মানুষ যখন সংখ্যা বা অঙ্ক শেখা শুরু করে, তখন নিশ্চয় ভেবে দেখেনা, এগুলো আসলে কোথা থেকে এলো? আসলে ১,২.৩...এ রকম প্রতিটি অঙ্কের পেছনে একেকটি ঘটনা আছে। ‘শূন্য’ও তেমনি একটি অঙ্ক। ‘শূন্য‘
কীভাবে শূন্য হলো, তা জানানোর প্রয়াস থাকবে এ লেখায়।
শুরুতে ‘শূন্যে’র ব্যবহার ছিল ভিন্ন। এখনকার মতো শূন্য গণিতের অবিচ্ছেদ্য অংশ তখনো ছিল না। সাধারণত: কোনো সংখ্যা নেই, এমন সব জায়গায় শূন্যের ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন গণিতে শূন্যের ব্যবহার অসীম। সংখ্যা এবং অঙ্কে এর ব্যবহার এখন প্রচলিত। ইংরেজীতে শূন্যকে “nought”, “zero”, “nil” or the “naught” ও বলা হয়।
ইংরেজী ‘জিরো’ শব্দটির মূল উৎপত্তি আবরি ‘সাফিরা’ থেকে। এরপর ইটালিয়ান ‘জেফিরো’, তারপর ভেনেশীয় ‘জিরো’ এবং শেষে ফ্রেঞ্জ ‘জি’রো’ থেকে ইংরেজী ‘জিরো’ শব্দের আবির্ভাব। সাফিরা শব্দটির উৎপত্তি আবার ‘সিফর’ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে ‘কিছুনা’। ১৫৯৮ সালে ইংরেজীতে সর্বপ্রথম ‘জিরো’ অঙ্কটি ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃতে একে ‘শূন্য’ বলা হয়।
প্রাচীন মিশরীয় সংখ্যাগুলো ছিল দশ ভিত্তিক। তাদের সংখ্যাগুলো স্থানভিত্তিক না হয়ে চিত্রভিত্তিক ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৪০ সালের দিকে মিশরিয়রা আয়কর ও হিসাবরক্ষণের জন্য শূন্যের ব্যবহার করত। তাদের চিত্রলিপিতে একটি প্রতীক ছিল যাকে "নেফর" বলা হতো, যার অর্থ হল ‘সুন্দর’। এই প্রতীকটি তাঁরা শূন্য এবং দশকের ভিত্তি হিসেবে ব্যাবহার করত। প্রাচীন মিশরীয় পিরামিড ও অন্যান্য স্থাপনায় এ ধরনের সংখ্যার ব্যবহার পাওয়া যায়।
খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে ব্যবিলনীয় গণিতবিদরা ছয়ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থার প্রবর্তন ও উন্নয়ন করে। ‘শূন্য’ সংখ্যাটির অভাব তারা ছয়ভিত্তিক সংখ্যার মধ্যে একটি খালি ঘর রেখে পূরণ করত। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকে দুটি যতিচিহ্ন প্রতীক এই ফাঁকা যায়গা দখল করে নেয়। প্রাচীন মেসোপটেমীয় শহর সুমের থেকে প্রাপ্ত একত্ব শিলালিপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন লেখক বেল বেন আপ্লু তার লেখায় দু’টি যতিচিহ্ন প্রতীক ব্যবহারের বদলে একই ‘হুক’ দিয়ে শূন্যকে প্রকাশ করেছেন।
ব্যাবিলনীয় শূন্যটি প্রকৃতপক্ষে ‘শূন্য’ হিসেবে ‘গণ্য’ করা সমীচীন হবে না। কারণ, এই প্রতীকটিকে স্বাধীনভাবে লেখা সম্ভব ছিল না কিংবা এটি কোনো সংখ্যার পিছনে বসে কোনো দুই অংক বিশিষ্ট অর্থবোধক সংখ্যা প্রকাশ করত না।
শূন্যকে কোনো সংকেত বা প্রতীক হিসেবে ব্যবহার না করে সরাসরি সংখ্যা হিসেবে সফলভাবে ব্যবহারের অবিমিশ্র কৃতিত্ব প্রাচীন ভারতীয় গণিতবিদদের। খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীর দিকে ভারতে বাস্তব সংখ্যা দ্বারা হিসাব নিকাশ করার সময় শ্যূন্য ব্যবহৃত হত। এমনকি শ্যূন্যকে ব্যবহার করে যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগও করা হত।
খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতকের মধ্যে ভারতীয় গণিতবিদ পিঙ্গলা ‘বাইনারি সংখ্যা’ দিয়ে হিসাব-নিকাশ করার পদ্ধতি বের করেন। তিনি একটি ছোট অক্ষর এবং একটি বড় অক্ষরের সমন্বয়ে তা করতেন যা আধুনিককালের মোর্স কোডের মত। তাঁর সমসাময়িক গণিতবিদরা সংস্কৃত শব্দ শ্যূন্যেয়া থেকে বাংলা শূন্য শব্দটি গ্রহণ করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের গণিতবিদ আর্যভট্টের একটি বইয়ে পাওয়া যায়, স্থানম স্থানম দশ গুণম। এখানে হয়তবা তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, স্থানে স্থানে দশ গুণের কথা। তবে এখানেও শূন্যের কথা লুকায়িত ছিল। শেষ পর্যন্ত শূন্যকে সংখ্যার পরিচয় দেন ব্রহ্মগুপ্ত। তার ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত নামক বইয়ে প্রথম শূন্যকে সংখ্যা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। শূন্যের সাথে যোগ, বিয়োগ, গুণের কথা এই বইয়ে সঠিকভাবে দেওয়া হয়। এছাড়া মহাবীর এবং ভাস্কর শূন্য নিয়ে কাজ করেন। তবে দুঃখের বিষয় এদের কেউ শূন্য দিয়ে কোনো কিছু ভাগের কথা উল্লেখ করেনি।