দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৪ ওয়ানডের মধ্যে ১৩ হারের বিপরীতে বাংলাদেশের জয় মাত্র একটি। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে মোহাম্মদ আশরাফুলের অনবদ্য ৮৭রানের ইনিংসে ভর করে প্রভিডেন্সে সেই একমাত্র জয়টি আসে বাংলাদেশের ঝুলিতে। সময়ের রাতে কেটে গেছে ৮টি বছর। পাল্টেছে বাংলাদেশ, পাল্টেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। আজ ঘরের মাঠে সেই দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি নতুন এক পরিণত বাংলাদেশ। তবে আশরাফুলের সেই অনবদ্য ইনিংসটি আজও স্মৃতির পটে ভাসে জ্বলজ্বল করে, দেয় অনুপ্রেরণা।২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ অনেক কারণেই স্মরণীয়।
বিশ্বকাপের প্রস্তুতিটা সেবার দারুণ হয়েছিল। জয়ের মধ্য থেকে বিশ্বকাপে খেলতে গিয়েছিলাম। রফিক ভাইকে বাদ দিলে আমাদের পুরো দলটি ইয়াং সাইড। বিশ্বকাপের আগে ওয়ার্ম আপ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়ার পর বেড়ে যায় আমাদের গুরুত্ব। যে সব দল আমাদের গোনায় ধরত না, তারা পর্যন্ত সমীহ করতে থাকে। আমাদের দলটিকে ঘিরে তাদের আগ্রহ, কৌতূহল যায় বেড়ে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের আগের দিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানজারুল রানার মৃত্যু সংবাদ পুরো দলকেই শোকাচ্ছন্ন করে ফেলে। মানজারুল আমাদের সবার প্রিয় ক্রিকেটার বলেই ওর জন্য কিছু একটা করার তাগিদ ছিল। প্রথম ম্যাচে ভারত প্রতিপক্ষ, বলতে পারেন সময়ের সেরা দল। তার ওপর ম্যাচটি ত্রিনিদাদেÑ যেখানকার আবহাওয়াও অনেকটা ভারতের মতো। ২০০৪ সালে ভারতকে ওয়ানডে ম্যাচে হারিয়েছি, সেবার তাদের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে ১৫৮ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলাম।
তাছাড়া ভারতের বিপক্ষে মাশরাফি সবসময়ই ভালো করেছে। এ কারণে অতো বড় দলের বিপক্ষে নামার আগে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। মাশরাফি (৪/৩৮), রাজ (৩/৩৮) ও রফিক ভাইয়ের (৩/৩৫) বোলিংয়ে ভারতকে ১৯১ রানে অলআউট করার পরই জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। এর চেয়ে কম পুঁজি নিয়ে ভারতের ম্যাচ জেতার অতীত আছে বলে সতর্কও ছিলাম। ওই ম্যাচে ব্যাটিং লাইনআপ এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যে, আমাকে তেমন কিছুই করতে হয়নি। ব্যাটিংয়ে যা করার করেছে তামীম (৫১), মুশফিক (৫৬), সাকিব (৫৩)। দলের জয় যখন নিশ্চিত, বাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতা তখন ৭ নম্বরে ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়েছিল আমাকে।
আমার প্রথমসেঞ্চুরি শ্রীলংকার বিপক্ষে, শ্রীলংকার বিপক্ষে অতীতে সবসময়ই ভালো খেলেছি। এটাই ছিল পরের ম্যাচে প্রেরণা। ভারতকে হারিয়ে দেয়ার পর শ্রীলংকার বিপক্ষে সেই ধারাবাহিকতা দেখাতে পারিনি আমরা। শ্রীলংকার ৩১৮/৪ স্কোরের বিপরীতে আমরা থেমেছিলাম ১১২ তে। জানেন, ওই ম্যাচেও আমাকে ৭ নম্বরে পাঠানো হয়েছিল। দলের স্কোর যখন ৪১/৫, তখন ব্যাটিংয়ে নেমে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন ছিলাম (৪৫)। ওই ম্যাচে আমার ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় পরের ম্যাচ থেকে ৫ নম্বর নির্ধারিত হয়ে যায়। সুপার এইটে উঠতে হলে বারমুডাকে হারাতে হবে। কিন্তু শঙ্কা ছিল যথেষ্ট। দফায় দফায় বৃষ্টিতে টার্গেট বারবার পরিবর্তন হচ্ছে। কপালটা ভালো বলেই টসে জিতেছিলাম।ফলে চেজ করতে কঠিন হয়নি।
