ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ইছামতীর তীরে কলাকোপা-বান্দুরার অবস্থান। ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিশাল এক ভান্ডার কলাকোপা-বান্দুরা। উনিশ শতকেও এখানে জমিদারদের বসতি ছিল। প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ গ্রাম এই কলাকোপা-বান্দুরা। যা ছিল একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের তীর্থস্থান। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যও চোখ জুড়ানো। যার প্রাণ ইছামতী নদী।
এখানে দেখার আছে অনেক কিছু। কোকিলপেয়ারী জমিদারবাড়ি বা জমিদার ব্রজেন সাহার ব্রজ নিকেতন, যা এখন জজবাড়ি নামে খ্যাত; ব্যবসায়ী রাধানাথ সাহার বাড়ি, শ্রীযুক্ত বাবু লোকনাথ সাহার বাড়ি, যার খ্যাতি মঠবাড়ি বা তেলিবাড়ি নামে; মধু বাবুর পাইন্নাবাড়ি, পোদ্দারবাড়ি, কালীবাড়ি এবং কলাকোপার কাছে সামসাবাদ তাঁতপল্লি, এর একটু দূরে আলানপুর তাঁতপল্লি। এ ছাড়া আছে হলিক্রস স্কুল এবং জপমালা রানির গির্জা, এর বাইরেও অনেক পুরোনো ভবন ও মঠ চোখে পড়বে কলাকোপা-বান্দুরায়।
নবাবগঞ্জ চৌরাস্তায় মহাকবি কায়কোবাদ চত্বর থেকে একটি সড়ক সোজা কলাকোপা চলে গেছে। অন্য সড়কটি একটু বামে কলাকোপা হয়ে বান্দুরার পথ ধরেছে। বামের এই পথ ধরে একটু সামনে এগোলেই একটি ভাঙা মন্দিরের দেখা মিলবে। এর পেছনে কোকিলপেয়ারী জমিদারবাড়ি। সামনের ভাঙা মন্দিরের মতোই ভগ্ন দশা তার। কোনো রকমে দাঁড়িয়ে থেকে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে চলেছে। তার পাশেই জমিদার ব্রজেন সাহার ব্রজ নিকেতন। আশির দশকের পর একটি বিচারক পরিবার এখানে বসবাস করতে শুরু করলে ব্রজ নিকেতন জজবাড়ি নাম গ্রহণ করে। জজবাড়ি এখন কলাকোপার প্রাণ। রাস্তার এক পাশে বাড়ি। অন্য পাশে দোকান, বাজার, চা—আড্ডা কত কী! তবে খুব একটা জমজমাট এখনো হয়ে ওঠেনি। জজবাড়িতে প্রচুর গাছগাছালির সমারোহ। গাছের ফাঁকে ঘুরে বেড়ায় চিত্রা হরিণ।
এ বাড়ির পাশের রাস্তাটি চলে গেছে আনসার ও ভিডিপির ক্যাম্পের দিকে। এখানে যে বাড়িতে ২৯ আনসার ব্যাটালিয়নের বসবাস, তা তেলিবাড়ি নামে খ্যাত। অনেকে একে বলে মঠবাড়ি। শোনা যায়, বাড়ির একদা মালিক বাবু লোকনাথ তেল বিক্রি করে ধনী হয়েছিলেন। তাই বাড়ির এমন নাম হয়েছে। এখানে তিন-চারটি বাড়ি আছে। ইছামতীর তীরে তেলিদের বিশাল দুটি মহল সত্যি অসাধারণ! তেলিবাড়ি থেকে সামনে ইছামতীর তীর ধরে একটু সামনে এগোলে যে ইমারতগুলো চোখে পড়বে, তার প্রথমটি পাইন্নাবাড়ি। এই বাড়ির তিন মালিকের অন্যতম মধু বাবু পান বিক্রি করে ধনী হওয়ার জন্যই বাড়িটির এমন নামকরণ।
কলাকোপা-বান্দুরায় ইছামতীর তীরে রোমান স্থাপত্যশৈলীর আরেক নিদর্শন রাধানাথ সাহার বাড়ি। বাড়িটির বয়স প্রায় ২০০ বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাড়িতে লুটপাট চলে, বাড়িটিও ভাঙচুর হয়। বাড়ির প্রধান ফটক ধরে ভেতরে ঢুকলে সামনে পড়বে বিশাল উঠোন। মাঝে জলাধার, আর তুলসী মঞ্চ। পাশেই পুজোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান। বাড়ির মালিক রাধানাথ সাহা চাল ও সুপারির ব্যবসা করতেন। ভারতের মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত তার ব্যবসার পরিধি ছিল।
এবার রাধানাথ সাহার বাড়ি পেছনে ফেলে একটু সামনে এগিয়ে যাই। সেখানেই চোখে পড়ে খেলারামের সেই বিখ্যাত বিগ্রহ মন্দিরটি। পাশেই বিশাল পুকুর। প্রচলিত আছে, মাকে বাঁচাতে খেলারাম দাতা এই পুকুরে নেমেছিলেন। আর উঠে আসেননি। এলাকাবাসীর এখনো বিশ্বাস, খেলারাম একদিন ঠিকই ফিরে আসবেন, সঙ্গে নিয়ে আসবেন গঙ্গা নদীকে।
এবার বান্দুরায়
ফুলতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু সামনে এগোলেই নবাবগঞ্জের বান্দুরা গ্রাম। প্রথমেই চোখে পড়বে হলিক্রস স্কুল। আরেকটু সামনে এগোলে বিশাল মাঠ পেরিয়ে পাওয়া গেল জপমালা রানির গির্জা। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই গির্জাটি গথিক শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন। পুরো গির্জাটি হলুদ বর্ণের সুন্দর কারুকাজে ভরা। প্রার্থনা কক্ষ, সমাধিস্থলসহ সব দেখে মন ভরে যাবে। গির্জার সামনেই জপমালা দেবীর নামাঙ্কিত ফলক তাঁর স্মৃতি ধরে রেখেছে। ফেরার পথে সময় থাকলে তাঁতপল্লি ঘুরে আসতে পারেন। কলাকোপা-বান্দুরায় থাকার মতো ভালো হোটেল নেই। তাই সন্ধ্যার আগেই ঢাকার বাস ধরা ভালো। তবে বাড়ি ফেরার সময় বান্দুরার বাসুদেব সাহার মিষ্টান্ন ভান্ডার ঘুরে আসতে ভুল করবেন না।
কীভাবে যাবেন
কলাকোপা-বান্দুরায় দিনে এসে দিনেই ঢাকায় ফেরা যায়। এ জন্য সকালেই রওনা হওয়া দরকার। গুলিস্তান, বাবুবাজার, কেরানীগঞ্জ, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী থেকে সরাসরি বান্দুরার বাস সার্ভিস আছে। তবে দলবেঁধে মাইক্রোবাস নিয়ে গেলে দারুণ একটা পিকনিক করা যাবে।