গঠন স্থাপত্যের দিক থেকে এই মন্দিরের সাথে কান্তজীর মন্দিরের অনেক মিল আছে। দুটো মন্দিরই অপরূপ নকশার টেরাকোটায় সজ্জিত। কান্তজীর মন্দির বহুল পরিচিত হলেও এই মন্দিরটি তেমন একটা পরিচিত নয়। ধ্বংসের মুখে পড়া এই মন্দিরটি সংস্কার করে নতুন জীবন দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে অসংখ্য পর্যটক এই মন্দির পরিদর্শনে আসতে শুরু করছে। মন্দিরটির গঠন বৈচিত্র্যের কারণে এটি অনেকের নজর কেড়েছে। পুরো মন্দির এলাকায় কোন সীমানা প্রাচীর নেই। তাই যেকোনো সময় যেতে পারেন এই মন্দিরে। মন্দিরটি যেহেতু একটু গ্রামের ভেতর তাই পথে আপনার চোখে পড়বে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দিক নির্দেশক সাইনবোর্ড। মেঠো পথ আর দুপাশের ধানের সারি পার হয়ে যেতে আপনার ভালই লাগবে। একথা নিশ্চিত যে মন্দিরের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই
হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দিরঃ
একটি উঁচু বেদীর উপর নবরত্ন পরিকল্পনায় নির্মিত মন্দিরের প্রতিটি বাহু ১৫.৪ মিটার দীর্ঘ এবং বর্তমানে ১৩.২৫ মিটার উঁচু। ক্রমহ্রাসমান তিনতলা বিশিষ্ট এ মন্দিরটি স্থানীয়ভাবে ‘দোলমঞ্চ’ নামে পরিচিত। মন্দিরের উপরের রত্ন বা চূড়াগুলো অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। নীচতলায় ২টি বারান্দা বেষ্টিত একটি গর্ভগৃহ আছে। এর বারান্দার বাইরের দিকে ৭টি এবং ভিতরের দিকে ৫টি খিলান প্রবেশ পথ আছে। গর্ভগৃহের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ২টি প্রবেশ পথ রয়েছে। মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় বারান্দা নেই। নিচ তলা থেকে উপরের তলাতে ওঠার জন্য মন্দিরের ভেতর থেকে একটি চিকন সিঁড়ি দোতালায় উঠে গেছে।
মন্দিরটি ইট,চুন,সুরকির মসল্লা দিয়ে নির্মিত। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবরত্ন মন্দির। মূল অবস্থায় মন্দিরটি পোড়ামাটির চিত্রফলক দ্বারা সজ্জিত ছিল। এখনও মন্দির গাত্রে সামান্য কিছু চিত্রফলকের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। মন্দিরটির ছাদ-প্রান্ত আংশিক বাঁকানো অবস্থায় আছে। এ মন্দিরে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে কিছু পাঠজাত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, নবাব মুর্শিদকুলি খানের শাসনামলে রামনাথ ভাদুড়ী নামে জনৈক তহসিলদার খ্রি.১৭০৪-১৭২৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এটি নির্মাণ করেছিলেন।
মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন। এখানে কোন টিকেটের ব্যবস্থা নেই। মন্দিরের দেখাশোনার দায়িত্বে একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োজিত আছেন। চাইলে তার কাছে অনুমতি নিয়ে মন্দিরের দোতালায় উঠতে পারেন।
এই মন্দিরের আশেপাশে আরও দুটি ছোট মন্দির রয়েছে। যার একটি সংস্কার করে সুন্দর করে তোলা হয়েছে। অন্যটি এখনো পুরোপুরি সংস্কার করা হয়নি। এই সংস্কার-বিহীন মন্দিরটির গায়েও অনেক টেরাকোটার কারুকাজ দেখা যায়। মন্দিরটি অনেকটা ছোট কুঁড়ে ঘরের মত। এর ছাদও পোড়ামাটির তৈরি। মন্দিরটিতে প্রবেশ করার জন্য একটি ছোট দরজা রয়েছে।
সংস্কার কাজঃ
