ঢাকার অদূরে সাভারে প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাকায় রয়েছে নানা জীববৈচিত্র্য। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সম্প্রতি সবার দৃষ্টি কেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজাপতি গার্ডেন। প্রজাপতি গার্ডেন মূলত হরেক নাম আর রঙের প্রজাপতির এক পরিকল্পিত আবাস। সেখানে প্রজাপতিদের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা ঘর আর প্রজননকেন্দ্র। এখানে প্রজাপতিদের কেউ বিরক্ত করে না, তারা আপন মনে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়, মধু খায়। সকাল, দুপুর, সাঁঝে তারা পাখা মেলে। আকাশে ছড়ায় রঙ। জাহাঙ্গীরনগরের সবুজ ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে প্রজাপতির অভয়ারণ্য। সবুজ বনানী, নরম ঘাসের ডগায় দিনভর চলে তাদের ওড়াউড়ি। সুয্যিমামা জাগার আগেই ঘুম ভাঙে তাদের। শুরু হয় আরও একটি দিনের। শরতের সকালের শিশির ভেজা শান্ত পরিবেশে একটু এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি, তারপর খাদ্য সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়া। প্রকৃতি রোদের ছোঁয়ায় তেতে ওঠার আগেই খাদ্য সংগ্রহ করা চাই। এজন্য ছুটতে হয় এ ডাল থেকে ও ডালে। এক বন থেকে অন্য বনে। চলে মধু সংগ্রহের প্রতিযোগিতা। বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল বর্ণের বৈচিত্র্যময় ডানায় ভর করে তারা ছুটে চলে। রঙের জাদুতে মোহিত করে দর্শককে। দেখে ভ্রম হয়, প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা?
প্রজাপতির বাগানের প্রজাপতিদের রঙের বাহার যেমন, তেমই নামের বাহার। টাইগার গ্রপ, শ্যালো টেল, গ্রাস ইয়েলো, ইয়েলো পেনসি, লাইম বাটার ফ্লাই আরও কত কি! আমাদের দেশের মোট দু’শ জাতের প্রজাপতির ১১০ প্রজাতিই রয়েছে এখানে। আর এর মধ্যে আবার ৬১টি প্রজাতি নতুন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩শ’ একর জমির ওপর এই প্রজাপতি বাগান। জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন ১৪ বছরের সাধনায় গড়ে তুলেছেন প্রজাপতিদের এই আবাস। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ের বন-বনানী আর জীববৈচিত্র্যের কারণে তা সম্ভব হয়েছে। আর প্রজাপতিরাও আপন করে নিয়েছে বাগানটিকে।
প্রজাপতির বাগানে প্রজাপতিদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী রয়েছে আলাদা আলাদা ঘর। ঘর মানে বাঁশঝাড়, ফুলবাগান ঝোপ-জঙ্গল, নাগেশ্বর গাছের সারি, ঘাসের মাঠ এসবই বাটারফ্লাই হাউজ। কখনও কখনও তাদের দেখতে এগিয়ে যেতে হয় সতর্ক পায়ে, সজাগ দৃষ্টিতে।
প্রজাপতি গার্ডেনে যেমন প্রজাপতির প্রাকৃতিক প্রজনন হয়, তেমনি প্রাণিবিদ্যা বিভাগে মনোয়ার হোসেন গড়ে তুলেছেন কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্র। সেই কেন্দ্রে জম্ম নেয়া প্রজাপতিও ছেড়ে দেয়া হয় বাগানে। এ পর্যন্ত দুটি প্রজাতির শতাধিক প্রজাপতির জম্ম হয়েছে প্রজননকেন্দ্রে। আর তা রক্ষা করছে বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রজাতিকে।
৩০০ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে এই প্রজাপতির বাগান। রয়েছে প্রজাপতির উপযোগী বন-বনানী, ফুলের বাগান ও প্রজাপতির ঘর। জানা গেল, প্রজাপতির এই বাগানে খুব শিগগিরই আয়োজন করা হবে প্রজাপতি মেলা। আর প্রজাপতি বাগানটি পর্যায়ক্রমে উন্মুক্ত করা হবে দর্শনার্থীদের জন্য।
