ধু ধু মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। পথিক পথ চলে আর ভাবে কারা নির্মাণ করেছিল এই অট্টালিকা! কীভাবে নির্মাণ করেছিল! এটি কি মানুষের তৈরি নাকি অন্য কোন গ্রহ-নক্ষত্রের বুদ্ধিমান প্রাণী নির্মাণ করেছে এ পরম রহস্যময় কীর্তি! এ প্রশ্নের কোন শেষ খুঁজে পায়নি পথিক।
যা নিয়ে কালে কালে রচিত হয়েছে অজস কথা উপকথা। অবাক কৌতূহল নিয়ে মানুষ বারে বারে ছুটে গেছে তার পানে, তার নির্মাণ কাঠামো আর বিশালত্বের কাছে মাথা নুইয়ে এসেছে। তবুও বিস্ময়ের শেষ হয়নি। এটি আর অন্য কিছু নয় মিসরের পিরামিড। পিরামিড এমন এক স্থাপনা যার বিস্ময়ের বুঝি শেষ নেই।
পিরামিড শব্দটি প্রাচীন গ্রিকদের দেয়া নাম। গ্রিক ভাষায় পিরামিড শব্দের অর্থ হল খুব উঁচু। পিরামিড হল পাথরের তৈরি বিশাল সমাধি সৌধ। এ পর্যন্ত মিসরের প্রায় ৮০টি পিরামিড বা তার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং প্রায় ৭০টি কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। মিসরের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও আকর্ষণীয় পিরামিডগুলোর মধ্যে হচ্ছে ফারাও খুফুর পিরামিড, চেপরেনের পিরামিড, খাপরার পিরামিড, মেন কাউরার পিরামিড, তুতেন খামেনের পিরামিড। এসব বিখ্যাত পিরামিড মিসরের প্রাচীন রাজবংশের আমলে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ থেকে ২৫০০ অব্দের মধ্যে স্থাপিত।
পিরামিডগুলোর মধ্যে যেটি সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে উঁচু সেটি মিসরের প্রাচীন রাজবংশের আমলে তৈরি হয়েছিল। এটি বর্তমান কায়রো শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে মরুময় গিজা অঞ্চলে অবস্থিত, বিখ্যাত ফারাও খুফুর পিরামিড নামে পরিচিত। ফারাও খুফুর পিরামিডটি নির্মাণ করেছিল বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হল কীভাবে নির্মাণ কাজ সমাধা করা হয়েছিল। কত লোক লেগেছিল! তারা কত বছরের পরিশ্রমে এরকম একটি স্থাপত্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল!
গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস মনে করেন, এ কাজে বিপুল সংখ্যক দাসকে নিয়োগ করেছিল ফারাওরা। তিনি এ সংখ্যাকে ১ লাখ বলে উল্লেখ করেন। আর ১ লাখ লোকের বিশ বছর লেগেছিল। মিসর বিষয়ক অধিকাংশ গবেষক হেরোডোটাসের বক্তব্য গ্রহণ করেছেন। তবে, পোলিশ আর্কিটেকচার ওয়েলসলো কোজিনাছকির ধারণা আরও বেশি। পিরামিডের মূল ক্ষেত্রে লোক লেগেছিল প্রায় ৩ লাখ। অফ সাইডে আরও ৬০ হাজার লোকের দরকার পড়েছিল। আবার গণিতবিদ মেন্ডেলসনের ধারণা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার লোকের ১০ বছর লেগেছিল পিরামিড তৈরির কাজে। কীভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল গ্রেট পিরামিড বা খুফুর পিরামিড এ ব্যাপারে বিভিন্নজন বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। মিসর বিষয়ক গবেষক বারবারা মটের্জের ধারণা খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮৭-২৬৬৭ সালে খুফুর পিরামিড নির্মাণ করা হয়। পিরামিড নির্মাণের জন্য বিপুল সংখ্যক পাথরের দরকার পড়েছিল। এক গ্রেট পিরামিড (সর্ববৃহৎ) তৈরির জন্য ২-২৮ মিলিয়ন ব্লক তৈরি করা হয়েছিল। কোন কোন পাথরের ওজন ছিল কয়েক টন পর্যন্ত। এত ভারি ভারি পাথর কীভাবে এত উপরে উঠানো হয়েছিল ভাবলে বিস্ময় লাগে। এক্ষেত্রে নানা মুনি নানামত দিয়েছেন।
