মোহাম্মদ আলী, যুক্তরাষ্ট্রের এই বক্সারকে সারা দুনিয়া জুড়ে মানুষ একজন শক্তিশালী ফাইটার হিসেবেই জানে। বক্সিং রিংয়ে তার অন্যরকম ফাইটিং স্টাইল এবং রিংয়ের বাইরে তার বুদ্ধিদ্বিপ্ত কথার জন্য তিনি তার দীর্ঘ বক্সিং ক্যারিয়ারে সফলতা পান। কিন্তু মোহাম্মদ আলী বক্সিং রিংয়ে তার পারফর্মেন্সের সাথে সাথে আমেরিকার সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে তার সচেতন উপস্থিতির কারণেই সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছিলেন। তিনি যে সময়টাতে বক্সিংয়ে সারা দুনিয়া জুড়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌছে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই আমেরিকা জুড়ে কালোরা বেশ অত্যাচারের শিকার হচ্ছিলো এবং তাদের প্রাথমিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। মোহাম্মদ আলী তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকান কালোদের পাশে ছিলেন সব সময়।
১৭ জানুয়ারি, ১৯৪২ (একজন কিংবদন্তির জন্ম)
মোহাম্মদ আলীর জন্ম ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকির লুইসভিল শহরে। জন্মের পর মোহাম্মদ আলীর নাম ছিলো ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র। তার বাবা সাইন বোর্ড অঙ্কনের কাজ করতেন এবং তার মা একজন খন্ডকালীন রাধুনী ছিলেন এবং মাঝে মাঝে বিত্তবানদের বাড়িতে ধোয়ামোছার কাজ করতেন তিনি। ক্লে এবং তার পরিবার কেন্টাকির একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত অঞ্চলে বসবাস করলেও সে সময়ে কেন্টাকির আইন অনুসারে কালোরা সাদাদের মত শহরের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ পেতো না। ফলে সে সময়ে কালোদের অধিকার অর্জনের আন্দোলন নিয়ে আমেরিকার অবস্থা বেশ অস্থিতিশীল ছিল। আর এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ক্যাসিয়াস ক্লে (পরে নাম পরিবর্তন করে মোহাম্মদ আলী রাখেন)-র মাঝে খুব গভীর ভাবে প্রভাব ফেলেছিলো।
মোহাম্মদ আলীর শৈশব সম্পর্কে তার মা অডেস্সা গ্রেডি ক্লে বলেন, “যখন সে (আলী) ছোট ছিল তখন সে কখনোই এক জায়গায় বসে থাকতো না। সব সময় এখানে ওখানে ছুটোছুটি করে বেড়াতো । সে সব কিছুই তার বয়সের আগে করে ফেলতো।”
১৭ জানুয়ারি, ১৯৫৪ ( বক্সিংয়ের শুরু)
ক্যাসিয়াস ক্লে (মোহাম্মদ আলী) তখন ১২ বছর বয়সী একজন কিশোর। তার বাবা-মা তার জন্মদিন উপলক্ষে তাকে একটি বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিলো। কিন্তু একদিন যখন ক্লে একটি স্থানীয় মেলায় ঘুরতে যায় তখন তার সেই বাইসেইকেলটি চুরি হয়ে যায়। প্রিয় সাইকেলটি চুরি হয়ে যাওয়ার পর বেশ রেগে গিয়েছিলেন কিশোর ক্লে এবং তিনি স্থানীয় থানায় গিয়ে পুলিশের একজন অফিসারকে যত দ্রুত সম্ভব তার সাইকেলের চোরকে খুজে বের করতে বলে হুমকি দিকয়েছিলেন ।
জো মার্টিন নামের সেই পুলিশ অফিসার ছিলেন একজন বক্সিং প্রশিক্ষক। তিনি ক্লেকে বলেন প্রথমে তার শিখে নেয়া উচিৎ কিভাবে মারামারি করতে হয় এবং তারপর হুমকি দেয়া উচিৎ। শেষ পর্যন্ত সেই পুলিশ অফিসার ক্লে এর প্রথম প্রশিক্ষক হয়ে যান এবং তার প্রশিক্ষণেই ক্লে এ্যামেচার লেভেলে বেশ কিছু বক্সিং টাইটেল জয় করেন।
৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০(প্রথম সোনা জিতলো ক্লে)
নিজের ১৮ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে প্রথম বারের মত অলিম্পিকে রিংয়ে নামার সুযোগ পান ক্লে। তার বক্সিং স্টাইল ও ব্যবহার দিয়ে তিনি খুব সহজেই বিশ্ব মিডিয়া এবং তার সহ-এ্যাথলেটদের মন জয় করে নেন।
