Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Travel Image

আমের দেশ



আমজনতার ‘আম’ অথবা সাহেবদের ‘mango’।

প্রাচীনকালে আমের কদর আর গুরুত্ব বোঝাতে সংস্কৃতে এর নামকরণ করা হয় ‘আম’, যার অর্থ মজুদ খাদ্য বা রসদ। আম ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষাভাষী দেশগুলোতে ‘mango’ নামে পরিচিত। mango নামটির উৎপত্তি তামিল ম্যান-কি অথবা ম্যান-গে থেকে। পর্তুগিজেরা ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপনের সময় এটিকে গ্রহণ করেন সধহমধ নামে।

আমতত্ত্ব
আম গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে উৎপন্ন একটি ফল। Anacardiaceae গোত্রের Mangifera indica প্রজাতির এ ফল গাছের উৎপত্তির ইতিহাস সুপ্রাচীন।

কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে, আম বাংলাদেশ, আসাম (ভারত) ও মিয়ানমারসহ ভারত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের স্থানীয় ফল। অন্যান্য প্রজাতি যথা M. laurina-এর উৎপত্তি সম্ভবত মালয় অঞ্চলে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ধর্মীয় ও লোকজ অনুষ্ঠানে ব্যবহার্য ফলাদির মধ্যে আমের ব্যবহার সর্বাধিক। এসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমের মতো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক খুব কম ফলেরই রয়েছে। কথিত আছে, স্বয়ং গৌতম বুদ্ধকে একটি আম্রকানন উপহার দেয়া হয়েছিল যেন তিনি তার ছায়ায় বিশ্রাম নিতে পারেন। বলা হয়, বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন-সাং, যিনি ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝিতে ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন, তিনি আমকে সর্বপ্রথম বহির্বিশ্বে পরিচিত করান। মরোক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতাও চতুর্দশ শতকে আমের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েক হাজার বছর ধরে আমের চাষাবাদ চলছে, পূর্ব এশিয়াতে আমের প্রচলন হয় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতাব্দী থেকে এবং চাষাবাদ শুরু হয় আরও পরে খ্রিস্টাব্দ দশম শতাব্দীর দিকে। মোগল সম্রাট আকবর তার শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের লাখবাগের দারভাঙার কাছে প্রায় এক লাখ আম গাছ রোপণ করেছিলেন। সেটিকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সুসংগঠিত আমবাগান বলে মনে করা হয়।

আনুমানিক ১৭০০ সালে ব্রাজিলে প্রথম আম গাছ রোপণের আগ পর্যন্ত পশ্চিম গোলার্ধে আমের চাষ শুরু হয়নি। সেখান থেকে এ ফল ওয়েস্ট ইন্ডিজে পৌঁছায় ১৭৪০ সালের দিকে। আমেরিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে কিছু বুনো প্রজাতির আম জন্মে আম গাছ বিভিন্ন কৃষি-উপযোগী জলবায়ুতে জন্মাতে সক্ষম বলে বর্তমানে এটিকে পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই দেখা যায়।

বাংলার ইতিহাসে দুটি আম্রকানন অনেক গুরুত্ব বহন করে। একটি পলাশীর আম্রকানন, অন্যটি বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা অস্ত গিয়েছিল, আর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীনতার লাল সূর্য নতুন করে উদিত হয়েছিল। আম গাছকে আমাদের জাতীয় গাছের প্রতীক হিসেবে নেয়া হয়েছে।

আমসমগ্র
পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ প্রজাতির আম আছে। আমের বিভিন্ন জাত (varity) আছে, যেমন ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরসা, অরুণা, আম্রপালি, মল্লিকা, সুবর্ণরেখা, মিশ্রিদানা, নীলাম্বরী, কালীভোগ, কাঁচামিঠা, আলফানসো, বারোমাসি, তোতাপুরী, কারাবাউ, কেউই সাউই, গোপাল খাস, কেন্ট, সূর্যপুরী, পাহুতান, ত্রিফলা ইত্যাদি।

