১। সাধারণত কিছু গ্রাম একসাথে হয়ে গঠিত হয় একটি ইউনিয়ন। কিন্তু এই নিয়মের বাত্যয় ঘটেছে ঐতিহাসিক বানিয়াচং গ্রামে। কারণ এটাই একমাত্র গ্রাম যার মধ্যেই রয়েছে চারটি ইউনিয়ন।
২। গ্রামটি দৈঘ্যে ৭ কিলোমিটার আর প্রস্থে ৪ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা প্রায় এক লাখ।বানিয়াচং গ্রামে শিক্ষার হার শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ। গ্রামে ছয় থেকে দশ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার।
৩। হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই গ্রামটিকে দূর থেকে দেখতে সমতলের মধ্যে সবুজে পরিবেষ্টিত পাহাড় বলে ভ্রম হয়। বানিয়াচং গ্রামটি কত প্রাচীন তা হয়ত ঠিক করে বলা যাবে না, আইনি আকবরীসহ কিছু প্রাচীন গ্রন্থে লাউড় রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। কাজেই গ্রামটি যে অন্তত হাজার বছরের পুরনো তাতে কোন সন্দেহ নেই।
৪। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশাল এই গ্রামকে পশ্চিমারা কেউ কেউ বলে ‘গ্রিন সিটি’ আবার ময়মনসিংহ গীতিকায় বানিয়াচং গ্রামকে শহর হিসেবে বর্ণনা করা হলেও এখানকার মানুষ একে গ্রাম হিসেবে পরিচয় দিতেই গৌরববোধ করে। এজন্য বানিয়াচংকে ‘পল্লীরাজ’ হিসেবে নামকরণ করা যেতে পারে। বানিয়াচং গ্রামের কমলা রাণীর দীঘিসহ (যা বর্তমানে সগরদীঘি নামে পরিচিত) অনেক ইতিহাসখ্যাত নিদর্শন রযেছে, যা দেশের মধ্যকার ভ্রমনকারীদের কাছে খুব আকর্ষণীয়।
৫।এই গ্রামের নামকরণ কিভাবে বানিয়াচং হল তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
ক) কোন এক সময় এক বানিয়া (বণিক) চাং তৈরি করে এখানে পাখি শিকার করত যা দিয়ে সে ব্যবসা করত। বানিয়ার সেই চাং থেকে নাম হয়েছে বানিয়াচং। খ) আবার এমনও অনেকে বলেন যে, ১২শ’ শতকে কেশব মিশ্র নামে এক রাজা যুদ্ধ করে এই গ্রামের গোড়াপত্তন করেন। সেই যুদ্ধটি বিনায়ে জং নামে পরিচিত ছিল। কালক্রমে বিনায়ে জং থেকে হয়েছে বানিয়াচং নামের উৎপত্তি।
৬। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এক সময় লাউড়, গৌড় ও জৈন্তা নামের তিনটি রাজ্য নিয়ে গঠিত ছিল সমগ্র সিলেট বিভাগ। গোবিন্দ সিংহ নিজকে হবিব খাঁ ঘোষণা করে বানিয়াচংয়ে লাউড় রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। লাউড় রাজ্যের রাজারা বানিয়াচং থেকে এক সময় ২৮টি পরগনা শাসন করতেন।
৭। বানিয়াচং গ্রামের ভেতরের পাড়াগুলো মহল্লা নামে পরিচিত। মোট মহল্লার সংখ্যা প্রায় একশ’। বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি মহল্লা কিছু কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দেশের অপরাপর গ্রাম, পাড়া, মহল্লার নাম থেকে বানিয়াচংয়ের মহল্লাগুলোর নামে বেশ ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মহল্লাগুলোর কিছু কিছু নাম হচ্ছে এ রকম- আমিরখানি, শরীফখানি, আদমখানী, মধুখানী, যাত্রাপাশা, বাসিয়াপাড়া, পাড়াগাঁও, প্রথমরেখ, চান্দের মহল্লা, জাতুকর্ণপাড়া, ঠাকুরপাড়া ইত্যাদি। এসব মহল্লার রয়েছে নিজস্ব পঞ্চায়েত।
৮। গাছপালা ঘেরা বিশাল গ্রাম বানিয়াচং। বাংলার ছয়টি ঋতুর পালা বদলই এখানে সুষ্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায়। বানিয়াচংয়ে গ্রীষ্ম ঋতুর প্রখরতা কম। এর কারণ হচ্ছে গাছপালার সমারোহ। সারা বছর এখানে পাখির কলকাকলি শোনা যায়। কাক, কোকিল, বৌ কথা কও, বুলবুলি, দোযেল বাবুই, চড়–ই, কাঠঠোকরো, মাছরাঙা, ফিঙে সহ বাংলাদেশের সব পাখিই এখানে স্বাধীনভাবে নিজেদের অস্তিত্বের ঘোষণা দেয়। প্রচুর গাছ-গাছালির জন্য পাখিরা নির্ভয়ে এ গ্রামে বসবাস করতে পারে।