রতিদিন দর্শনার্থীরা রাবার ড্যাম প্রকল্প পরিদর্শনে আসছেন। এছাড়াও শীত মৌসুমে এখানে অনেক পিকনিক পার্টি এসে থাকে। রাবার ড্যাম প্রকল্প শুধু কৃষকদের ভাগ্যই বদলায়নি, ওই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশে বিরাট ভারসাম্য এনেছে এবং জীব বৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে। নদীর দু’কূলে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য গাছ হওয়ায় গোটা এলাকা পাখির কলকাকুলিতে মুখরিত থাকছে। মানুষের জীবনধারা বদলে দেয়া কাঁকড়া নদীর রাবার ড্যাম প্রকল্প শুস্ক মৌসুমে কৃষকদের আর্শিবাদে পরিনত হয়েছে। রাবার ড্যাম প্রকল্পটি আশাতীত সাফল্য পাওয়ায় দিনাজপুরের সদর উপজেলার কাঞ্চন নদীতে এবং সেতাবগঞ্জ উপজেলার টাঙ্গন নদীতে আরো দুটি রাবার ড্যাম নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।