সিরাজগঞ্জ জেলার হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির নগরবাড়ী-বগুড়া পাকা সড়ক থেকে প্রায় ১কিমি পূর্বে অবস্থিত। এই মন্দিরের আশেপাশে আরও তিনটি মন্দির আছে। দিনাজপুর জেলার কান্তনগর মন্দিরের অনুকরণে দ্বিতল এই মন্দিরটি গঠিত। এর আয়তন ১৫.২৮×১৫.২৪ মিটার। মন্দিরটি স্বল্প উচ্চ একটি প্লাটফরমের উপর তৈরি। মন্দিরের মূল কক্ষটি বেশ বড়। চারদিকের দেয়ালের বহিগাত্রে পোড়ামাটির ফলক দ্বারা শোভিত ছিল কিন্তু কালের বিবর্তনে ও সংস্কারের অভাবে মন্দিরটি প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মন্দিরটি অধিগ্রহণ করে সংস্কার কাজ শুরু করে। ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে মন্দিরটির কিছু অংশ সংস্কার করা হয়। এর পরবর্তিতে অর্থাৎ ২০০৭-০৮ অর্থ বছরে ব্যপক সংস্কার কাজ করা হয়। এসময় মন্দিরের উত্তর পাশের বারান্দা ও এর নকশা, দোতালার চারটি রত্ন আংশিক সংস্কার করা হয়।
মনে রাখবেনঃ
মনে রাখবেন কোন ব্যক্তি কোন সংরক্ষিত পুরাকীর্তির কোন রকম ধ্বংস বা অনিষ্ট সাধন করলে বা এর কোন বিকৃতি বা অঙ্গচ্ছেদ ঘটালে বা এর কোন অংশের উপর কিছু লিখলে বা খোদাই করলে বা কোন চিহ্ন বা দাগ কাটলে ১৯৬৮ সালের ১৪নং পুরাকীর্তি আইনের ১৯ ধারার অধীনে তিনি সর্বাধিক এক বৎসর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে সরাসরি আপনাকে আসতে হবে সিরাজগঞ্জ রোডে। যমুনা সেতু পার হয়ে একটু সামনে সিরাজগঞ্জ রোড। ঢাকার গাবতলি ও মহাখালী থেকে অনেক বাস সিরাজগঞ্জ রোডের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হানিফ, শ্যামলী, এস আর ট্রাভেলস, টি আর ট্রাভেলস, নাবিল, বাবলু ইত্যাদি বিভিন্ন বাস চলাচল করে এই রুটে। ভাড়া নন এসি ২৫০ টাকা। এছাড়া সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার বাসে করেও আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে নামতে হবে সিরাজগঞ্জ রোডে। সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা অথবা ভ্যান বা রিক্সা ভাড়া করে যেতে হবে হাটিকুমরুল মন্দির। আর ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলেতো কথাই নেই। ভ্রমণটা তাহলে আরো সহজ হয়ে যাবে। সিরাজগঞ্জ রোড থেকে হাটিকুমরুল মন্দিরের দূরত্ব ৫-৬ কিলোমিটার হবে। এর মধ্যে ১.৫ কিলোমিটার কাঁচা বা মাটির রাস্তা। মন্দিরটি ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। ট্রেনে আসতে চাইলে আপনাকে নামতে হবে উল্লাপাড়া স্টেশনে। সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশাতে সিরাজগঞ্জ রোড পর্যন্ত আসতে হবে। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকাল ৮.৩০ মিনিটে নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি উল্লাপাড়া স্টেশন হয়ে যায়।
কোথায় থাকবেনঃ
সিরাজগঞ্জ রোডে থাকার মত ভাল হোটেল নেই। তাই থাকতে হলে আপনাকে যেতে হবে সিরাজগঞ্জ অথবা বগুড়াতে। যদি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান তাহলে বগুড়া হবে আপনার জন্য আদর্শ। ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়, ভাসু বিহার, মোহাম্মাদ আলী প্যালেস মিউজিয়াম, মহাস্থান জাদুঘর,গোবিন্দ ভিটা ইত্যাদির টানে আপনাকে বগুড়া আসতেই হবে। সিরাজগঞ্জ রোড থেকে বগুড়াতে যাবার জন্য বাস এবং সিএনজি দুটোই পাবেন। সময় লাগবে ১.৩০ মিনিট। থাকার জন্য বেছে নিতে পারেন বগুড়া শহরের হোটেলগুলি। সব ধরণের ও মানের থাকা-খাওয়ার জায়গা পাবেন এখানে। ২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় রাত যাপনের ভাল ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বেছে নিতে পারেন থ্রি স্টার হোটেল নাজ গার্ডেন, হোটেল সেফওয়ে, আকবরিয়া, সিয়াস্তা কিংবা পর্যটন মোটেল। খাবারের ব্যবস্থা আছে সবগুলিতেই।