ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির সীমার হবেন একদিন। কিন্তু কে জানত একজোড়া গ্লাভসই বদলে দেবে তার জীবনের গল্প ? বদলে দেবে তার স্বপ্নকে ?
স্ট্যান এবং জুন গিলক্রিস্ট দম্পতির চার সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ এডাম ক্রেইগ গিলক্রিস্টের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর নিউ সাউথ ওয়েলসের বেলিংএনে। ডাকনাম গিলি ও চার্চ।
ছেলেবেলা কেটেছে ডেনিলিকুইন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুও সেখানেই। স্কুলের ক্রিকেট দলের হয়ে খেলতেন এডাম।
একদিন ভিক্টোরিয়ার শেপারটন সুপার শপে মা বাবার সাথে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন গিলি। সেখানে দোকানের তাকে রাখা একজোড়া উজ্জ্বল চকচকে গ্লাভস দেখে মুঘ্দ হয়ে যান।
বাবা স্ট্যান লক্ষ করলেন তার ছেলে তাকে রাখা গ্লাভসটির দিকে তাকিয়ে আছে মুগ্ধনয়নে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না তার ফাস্ট বোলার ছেলের হঠাৎ গ্লাভসপ্রীতি শুরু হল কীভাবে ?
ছেলের মুগ্ধতা দেখে বাবা মা আবারো দোকানে ফিরে যান এবং ছেলেকে না জানিয়েই গ্লাভসটা কিনেন ছেলেকে ক্রিস্টমাসে উপহার দিবেন বলে।
এটা ছিলো গিলির জীবনের প্রথম গ্লাভস। এখান থেকেই শুরু উইকেটরক্ষক গিলির নতুন অধ্যায়ের।
দু বছরের মধ্যেই গিলি গড়েন ইতিহাস। তাঁর স্কুল দলকে নিয়ে যেতেন ট্যাবার শিল্ড নামক একটি টুর্নামেন্ট। প্রথম কান্ট্রি ক্লাব হিসেবে তাদের স্কুল টুর্নামেন্টটি জিতে ইতিহাস গড়ে। আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকেন গিলি। কারণ তিনি যে ছিলেন দলের অধিনায়ক, উইকেটরক্ষক এবং অপেনিং ব্যাটসম্যান।
১৯৮৯ সালটা সম্ভবত গিলির জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে ভিন্ন একটা কারণে। এ বছরই যে প্রথম দেখা হয় তার বর্তমান স্ত্রী মেলিন্ডা শার্পের সাথে।
ক্যাডিনা হাই স্কুলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ভালো একজন অধিনায়ক হিসেবে বেশ নামডাক ছিলো স্কুলে। আর সেখানেই মেলিন্ডাকে প্রথম দেখেন গিলি। পরিচয় এবং পরিণয়.… আজ সেই মেলিন্ডাই তাঁর জীবনসঙ্গিণী।
স্কলারশীপ নিয়ে চলে গিয়েছেইলেন ইংল্যান্ডে। সেখানে রিচমন্ড ক্রিকেট ক্লাবে খেলাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ দেশ থেকে ডাক আসলো। গর্ডন ক্রিকেট ক্লাব থেকে ডাক পড়েছিলো গিলির।
গর্ডনের তখনকার অধিনায়ক পিটার এমারি সেই তরুণ গিলিকে দলে একটা সুযোগ করে দেন। এমারির সাথে দীর্ঘ তিন মৌসুম কাটিয়ে চলে যান নর্দান ডিস্ট্রিক্টে। নর্দান ডিস্ট্রিক্টের হয়ে তার সফল কয়েকটি মৌসুম নজর কাড়তে সমর্থ হয় ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার কোচের।
ব্যাস! সরাসরি একেবারে ওয়াকাতেই অভিষেক। সফল ছিলেন সেখানেও। যদিও ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার তখনকার উঈকেটরক্ষক মার্ক ও’নীলের জায়গায় দলে ডাক পেয়েছিলেন বলে ওয়াকার দর্শকেরা ভালো ভাব নেননি দলে তার অন্তর্ভুক্তিকে। কিন্তু ব্যাট আর গ্লাভস হাতেই তাদের জবাব দিয়েছিলেন গিলি।
৯৫/৯৬ মৌসুমে সর্বোচ্চ ৫৪ ডিসমিসাল এর রেকর্ড করেন শেফিল্ড শিল্ডে।
আর তখন থেকেই জাতীয় দলের আশেপাশেই ছিলেন তিনি। শুধু অপেক্ষা করছিলেন নির্বাচকদের একটা ডাকের। অবশেষে আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