বেশির ভাগ লোকের ধারণা ব্লকগুলো টেনে তুলে পিরামিড নির্মাণ কাজ হয়েছিল। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোসের মন্তব্য হচ্ছে, পিরামিড নির্মাণ করা হয়েছিল সিঁড়ির মতো। স্টেডিয়ামের সিঁড়ির মতো ক্রমশ উঁচু সমান্তরালভাবে, প্রথম ধাপ সমাপ্ত হওয়ার পর শ্রমিকরা পাথর ও অন্যান্য উপাদান টেনে উপরে তুলত। যখন প্রথম ধাপের উপর বিভিন্ন উপকরণ তোলা শেষ হতো, তার পরের ধাপ নির্মাণ কাজে হাত দিত। এভাবে পর্যায়ক্রমে এক একটা ধাপ শেষে নির্মাণ হয়েছিল পিরামিড। এদিকে আরেক ইতিহাসবিদ ডায়াডোরাস সেকুলাসের মতে, সিঁডি নয় বরং ডালু পথে যাবতীয় উপকরণ টেনে তোলা হয়েছিল। আর এ কাজে ব্যবহারের পাথর টেনে তোলা হতো ৫০০ কিলোমিটার দূর থেকে। ডায়াডোরাস নিজেও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এত বড় বড় পাথর কীভাবে টেনে তোলা হতো। কারণ এ যুগের মতো তখনও টেনে তোলার মতো কোন মেশিন ছিল না। আরেক বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এত বড় বড় স্থাপত্য দাঁড়িয়ে আছে বালির উপরে। হেরোডোটাস এবং ডায়াডোরাসের মতামতকে অবশ্য আধুনিক মিসর গবেষকরা খারিজ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে ডায়াডোরাসের আরব থেকে পাথর নিয়ে আসার তত্ত্ব। যদিও তারা সিঁড়ির পর সিঁড়ি তৈরি করে তার উপরে পাথর তোলার তত্ত্ব বাতিল করে দিতে পারেননি।
পিরামিড নির্মাণে শক্ত পাথরের পাশাপাশি প্রচুর নরম চুনাপাথরের প্রয়োজন পড়েছিল। আর এজন্য পিরামিডের দূরেই স্থাপন করা হয়েছিল চুনাপাথর তরল করার ব্যবস্থা। পাথর গুঁড়ো করে তাতে জল মেশানো হতো। পানি নিয়ে আসা হতো নীল নদ হতে সরু নালা খনন করে। তরল চুনাপাথরের সঙ্গে এরপর মেশানো হতো নাইট্রান লবণ। আর এ লবণ পাওয়া যেত পাশের মরুভূমিতে। এরপর এর সঙ্গে চুন মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করা হতো যা ছিল পিরামিড তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এরপর সঙ্গে কষ্টিক সোডা, সিমেন্ট তৈরি করে রোদে শুকানো হতো। আর এভাবে তৈরি করা হতো চুনাপাথরের ব্লক। এই ব্লক সিঁড়ি কিংবা সিঁড়ির বিকল্প পথে টেনে তোলে সঠিক স্থানে বসানে হতো আর এভাবেই চুনাপাথরের ব্লক ও পাথর উপরে টেনে তুলে নির্মাণ হয়েছে অপর বিস্ময় পিরামিড।
আসলে পিরামিড কারা তৈরি করেছিল তা নিয়ে বহু মিথ প্রচলিত রয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে মিসরের গ্রেট পিরামিড বা খুফুর পিরামিড নির্মাণ করেছিল ফারাও খুফুর। তবে সময়ের ব্যাপারটাও রহস্যাবৃত বলেই মনে হয়। খেয়ালি ফারাও সত্যি এটা নির্মাণ করেছিলেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে অনেকেরই। হিসাব করে দেখা গেছে, পাহাড় থেকে কেটে চেঁছে একটার ওপর একটা পাথর এরূপ ২৩ লাখ পাথর দিয়ে পিরামিডটি নির্মাণ করতে সময় লাগবে ২ লাখ ৬০ হাজার দিন। তবে ফারাও কি ততদিন বেঁচেছিলেন। প্রশ্ন থেকেই যায়। এমনও তো হতে পারে খুফুর আগেই কেউ পিরামিডটির নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল। সে নিজের কীর্তির কথা ঘোষণা করেনি। প্রাচীন মিসরের একটি পুঁথি আছে অক্সফোর্ডের কেডলেয়ার লাইব্রেরিতে। পুঁথির এক জায়গায় লেখা আছে, গ্রেট পিরামিডের নির্মাতা রাজা সুরিদ। পিরামিডটি নির্মাণ করে, পুরোহিতদের দিয়ে নিজ শাসন আমলে অনেক তথ্য তা নাকি পিরামিডের ভেতরে লুকিয়ে রেখে গেছে রাজা সুরিদ। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল রাজা সুরিদের শাসনকাল ছিল মহাপ্লাবনেরও অনেক আগে। সুতরাং এর যথার্থতার প্রশ্নটি প্রচলিত মিথগুলোকে আরও পাকাপোক্ত করে দানা বাঁধতে সাহায্য করে।
অনেকেই আবার প্রশ্ন করে প্রাচীনকালে বৈজ্ঞানিক কাঠামোতে গড়া সুবিশাল পিরামিড তৈরি করা মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। এই পরম কীর্তি নির্মাণ করেছে অন্য কোন গ্রহ বা নক্ষত্রের জীবেরা প্রাচীন মিসরের পুঁথিগুলোতে এ প্রমাণ মেলে। মিসরীয়রা সূর্য দেবতার পূজা করত। সূর্য বা নক্ষত্র থেকে দেবতারা এসে মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছিল পিরামিড তৈরির কৌশল, এমন মিথ ও প্রচলিত আছে যে, আসলে দেবতা-টেবতা নয়। তারা ছিল বহির্জাগতিক বুদ্ধিমান কিছু প্রাণী যারা প্রাচীন পৃথিবীতে এসেছিল আর নিজেদের সভ্যতার কিছু নিদর্শন পৃথিবীতে রেখে গেছে।
প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর দেবতা আবার তাদের জাগ্রত করবে। তাই তাদের মৃতদেহকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন অনুভব করে। আর তাই নির্মাণ করে পিরামিড। রাজা খুফুও তার দেহ রক্ষার জন্য নির্মাণ করে বিশাল পিরামিড। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো গ্রেট পিরামিড বা খুফুর পিরামিডের উচ্চতা ছিল ৪৫০ ফুট, প্রতি সাইডে দৈর্ঘ্য ৭৭৬ ফুট।
খুফুর পিরামিডে অনেক কক্ষ বা চেম্বার রয়েছে। রাজা যেখানে অতিথিদের বসাতেন সেই কক্ষ বা গ্রান্ড গ্যালারির দৈর্ঘ্য ৮.৮৪ মিটার। গ্রান্ড গ্যালারির পাশেই ছিল কিংস চেম্বার যেখানে রাজা খুফুর মৃতদেহ মমি করে রাখা হয় এবং পাশে ছিল কুইন্স চেম্বার।
প্রাচীন মিসরীয়রা প্রথাগতভাবে সমাধি সৌধের ভেতরে মৃতদেহ মমি করে রাখার সময় প্রচুর ধন-সম্পদ সঙ্গে দিত। তাদের বিশ্বাস ছিল পরকালে এই ঐশ্বর্যের প্রয়োজন পড়বে। এ ধন-ঐশ্বর্য আহরণের জন্যই হয়তোবা আরবের বাদশা হারুর-অর-রশিদ ৮২০ খ্রিস্টাব্দে খুফুর পিরামিডের অনুসন্ধান চালায়। মাটি খুঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করার পর কিছুই খুঁজে পায়নি, এমনকি খুফুর মমিও না। তবে কোথায় গেল ফারাও খুফুর মমি? আর কোথাইবা গেল তার ঐশ্বর্য-ধনসম্পদ। আধুনিক মিসর বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রাচীনকালেই চোরেরা সব লুট করে নিয়ে গেছে। তবে প্রশ্ন হল কিভাবে চোরেরা প্রবেশ করল এই সমাধি সৌধে? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে কি খুফুর প্রাচীন চোরদের ও আধুনিক প্রতœতাত্ত্বিকদের মনে ব্যথা দিয়ে গেছেন তার নির্মিত পিরামিড পরম আশ্চর্যের কীর্তি হয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য। এ কথা শুধু ফারাও খুফুর আর ঈশ্বরই জানেন।