এ দেশে প্রজাপতি নিয়ে প্রথম গবেষণা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাহমুদুল আমিন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শফিক হায়দার চৌধুরী ঢাকা শহরে গবেষণা চালিয়ে ২৭ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করেন। ১৯৮৩-৮৫ সালে দেশের বিভিন্ন বনে পরিচালিত এক গবেষণায় আরও ৩৩ প্রজাতি চিহ্নিত করা হয়। গবেষণাটি পরিচালনা করেন ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট চট্টগ্রামের গবেষক এমএ ওয়াহিদ, বক্শ চৌধুরী ও জেএইচ চৌধুরী। ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় গবেষণা চালিয়ে ১২৬ প্রজাতির সন্ধান পান বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক এমএস আলম ও জিএম উল্লাহ।
১৯৯৬ সালে ড. ইসমাঈল চৌধুরী, ড. শফিক হায়দার ও সহযোগী অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন গবেষণা চালিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫১ প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান পান, যেগুলোর মধ্যে নতুন প্রজাতি ২১টি। ড. মনোয়ারের তত্ত্বাবধানে ছাত্র এমএ রাজ্জাক গবেষণা করে আরও ৩৯ প্রজাতির প্রজাপতি চিহ্নিত করেন ২০০৩ সালে, যার মধ্যে নতুন প্রজাতি ৩৬টি। সর্বশেষ ২০১০ সালে আরও চারটি নতুন প্রজাপতি শনাক্ত করেন ড. মনোয়ার। বিশ্ববিদ্যলয়ের বিশ মাইল, বোটানিক্যাল গার্ডেন, হলের বাগান, রেজিস্ট্রার ভবন, সুইমিং পুল, র্যাগ উদ্যান প্রভৃতি স্থানে গবেষণার মাধ্যমে এগুলোর সন্ধান পাওয়া গেছে।
২০০৩ সালে চিহ্নিত ৩৬ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে লিম্ফালিড পরিবারের ‘কমন সার্জেন্ট’ ও ‘কমান্ডার’, পাইরিডি পরিবারের ‘ওয়ান্ডারার’ ও ‘ইন্ডিয়ান ক্যাবেজ’। লাইকানিডি পরিবারে রয়েছে ১৩টি প্রজাতি। এর মধ্যে পিব্লু, অ্যাংগে¬ট পিরোট, ক্লাব সিলভার লাইন, কমন ও ডার্ক সিরুপিলিন, অ্যাপে ফ্লাই, ম্যানগ্রোভ সানবিম ও ফরগেট মি নট উলে¬খযোগ্য। হেসপারিডি পরিবারের রয়েছে ১৪ প্রজাতি। সর্বশেষ সন্ধান পাওয়া চার প্রজাতি হল ব্যামেবা ট্রি ব্রাউন, চেসনাট অ্যাঙ্গল, ব্লু প্যানসি এবং টিনি গ্যাস ব্লু। ছোট্ট হলেও প্রজাপতির অর্থনৈতিক গুরুত্ব অসীম। জিন গবেষণা ও ফসলের ফলন বাড়াতে প্রজাপতি উপকারী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোঃ আবদুস ছালাম নান্দনিক মূল্যের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে প্রজাপতির অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথাও মনে করিয়ে দিলেন প্রতিবছর সারাবিশ্বে ৩০-৪০ মিলিয়ন ডলারের প্রজাপতি বিক্রি হয়। প্রাণিবিদ্যার শিক্ষার্থী নূপুর জানান, ‘প্রজাপতিকে কাজে লাগিয়ে সৌরশক্তি ১০ শতাংশ বেশি উৎপাদন সম্ভব।
দেশে পাঁচ-ছয়শ’ প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। এই কাজে নানান অবহেলা ও আর্থিক সংকটের কারণেই আমরা তা চিহ্নিত করতে পারছি না। প্রকৃতি ও জলবায়ুর বিপর্যয়ে অনেক প্রজাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে সব প্রজাতিই পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজেদের পরিবর্তন করছে। তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’ প্রজাপতির নানা প্রজাতির প্রকৃতিতে সংরক্ষণের বিষয়ে বলতে গিয়ে উলে¬খ করেন ড. মনোয়ার। সচেতনতা তৈরির জন্য বিভাগ থেকে রংবেরঙের প্রজাপতির ছবি নিয়ে সম্প্রতি একটি লিফলেট প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কেউ যদি ছোটবেলার দুরন্ত দিনগুলোর কথা মনে করে নস্টালজিক হতে চান, তাহলে আজই ঘুরে আসুন ঢাকার কাছেই প্রজাপতির এই বাগানটিতে।