১৯৯৬ সাল। উপমহাদেশে একটি ত্রিদেশীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে এসেছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু টুর্নামেন্টে বল মাঠে গড়ানোর আগেই ইনজুরী হানা দিলো অজি শিবিরে।
ইনজুরীতে আক্রান্ত হয়ে দল থেকে ছিটকে পড়লেন ইয়ান হিলি। দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্যি উইকেটরক্ষকের ইনজুরীতে হতভম্ব ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকরা ডাক দেন তরুণ গিলক্রিস্টকে।
আর সেই যে শুরু, পরের কাহিনী একজন কিংদন্তী উইকেটরক্ষকের যিনি তার বিগ হিটিং দক্ষতা দিয়ে ইয়ান হিলির মত দর্শকনন্দিত এবং সফল উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের জায়গায় পাকাপোক্ত করে ফেলেছিলেন নিজেকে।
কিন্তু হিলির ভক্তরা কি আর সেটাকে ভালো ভাবে নিবেন? নেননি, দর্শকদের দুয়োর মুখে পড়তে হয়েছিলো গিলিকে। কিন্তু সেই দর্শকদের মনকেই জয় করেছিলেন ব্যাট হাতে।
ক্যারিয়ার শুরুতে ৬/৭ এ ব্যাট করা গিলি সাফল্য পাচ্ছিলেন না মোটেও। টানা ৬/৭ ইনিংস ৩০ এর উপরে উঠতে পারেননি। সেটা দেখে স্টিভ ওয়াহ গিলিকে নিয়ে একটু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চাইলেন। পাঠালেন অপেনিংয়ে ভাই মার্ক ওয়াহের সাথে।
প্রথম দিন ২০ রান করলেও জবাব দিয়েছিলেন এর পরের ইনিংসেই। ১০৪ বলে ১০০ রানের অসাধারণ একটি ইনিংস খেলে দিয়েছিলেন দর্শকদের দুয়োর জবাব।
এর কদিন পরেই খেলেন ১২৯ বলে ১৫৪ রানের বিদ্ধংসী একটি ইনিংস যা ছিলো অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে কোনো উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের পক্ষে সর্বোচ্চ রান (একদিনের ক্রিকেটে)।
২০০০ সাল থেকে গিলি উভয় ধারার সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। স্টিভ ওহাহ ও রিকি পন্টিংয়ের অনুপস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিতেন এডাম গিলক্রিস্ট।
টেষ্ট ও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গিলির স্ট্রাইক রেট প্রায় সর্বোচ্চ। টেষ্ট ক্রিকেটে ২য় দ্রুততম সেঞ্চুরীর মালিক এডাম গিলক্রিস্ট।
গিলি মাঠে প্রতিবাদ করার জন্য বেশ আলোচিত ছিলেন। এজন্য তাকে অনেকবার জরিমানা দিতে হয়েছে।
ইতিহাসের সেরা আক্রমণাত্মক অপেনিং ব্যাটসম্যান। যে ইতিহাস তাঁকে বানিয়েছে এডাম গিলক্রিস্ট দ্যা ” গিলি রকেট”।
পৃথিবীর অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে জিতেছেন তিনটি বিশ্বকাপ। গড়েছেন কত শত রেকর্ড। আর তাই অবসর নেওয়ার পর ও তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি তার খেলা দিয়ে ভক্তদের হৃদয়ে যে জায়গা করে নিয়েছেন সেখান থেকে তাকে হটাবার সাধ্য কার?
ব্যাক্তিগত জীবনে গিলক্রিস্ট চার সন্তানের বাবা। ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ করে যদিও রাজনীতিতে জড়াতে চেয়েছিলেন গিলি, বামপন্থীতে বিশ্বাসী গিলি শেষ পর্যন্ত আর রাজনীতিতে জড়াননি।
৯০টি টেষ্ট ম্যাচ ও ২৫০টি ওয়ানডে খেলেছেন গিলক্রিস্ট। টানা তিন বিশ্বকাপের ফাইনালে পঞ্চাশ রানের অধিক ইনিংস করার বিরল রেকর্ডের অধিকারী এডাম গিলক্রিস্ট।
এছাড়াও গিলক্রিস্ট ওয়াকিং করার জন্য বিখ্যাত। নিজেকে আউট মনে করলে আম্পায়ারের সিদ্বান্তের বিপরীতে হেটে চলে যেতেন। জীবনের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচেও শ্রীলংকার বিরুদ্ধে আম্পায়ারের নট আউট সিদ্বান্তের বিপরীতে প্যাভিলিয়নের পথ বেছে নেন এডাম গিলক্রিস্ট।