Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Travel Image

অবহেলিত চন্দ্রাবতীর শিব মন্দির



গ্রামের নাম কাচারিপাড়া। বাংলাদেশের অন্য গ্রামগুলোর মতো এ গ্রামটিও ছায়া সুনিবিড় সবুজে ঘেরা। তারপরও আর দশটা গ্রাম থেকে এ গ্রামটি একটু ভিন্ন, গ্রামের রয়েছে আলাদা এক গৌরব। রয়েছে এক কালজয়ী ইতিহাস। এ ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় চারশত বছরের পুরনো অষ্টকোণাকৃতির ৩২ ফুট উচু এক শিব মন্দির। বাংলা সাহিত্যের আদি মহিলা কবি মতান্তরে প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর নিজস্ব উপাসনার জন্য ষোড়শ শতকের দ্বিতীয় ভাগে নির্মাণ করা হয় এ শিব মন্দির। কবি চন্দ্রাবতীর নামানুসারে এ মন্দির চন্দ্রাবতীর শিব মন্দির নামে পরিচিত। ঈশা খার স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়ি অঞ্চলের পাতুয়াইর এলাকায় বর্তমানে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজকাপন ইউনিয়নের কাচারি পাড়া গ্রামে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর শিব মন্দির।

জেলা সদর থেকে যার দূরত্ব ১০-১২ কিলোমিটার। ষোড়শ শতকে রচিত মনসা মঙ্গলের বিখ্যাত কবি দ্বিজবংশী দাশের কন্যা চন্দ্রাবতীর বিয়োগাÍক ভালোবাসার স্মৃতি সম্পৃক্ত এ মনদির আজ কাচারি পাড়া গ্রামবাসীর গর্বের অনন্য সম্পদ। নারায়ণ ঘোষের বর্ণনা থেকে জানা যায়, কবি চন্দ্রাবতী একদিকে যেমন ছিলেন সাহিত্য প্রতিভাময়ী অন্যদিকে ছিলেন অসম্ভব রূপবতী ও রোমান্টিক মনের অধিকারী। বাল্যকালেই চন্দ্রাবতীর সঙ্গে একই এলাকার জয়ানন্দ নামে এক ব্রাহ্মণ যুবকের মনের আদান প্রদান হয়। তাদের প্রেম, ভালোবাসা একসময় গভীর হয়। কবির ভাষায় ‘তোমারে দেখিব আমি নয়ন ভরিয়া/তোমারে লইব আমি হৃদয়ে তুলিয়া/বাড়ির আগে ফুট্যা রইছে মল্লিকা মালতী/জন্মে জন্মে পাই যেন তোমার মত পতি/’ তাদের এ ভালোবাসাকে চন্দ্রাবতীর পিতা অসম্মান করেননি। তিনি জয়ানন্দের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর বিবাহে সম্মত হন। কিন্তু জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করে ধর্মান্তরিত হয়ে কমলা নামে এক মুসলমান রমণীকে বিয়ে করেন। এ ঘটনায় চন্দ্রাবতী অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পিতার কাছে দুটি প্রার্থনা করেন একটি ফুলেশ্বরী নদীর তীরে তার উপাসনার জন্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করা অন্যটি চিরকুমারী থাকা। নিদারুণ আঘাতে কন্যা যাতে ভেঙে না পড়ে এজন্য স্নেহময়ী পিতা চন্দ্রাবতীর দুটি প্রার্থনাই মঞ্জুর করেন। তিনি কন্যাকে চিরকুমারী থাকার অনুমতি প্রদান করেন এবং তার উপাসনার জন্য ফুলেশ্বরী নদী তীরে নির্মাণ করেন শিব মন্দির। কবির ভাষায় ‘অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে/শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে/’ এভাবেই চন্দ্রাবতীর শিব মন্দিরটি নির্মিত হয় এবং ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে যা আজও চন্দ্রাবতীর জন্ম স্থানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

ষোড়শ শতকে নির্মিত প্রায় ৩২ ফুট উচ্চতার এ মন্দিরের আটটি কোণার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ ফুট। মন্দিরের নিচের ধাপে একটি কক্ষ ও কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য একটি দরজা রয়েছে। মন্দিরের নিচের সররেখায় নির্মিত অংশের কাজ দুই ধাপে সম্পন্ন করা হয়েছে। নিচের ধাপের কার্নিশ পর্যন্ত উচ্চতা প্রায় ৯ ফুট। কক্ষের ভেতরে ৭টি জানালা সদৃশ নকশা খচিত কুলুঙ্গি রয়েছে। কার্নিশ বরাবর রয়েছে একটি ছাদ। মন্দিরের দ্বিতীয় ধাপটিও সরল রেখায় নির্মিত। এখানেও রয়েছে প্রশস্ত কুলুঙ্গি। এ কুলঙ্গির ভেতর ছিল পোড়া মাটির সাহায্যে নির্মিত মনোরম দৃশ্য। দ্বিতীয় ধাপ থেকে মন্দিরটি ক্রমশ সরু হয়ে প্রায় ৩২ ফুট উঁচু সূক্ষ্ম চূড়ায় শেষ হয়েছে। কলসাকৃতির চূড়ার একেবারে শীর্ষদেশে রয়েছে সরু ডাঁটার মতো একটি ফাইনিয়েল। অসাধারণ নির্মাণ কৌশলীর মাধ্যমে নির্মিত চন্দ্রাবতীর শিব মন্দির আর আগের অবস্থায় নেই। গেল শতাব্দীর ৯০-এর দশকে প্রত্নতত্ত বিভাগে মন্দিরটির কিছু অংশ সংস্কার করে কিন্তু উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রাচীন এ পুরাকৃর্তির অবস্থা খুবই সচনীয়।

বাংলা সাহিত্যের আদি মহিলা কবি হিসেবে চন্দ্রাবতীর নাম ইতিহাসে ঠাঁই পেলেও এ প্রতিভাময়ী সাহিত্যিকের স্মৃতিগুলো রক্ষার কোন উদ্যোগ নেই বললেই চলে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চন্দ্রাবতীর লেখা রামায়ণের পাণ্ডুলিপি সুরক্ষিত থাকলেও আমাদের দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নাম আজঅব্দি স্থাপিত হয়নি কোন স্থাপনা। যদিও দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক আসে চন্দ্রাবতীর জন্মস্থানের এ শিব মন্দিরটি দর্শনের জন্য কিন্তু তাদের মনের গভীরে অজানা এক ক্ষত নিয়েই ফিরতে হয় এখান থেকে। সবার মনেই প্রশ্ন জাগে কেন অবহেলিত চন্দ্রাবতীর মন্দির? কেন অবহেলিত তার জন্মভূমি?