শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁদের। ব্যাট–বল হাতে তাঁরাও নেমেছেন ক্রিকেট মাঠে। তাঁরা তৈরি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরতে।
মজনু মিয়ার হাত-পা দুটোতেই সমস্যা। স্বাভাবিক কোনো কাজ করতে পারেন না। হাঁটাচলাও সমস্যা। এমন অবস্থায় অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে তাঁর চলার কথা। কিন্তু মজনু মিয়ার ‘বাধা’ হয়েছে তাঁর মায়ের একটা স্বপ্ন! মজনু মিয়া যখন খুব ছোট, যখন মা-বাবাসহ ময়মনসিংহে থাকতেন, তখনই মা আফসোস করে বলেছিলেন, ‘ইশ্, ছেলেটা যদি ক্রিকেটার হতো!’ প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে করা আফসোসটা যে আদতে একটা স্বপ্ন, তা খানিক বড় হয়েই বুঝেছেন মজনু। তত দিনে বাবা গত হয়েছেন তাঁর। মাকে নিয়ে থিতু হয়েছেন ঢাকায়। কিন্তু মায়ের স্বপ্নটা তো সঙ্গে সঙ্গেই আছে তাঁর।
অবাস্তব, অকল্পনীয় বা অসম্ভব বলে এত দিন যে ভাবনাটা ছিল, সেটা এক নিমেষে উড়ে গেছে সিআরপির (সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড) সহযোগিতায়। এখন রীতিমতো ‘ক্রিকেটার’ হওয়ার যুদ্ধে নেমেছেন তিনি। কারণ, মজনুকে ঠাঁই পেতে হবে জাতীয় দলে। সেই দল মাঠে গিয়ে লড়বেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। যাঁরা এতটুকু পড়ে সাকিব-মুশফিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলছি, এই জাতীয় ক্রিকেট দল গড়ে তোলা হবে শুধু প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে। মজনুর মতো অদম্য ক্রিকেটাররাই ঠাঁই পাবেন এই দলে। আপাতত সেই ঠাঁই পাওয়ার যুদ্ধে নেমেছেন মজনুর মতো আরও বেশ কিছু তরুণ। নিয়মিত অনুশীলন আর ব্যাট-বলের সঙ্গে এখন কাটছে তাঁদের দিন-রাত।
স্বপ্ন পূরণ করার যুদ্ধ
প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সিআরপির (পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্র) মাঠে চার-ছক্কার মেলা নামে। দূর থেকেও শোনা যায়, ‘হাউজ দ্যাট’র মতো চিৎকার। অস্ট্রেলিয়ার তামিমদের চিত্কার আর সাভার সিআরপি মাঠের চিত্কারের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু খেলোয়াড়দের মধ্যে। জনা বিশেক শারীরিক প্রতিবন্ধীকে নিয়ে প্রতিদিন এখানে চলে অনুশীলন। তারও আগে মানে ২০১৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত চলেছে বিশেষ ক্যাম্প। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রসের (আইসিআরসি) সহযোগিতায় এই ক্যাম্পে অংশ নিয়েছিলেন ২২ জন প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়। এই দলেরই একজন মো. আবদুল্লাহ। প্রায় ১৩ মাস আগে সিমেন্টের খুঁটি পড়ে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গিয়েছে তাঁর। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। দৌড়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। ১৯ বছরের তরুণ আবদুল্লাহ কিন্তু ঠিকই ক্রিকেট খেলতে পারেন। প্রশ্ন করি, কী করে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন? ‘নিজের ইচ্ছেতেই এটা সম্ভব হয়েছে। সুস্থ থাকতে নিয়মিত ক্রিকেট খেলতাম। কিন্তু অুসস্থ হওয়ার পর আর খেলা হয়নি। সিআরপিতে এসেছিলাম একটা ট্রেনিং নিতে। তারপর ক্রিকেট প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা শুনে দলে ঢুকে যাই।’ বলেন আবদুল্লাহ। ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে নামেন তিনি। কিন্তু চার-ছয় মারলেও দৌড়ে রান নিতে পারেন না। রান নেওয়ার কাজটি করে দেন রানার। তবু খেলে আনন্দ পান বলেই নিয়মিত অনুশীলনে হাজির হন তিনি। এ রকম শারীরিক প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়ের তালিকায় আরও আছেন শরিফুল ইসলাম, মো. শরীফ, অধিনায়ক মোশাররফ হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, মো. সানাউল্লাহ, মো. রুবেল, মো. হামিদুজ্জামান, হুমায়ূন কবির, খলিলুর রহমান, প্রলয় হাজং, আসাদুজ্জামান, মো. আলাউদ্দিন, আহাদুল ইসলাম, মো. মিজানুর রহমান, ইমরান হোসেন, ইসমাইল হোসেন, আবদুস সালাম, রকিবুল ইসলাম, মো. বদরুল হাসান ও সোলায়মান। কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও মেরুদণ্ডের হাড়ে সমস্যা, কেউবা পোলিও রোগে আক্রান্ত। এমন মানুষদের নিয়েই তৈরি হচ্ছে জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল।
সামনের গল্প
সামনে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্ট হবে, জানালেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কোচ ও গেম এডুকেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর রাশেদ ইকবাল। এ বছরই এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হবে ফিজিক্যাল ডিজঅ্যাবল ক্রিকেট লিগ, তার পরই ভারত থেকে আসবে একটি দল। সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে পাঁচ জাতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশ ছাড়া এ টুর্নামেন্টে খেলবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও ইংল্যান্ড। সব টুর্নামেন্টেই অংশ নেবে বাংলাদেশ জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল।
অনুশীলনে ব্যস্ত ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলও
গত বছরের ২৭ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে হয়ে গেল ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ-২০১৪। বিশ্বকাপের এই আসরে অংশ নেয় বাংলাদেশ জাতীয় ব্লাইন্ড ক্রিকেট দল। এই দলের অধিনায়ক ছিলেন হাফিজুর রহমান। বুলেট নামেই অবশ্য বেশি পরিচিত তিনি। খেলার ফলাফল সম্পর্কে শুনি তাঁর মুখেই—‘আমরা সব কটি ম্যাচই হেরেছি কিন্তু প্রতিটি ম্যাচই কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। ভারত ছাড়া বাকি দেশগুলোর বিপক্ষে সব ওভার (৪০ ওভার) ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশ দল। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আসরে খেলতে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতাও কম হয়নি।’
২০১৪ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ছাড়াও খেলেছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। বুলেট মনে করেন, আগামী বিশ্বকাপে অনেক ভালো করার সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশ দলের। ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি ব্লাইন্ড ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করছে জাতীয় ব্লাইন্ড ক্রিকেট দল।