আম গাছ চিরসবুজ, কাণ্ড বৃহদাকার, বাকল খসখসে ও কালচে রঙের, শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত ও পাতা ঘন। বেশ ফাঁকে ফাঁকে আম চারা রোপণ করা হলে তা বৃদ্ধি পেয়ে ওপর দিকে ছাতার আকৃতি ধারণ করে এবং প্রায় ২০ মিটার উঁচু ও ৩০ মিটার প্রশস্ত হতে পারে। হলদেটে সাদা বা বেগুনি বর্ণের ও সুগন্ধযুক্ত মুকুল পত্রগুচ্ছের মাথায় ঝুরির আকারে জšে§। প্রতিটি মঞ্জরিতে ১০০ থেকে ২৫০টি মুকুল ধরে, তবে সব না-ও ফুটতে পারে। মুকুল সাধারণত উভলিঙ্গ, স্ত্রীমুকুল অতি বিরল। একটি আম গাছের মোট মুকুলের পরিমাণ বা সংখ্যার ওপর ফলের বিন্যাসের মাত্রা নির্ভর করে। প্রায় এক হাজার মুকুলের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ফলে রূপ নিতে পারে মাত্র দু-একটি। একটি মঞ্জরি থেকে দুই বা তিনটি ফল হলেই ফলন সন্তোষজনক বলে বিবেচিত হয়।
আম মসৃণ, কিছুটা আঁটোসাঁটো, শাঁসালো, এক আঁটিযুক্ত ফল। ফল গোলাকার, ডিম্বাকার, হৃদপিণ্ডকার, বৃক্কাকার, লম্বা বা সরু আকৃতির হয়ে থাকে। কাঁচা আম সাধারণত সবুজ, পাকলে সবুজাভ হলুদ, কমলা, মিশ্র রঙের লাল আভাযুক্ত, এমনকি সবুজও থেকে যেতে পারে। পাকা ফল আকারে ও গুণে নানা রকমের হতে পারে। ক্ষুদ্রতম আম আলুবোখারার চেয়ে বড় হয় না, আর বড় প্রজাতির একেকটি আমের ওজন হয় ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
আম গাছ সাধারণত ৩৫-৪০ মিটার (১১৫-১৩০ ফিট) লম্বা এবং সর্বোচ্চ ১০ মিটার (৩৩ ফিট) ব্যাসার্ধের হয়ে থাকে। আম গাছগুলো বহু বছর বাঁচে, এর কিছু প্রজাতিকে ৩০০ বছর বয়সেও ফলবতী হতে দেখা যায়। আম গাছের পাতা চিরসবুজ, সরল, পর্যায়ক্রমিক, ১৫-৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৬-১৬ সেন্টিমিটার চওড়া হয়ে থাকে; কচি পাতা দেখতে লালচে-গোলাপি রঙের হয়। আমের মুকুল বের হয় ডালের ডগা থেকে, ফুল থেকে শুরু করে আম পাকা পর্যন্ত প্রায় তিন-ছয় মাস সময় লাগে।

ডেসটিনেশন রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ
রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম বেশি উৎপাদন বেশি হয়। তার পরেও ‘রাজশাহীর আম’ কেন বলা হয়? দেশভাগের আগ পর্যন্ত নবাবগঞ্জ আমের জন্য খ্যাত মালদহ জেলার একটি থানা ছিল। পরে রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ১৯৪৮ সালে মহকুমায় রূপান্তরিত হয়, তারপর ১৯৮৪ সালে জেলায় উন্নীত হয়। সম্ভবত বৃহত্তর রাজশাহীর জন্য এ অঞ্চলের আম ‘রাজশাহীর আম’ নামেই দেশজুড়ে প্রসিদ্ধ।

রাজশাহী শহরতলি ও গ্রামগুলোতে প্রচুর আমের বাগান রয়েছে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ? যেন আম গাছে পরিপূর্ণ একটা জনপদ।
কারনা মানা হ্যায়
এ অঞ্চলের আম গাছগুলোতে হাত দূরত্বে আম ঝুলে থাকে। নিছক খেয়াল বশেও আম ছিঁড়তে যাবেন না। তাহলে জরিমানা গুনতে হতে পারে। তবে গাছের নিচে পড়ে থাকা আম কুড়িয়ে নিতে পারেন গাছ থেকে এমনি এমনি পড়া আম যে কুড়িয়ে পাবেন মালিকানাস্বত্ব তার।

ট্রিপ টিপস
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী ভ্রমণটা যদি শুধু আমের টানে হয় তাহলে এর সঙ্গে এ অঞ্চলের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে নিতে পারেন, ‘রথ দেখা আর কলা বেচা’ থুড়ি ‘আম খাওয়া আর ভ্রমণ’ দুই-ই হবে। এ সুযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর যা যা দেখতে পারেন তা হলঃ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ : ছোট সোনা মসজিদ (১৪৯৩-১৫১৯), বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধি, দারসবাড়ী মসজিদ ও মাদ্রাসা (১৪৭৯), দারসবাড়ী মসজিদের প্রস্তরলিপি, খঞ্জনদিঘির মসজিদ, ধনাইচকের মসজিদ, চামচিকা মসজিদ, তিন গম্বুজ মসজিদ, তাহখানা কমপ্লেক্স, শাহ্ নেয়ামতউল্লাহ (রহ.) ও তার মাজার, কোতোয়ালি দরওয়াজা, দাফেউল বালা, বালিয়াদিঘি, খঞ্জনদিঘি, কানসাটের জমিদারবাড়ি, তরতীপুর, চাঁপাই জামে মসজিদ, মহারাজপুর জামে মসজিদ, মাঝপাড়া জামে মসজিদ, হজরত বুলন শাহর (রহ.) মাজার, সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা (বাইশ পুতুল), মহারাজপুর মঞ্চ, বারঘরিয়া মঞ্চ, জোড়া মঠ।