বাংলাদেশ দলের অমঙ্গল কামনায় ওই ম্যাচে বারমুডার হয়ে সমর্থন করেছে ভারতের সমর্থকরা। ২১ ওভারে নেমে আসা সেই ম্যাচে বারমুডার ৯৫’র চ্যালেঞ্জটা কঠিন করতে দেইনি আমি-সাকিব। ৫৯ রানের অবিচ্ছিন্ন পার্টনারশিপ ছিল আমাদের। এই ম্যাচেও নটআউট, খুব বেশি নয়, মাত্র ২৯ রানের ইনিংসেই পেয়েছি ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার। সেবার বিশ্বকাপের ফরমেটটা এমন ছিল যে, কঠিন গ্রুপে পড়ে মাত্র ১ সপ্তাহের মধ্যে আসর থেকে বিদায় নেয়ার শঙ্কা ছিল আমাদের। এই ম্যাচটি জিততে না পারলে সুপার এইটে উঠতে পারতাম না। সুপার এইটের প্রথম ২টি ম্যাচ ছিল এন্টিগায়।
অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পর পর ২ ম্যাচ যাচ্ছেতাই খেলেছিÑ আমার ব্যাটিংও ছিল যাচ্ছেতাই (৬ ও ৩ রান)। সুপার এইটের ৬ ম্যাচের ২টি এভাবে কেটে যাওয়ায় ভালো খেলার জিদটা চেপে গিয়েছিল। সেই জিদটা দেখাতে পেরেছি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। এন্টিগা থেকে গায়ানায় গিয়ে দেখি অন্য চেহরা, এ তো দেখি বাংলাদেশ! উইকেট,আউটফিল্ডÑ সব কিছু আমাদের চেনা-জানা! মাঠে যারা খেলা দেখতে এসেছেন তারা সবাই আমাদের সমর্থক।
প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ওয়ানডেতে আইসিসির নাম্বার ওয়ান। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৩৫ চেজ করে জিতে খেলতে এসেছে তারা বিশ্বকাপে! লম্বা ব্যাটিং সাইডে স্মিথ, বাউচার, গিবস, ক্যালিস আর বোলিংয়ে পোলক,এনটিনি, নেল, ক্যালিস, ল্যাঙ্গাভেল্ট, ক্যাম্প। এমন একটি দলের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ২৫১’র পরও তো স্বস্তিতে থাকার কথা নয়। তারপরও বলব, ৮৪/৪ থেকে যখন স্কোর ২৫১/৮ পর্যন্ত টেনে নিতে পেরেছি, তখন থেকেই জয়ের আবহ পেয়েছি আমরা। আফতাবের সঙ্গে দারুণ বোঝাপড়া ছিল আমার অনেক আগে থেকেই।
কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়া এবং বগুড়ায় শ্রীলংকার বিপক্ষে দারুণ সঙ্গ দিয়েছে সে। বিশ্বকাপের সুপার এইটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচেও সেই বোঝাপড়াটা ছিল দারুণ। ৫ম জুটিতে আমরা যোগ করেছিলাম ৭৬, সেখানেই এগিয়ে গেছি আমরা। মনে আছে জাস্টিন ক্যাম্পকে এক ওভারে লং লেগ এবং মিড উইকেটের উপর দিয়ে দারুণ ২টি ছক্কা মেরেছে আফতাব সেই ম্যাচে।
ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনটি সেঞ্চুরি আছে আমার। যার মধ্যে আছে ২০০৫ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ উইনিং ইনিংস। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম বলে লাইফ পেয়ে ৯৪ রানের ইনিংসটিকে অনেকে মনে রেখেছেন এখনো। তবে আমার নিজের কাছে সেরা ইনিংস টিকিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে৮৩ বলে ৮৭ রানের স্কোর। প্যাডেল স্কুপটা আগেই শিখেছিলাম, নর্দাম্পটনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেখিয়েছি তা। তবে এই শটটির উদ্ভাবক হিসেবে আমার নামটি যখন কেউ উচ্চারণ করে, তখন উঠেআসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ইনিংসটির কথা। ক্যালিসকে এক ওভারে পর পর ২ বলে ফাইন লেগএবং স্কোয়ার লেগ।