বক্সিং রিংয়েও তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি লাইট হেভিওয়েট হিসেবে স্বর্ণ পদক জয় করেন। তিনি এই সোনা জিতে এতটাই গর্বিত ও আবেগাপ্লুত ছিলেন যে, ইতালিতে অবস্থান করার পুরোটা সময় জুড়ে এবং যক্তরাষ্ট্রে অবতরণ করেও তিনি সেই মেডেলটি গলায় পড়ে ছিলেন। তাকে তার নিজের শহর লুইসভিলে সম্মান সূচক গার্ড অব অনার দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অলিম্পিকে সোনা জিতলেও তার উপর কেন্টাকির কালোদের উপর বলবৎ আইন লাঘব হয়নি। এর ফলে তিনি শহরে আয়োজিত একটি অল-হোয়াইটস ডিনারে অংশ নিতে পারেননি।
পরে মোহাম্মদ আলী মন্তব্য করেছিলেন, “বক্সিং হল অনেক সাদা মানুষ একসাথে বসে দুই জন কালোর মারামারি উপভোগ করার খেলা।”
২৯ অক্টোবর, ১৯৬০(পেশাদারি বক্সারে রুপান্তর)
ইতালির রোমে অলিম্পিকে সোনা জয়ের আট সপ্তাহ পর ক্লে তার প্রথম পেশাদারি ম্যাচ জেতেন। সেখানে রিংয়ের মধ্যে তিনি তার অসাধারণ এবং অনন্য বক্সিং স্টাইলের পরিপূর্ণ প্রদর্শন করেন।
ক্লের তার নিজের খেলার স্টাইলের উপর এতটাই ভরসা ছিলো যে মাঝে মাঝে তিনি গার্ড ছাড়াই রিংয়ে নেমে জেতেন এবং পিছনের দিকে ঝুকে গিয়ে প্রতিপক্ষের আঘাত থেকে নিজেকে বাচাঁতেন। এছাড়া তিনি কোন রাউন্ডে গিয়ে ম্যাচ শেষ করবেন সেটা ম্যাচের আগেই ভবিষ্যৎবাণী করে ভক্ত এবং মিডিয়াকে অবাক করে দিতেন।
সে সময় ক্লে বেশ কঠিন কঠিন প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছিলেন যার মধ্যে ইংলিশ বক্সার হ্যানরি কুপারও ছিলেন। তিনি ক্লে -কে মাত্র একটি লেফট হুকের মাধ্যমে নক আউট করে দিয়েছিলেন। তবে ক্লে রিংয়ে তার শক্ত অবস্থান প্রথম থেকেই ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
৬ মার্চ, ১৯৬৪(মোহাম্মদ আলী’র জন্ম)
কালোদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নেতা এবং নেশন অব ইসলামের সদস্য মেলকম এক্সের সাথে ক্লে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তার ধর্মান্তর নিয়ে জোড় গুজব চলছিল আমেরিকা জুড়ে। এরপর একটি ম্যাচে লিসটনকে হারিয়ে ক্লে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেন যে তিনি ধর্মীয় আন্দোলনের একজন স্বক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেছেন।
মার্চ মাসে ক্লে এর আধ্যাতিক পরামর্শদাতা এলিঝা মোহাম্মদ তাকে মোহাম্মদ আলী নামটি প্রদান করেন। ক্লে তার দেয়া সেই নাম এবং তাদের নীতি গ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তার জনপ্রিয়তায় তা এতটুকুও প্রভাব ফেলেনি। আমেরিকান কালো মানুষেরা মোহাম্মদ আলীকে সব সময়ই একজন আপোষহীন নেতা মনে করেছেন যিনি সব সময় তাদের পাশে ছিলেন।
নিজের নাম পরিবর্তন সম্পর্কে আলী বলেছিলেন, “ক্যাসিয়াস ক্লে একটি দাসত্বের নাম। আমি আমার নাম হিসেবে এটি পছন্দ করিনি এবং আমি এটি চাইও না। আমি এখন থেকে মোহাম্মদ আলী।”
২৮ এপ্রিল, ১৯৬৭
(আলী এবং আমেরিকান সরকারের দ্বন্দ্ব)
তখন আমেরিকার সাথে ভিয়েতনামের যুদ্ধ চলছে। মোহাম্মদ আলী একদিন তার আমেরিকান আর্মিতে যোগদানের আদেশ পান। এরপর মোহাম্মদ আলী বক্সিং রিংয়ের পরিবর্তে কোর্ট রুমে সরকারের সাথে আইনী লড়াইয়ে নামেন। আলী আমেরিকার সরকারের প্রতি অভিযোগ আনেন যে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের কারনে তাকে যুদ্ধে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে সরকার। তিনি আরো অভিযোগ করেন অন্য একটি ধর্মীয় গ্রুপের উপর অত্যাচার ও অবিচার করার একটি প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারনে সরকার তাকে যুদ্ধে প্রেরণ করতে চাইছে।