রাজশাহী : হজরত শাহ মখদুম রূপোষের (রহ.) দরগা (১৬৩৪), পুঠিয়া রাজবাড়ি, পুঠিয়া বড় আহ্নিক মন্দির, পুঠিয়া বড় শিবমন্দির, পুঠিয়া দোলমন্দির, পুঠিয়া গোবিন্দ মন্দির, বাঘা মসজিদ (১৫২৩), দুই গম্বুজবিশিষ্ট কিসমতমাড়িয়া মসজিদ (অষ্টাদশ শতাব্দী), এক গম্বুজবিশিষ্ট রুইপাড়া (দুর্গাপুর) জামে মসজিদ (ষোড়শ শতাব্দী), বাগধানী মসজিদ (পবা), তিন গম্বুজবিশিষ্ট ভাগনা (তানোর) জামে মসজিদ (১২২৩ হিজরি), হজরত শাহ্ সুলতান (রহ.)-এর মাজার (গোদাগাড়ী, চতুর্দশ শতাব্দী), দেওপাড়া প্রশস্তি (গোদাগাড়ী), বড়কুঠি (অষ্টাদশ শতাব্দী), তালোন্দ শিবমন্দির (১৮৬০), রাজশাহী বড়কুঠি, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, রাজশাহী কলেজ, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ, শহীদ কামরুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা, শহীদ জিয়া পার্ক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পোস্টাল একাডেমী, স্মৃতি অম্লান। রাজশাহী শহরটার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী; সুবিশাল এ পদ্মার পাড়টা বেড়ানোর জন্য অনন্য। তাই পদ্মার পাড়ে না গেলে রাজশাহী ভ্রমণটাই অপূর্ণ থেকে যাবে।

চেক-ইন
রাজশাহীতে পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেল রয়েছে। এ ছাড়াও রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বেশ কিছু সরকারি ডাকবাংলো রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল আছে।

রাজধানীর কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার জন্য অনেক বাস সার্ভিস আছে। ঢাকার সঙ্গে রাজশাহীর সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ আছে : সিল্ক সিটি (কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ার সময় দুপুর ২টা ৪০ মিনিট; বন্ধের দিন রোববার), ধূমকেতু (কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ার সময় ভোর ৬টায়; বন্ধের দিন মঙ্গলবার) ও পদ্মা (ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে ছাড়ার সময় রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে; বন্ধের দিন মঙ্গলবার)। ‘পদ্মা’র সঙ্গে কানেক্টিং ট্রেন আছে যা রাজশাহী স্টেশন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেশন পৌঁছে দেবে। বাসে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এক ঘণ্টার বেশি লাগে না। রাজশাহী পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সপ্তাহে তিন দিন শনি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার ফ্লাইট আছে ঢাকা থেকে।

পেটপূজা
যারা মাছ খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্য একটা বাড়তি পাওয়া হল চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর মাছ, যা অনেক সুস্বাদু। এ অঞ্চলে কলাইয়ের রুটি বলে এক ধরনের স্ট্রিটফুড রুটি পাওয়া যায়, যা নুন-মরিচ বা মরিচবাটা অথবা বেগুনের ভর্তা দিয়ে খেতে হয়। এ ঝাল খাবারটার কথা শুনে যারা মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন তারা হতাশ হবেন না। উত্তরবঙ্গের বগুড়ার পরে নবাবগঞ্জের দইয়ের যথেষ্ট সুনাম আছে। শুধু দই নয়, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি যেমন চমচম, রাজভোগ, সন্দেশ, প্যারা, রসমালাই আর শিবগঞ্জের আদি চমচম খেলে আবার ট্যুরের প্ল্যান করতে হবে।

কেনাকাটা
আমের মৌসুমে গেলে কেনাকাটার তালিকায় থাকবে আম আর আমের তৈরি আচার, আমতা, আমসত্ত্বা তারপর অন্য কিছু। রাজশাহীর আরেক নাম ‘সিল্কসিটি’, তাই সিল্কের জিনিসপত্র কেনার জন্য যেতে হবে রাজশাহীর বিসিক শিল্প এলাকায় আর সাহেববাজার সোনাদীঘির মোড়ে। রাজশাহীর পবা-মোহনপুরে উন্নতমানের পানের চাষ হয়, পানে আসক্ত মুরব্বিদের জন্য পান কিনে নিয়ে যাওয়াও তাদের কাছে অনেক বড় উপহার হতে পারে। এ অঞ্চলের কাঁসার তৈরি জিনিসপত্র ও সুভেনিয়ার পাওয়া যায়, সেটাও কেনাকাটার তালিকায় রাখতে পারেন। এ ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভালোমানের নকশিকাঁথা পাওয়া যায়।