আদালত মোহাম্মদ আলীর চ্যাম্পিয়নশিপের পদক কেড়ে নেয় এবং তাকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেয়ার পাশাপাশি ১০ হাজার ডলার জরিমানা করে। তিন বছর পর মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তুলে নেয়া হয়। এরপর আলী আমেরিকা জুড়ে বিভিন্ন কলেজে ভ্রমণ করেন এবং তখনকার বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে তাদের সাথে কথা বলেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে না যাওয়ার কারণ হিসেবে দেয়া আলীর একটি পাবলিক স্টেটমেন্টে আলী বলেন,“ যারা তাদের নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ের জন্য লড়াই করছে তাদেরকে দাসে পরিণত করার একটি মাধ্যম হয়ে আমি আমার ধর্ম, আমার মানুষ এবং আমার নিজের মর্যাদাহানি করতে পারবো না।”
৮ মার্চ, ১৯৭১
(শতাব্দীর সেরা লড়াই)
১৯৭০ সালে মোহাম্মদ আলী বক্সিং রিংয়ে প্রত্যার্বন করেন। ফিরে এসেই তিনি জেরি কোয়েরি এবং অসকার বোনাভেনাকে নক আউট করে দেন। আর তার পরেই তার সামনে ছিলেন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জো ফ্রেইজার।
ফ্রেইজার এবং আলীর মধ্যেকার সেই লড়াইটি শুধুমাত্র বক্সিং রিংয়ের লড়াইকে ছাড়িয়ে দুই ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বসী দুই ফাইটারের মধ্যে আদর্শের লড়াইয়ে পরিণত হয়ে যায়। লড়াইয়ের আগে আলী ফ্রেইজারকে ‘আঙ্কেল ট ‘ বলে ডাকেন।
মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আলী এবং ফ্রেইজারের মধ্যেকার সেই লড়াই আমেরিকা এবং সাড়া বিশ্বে অগণিত দর্শক উপভোগ করেছিলেন। সেই লড়াইয়ে মোহাম্মদ আলী ফ্রেইজারের কাছে হেরে যায়। এটি ছিলো আলীর প্রথম পেশাদারী ম্যাচের হার।
৩০ অক্টোবর, ১৯৭৪(শিরোপা পুনরুদ্ধার)
আলী তার হারানো চ্যাম্পিয়নশিপ পুনরুদ্ধারের সুযোগ পান যখন নতুন একজন হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জর্জ ফোরম্যানের সাথে তার খেলার সুযোগ হল। এই ম্যাচেও আলী একজন আন্ডারডগ হিসেবে রিংয়ে নামেন। কিন্তু প্রায় ৮০ হাজার দর্শকের সামনে আলী তার নতুন একটি কৌশলের মাধ্যমে জর্জ ফোরম্যানকে হারিয়ে আবারো শিরোপা পুনরদ্ধার করেন।
সেই লড়াইয়ের শেষে ফোরম্যান আলী সম্পর্কে বলেন, “আমি তাকে সর্বকালের সর্বসেরা হিংস্র বক্সার বলবো না কিন্তু সে আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ।”
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭৪(বিশ্ব তারকা)
ফোরম্যানের সাথে জয়ের ফলে আলী আবারো এই গ্রহের সবচেয়ে পরিচিত তারকায় পরিণত হন। তার ভক্তদের তালিকায় এ্যালভিস, নেলসন ম্যান্ডেলার মত বড় বড় নাম ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং জাতিগত বিদ্বেষের ফলে ঘটে যাওয়া ভুল বোঝাবোঝির অবসান ঘটাতে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড আলীকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রন জানান।
১৯৭৫ সালে আলী নেশন অব ইসলামের দিক্ষা ছেড়ে গতানুগতিক ইসলাম ধর্মে ফিরে আসেন। এরপরে আলী ঘোষণা দেন, “মানুষের গায়ের রং ঠিক করে দেয় না যে মানুষটি কেমন হবে, মানুষের হৃদয়, আত্মা এবং চিন্তা-চেতনা ঠিক করে সে কেমন হবে।”
২৭ জুলাই, ২০১২
(জীবন্ত কিংবদন্তি)
রোম অলিম্পিকে প্রথমবারের মত অলিম্পিক রিংয়ে নামার প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় পরে আবারো বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসরে ফিরে আসেন মোহাম্মদ আলী।
২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে আলীকে সম্মান সূচক পতাকা বাহকের উপাধী দেয়া হয়। কিন্তু নিজের শারীরিক অবস্থার কারনে তিনি পতাকা বহন করতে না পরলেও তার স্ত্রীর সাহায্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কিছুটা সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন মঞ্চে।