চিনির মজাদার স্বাদ অনেকেরই খুব প্রিয়। এমন অনেকেই আছেন যারা চিনি বা চিনির তৈরি মিষ্টি খাবার ছাড়া একদিন ও চলতে পারেন না। কিন্তু তাদের জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে চিনি কারোরই বন্ধু নয়। চিনিতে থাকা কিছু হরমোন আপনার মস্তিস্কে চিনিপ্রীতি সৃষ্টি করলেও মূলত চিনি আমাদের দেহের জন্য শত্রুই। আধুনিক গবেষণায় দেখা যায় যে চিনি এবং চিনির তৈরি খাবার আমাদের স্বাস্থ্যের উপর বিধ্বংসী পদক্ষেপ নেয়।
আমরা যদি বিগত ৩০০ বছরে মানুষদের চিনি খাওয়ায় প্রবণতার দিকে নজর দিই তাহলে দেখা যায়-
১৭০০ সালের দিকে প্রতি বছর একজন মানুষ গড়ে প্রায় ৪ পাউন্ড চিনি খেত।
১৮০০ সালের দিকে প্রতি বছর একজন মানুষ গড়ে প্রায় ১৮ পাউন্ড চিনি খেত।
১৯০০ সালের দিকে একজন মানুষের চিনি খাওয়ার পরিমান বেড়ে গড়ে প্রায় ৯০ পাউন্ডে চলে আসে।
২০১২ সালের দিকে গড়ে প্রায় ৫০% মানুষ প্রায় আধা পাউন্ডের মত চিনি খায় প্রতিদিনে। যা বছরে প্রায় ১৮০ পাউন্ডের মত গিয়ে দাঁড়ায়।
১৮৩০ সালের দিকে প্রতি এক লক্ষ মানুষের মাঝে মাত্র ৩ জনের ডায়াবেটিস থাকতো। আর ২০১২ সালের দিকে প্রতি লক্ষ মানুষের মাঝে প্রায় ৮০০০ মানুষেরই ডায়াবেটিস আছে।
খাবারে চিনির উৎস- ১৯০০ সাল থেকে প্রায় ১০ গুন বেশি চিনি খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে এখনকার ছেলে মেয়েদের মাঝে। জেনে অবাক হবেন যে দেহে চিনির প্রভাব কোকেনের চেয়ে ১০ গুন বেশি মারাত্মক। চিনি ডোপামিন নামক একটি রাসায়নিক উপাদান উৎপন্ন করে যা মস্তিস্কে সুখি এবং ভালো একটি নেশার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। অনেক গবেষণায় দেখা যায় যে চিনি হচ্ছে একটি ক্যান্সার কোষ উৎপাদক খাবার। তাই এটি হচ্ছে আরো একটি কারন এই সাদা রঙের মৃত্যু খাবারটি থেকে দূরে থাকা।
কোন কোন খাবারে চিনি থাকে
সাদাচিনি, লাল চিনি, ম্যাপল সিরাপ, গুড়, হাই ফ্রুক্টোজ কর্ণ সিরাপ এসব উপাদানের যেকোনো একটি যে খাবারে থাকে সেগুলোতে চিনি থাকে। এছাড়া সাদা পাউরুটি, চিপস, মাফিন, সাদা ভাত, পাস্তা ইত্যাদির খাবারগুলো শেষ পর্যন্ত আমাদের দেহের গিয়ে চিনিতেই রুপান্তরিত হয়। বেশির ভাগ শক্তিদায়ক পানীয় বা খাবার গুলোতে উচ্চ মাত্রার চিনি থাকে। এছাড়া প্রাকৃতিক মিষ্টি খাবার যেমন ম্যাপল সিরাপ বা মধু ইত্যাদিতেও প্রায় চিনির সমানই ঝুকি থাকে। অনেকেই হয়তো ভাবেন ঝাল জিনিস খেলে হয়তো চিনি খাওয়া হয়না। কিন্তু এমন অনেক খাবার আছে যেগুলোতে চিনির উপস্থিতি আমরা হয়তো জানিই না। জেনে অবাক হবেন যে এক টেবিল চামচ কেচাপে প্রায় এক চামচ চিনি থাকে। এছাড়া কেক, বিস্কিট, চকলেট, ক্যান্ডি কোথায় নেই চিনি। বিশেষ করে বেশি পরিমান ফাস্ট ফুড, বিভিন্ন চিনি যুক্ত পানীয়, সফট ডিঙ্কস ইত্যাদির আসক্তি দেহের ক্যালরির পরিমান বাড়িয়ে দেয়।বেশির ভাগ এসব খাবার গুলোতেই ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ একসাথে আবদ্ধ থাকে না। তাই এগুলোকে দেহে ভাঙনের দরকার হয়না। আর ফ্রুক্টোজ দেহে দ্রুত শোষিত হয়ে সরাসরি লিভারে চলে যায় এবং সেখানে তা ফ্যাটে পরিনত হয়।
দেহে চিনির ক্ষতিকর প্রভাব
যখন আমরা বেশি চিনি যুক্ত বা শর্করা জাতীয় খাবার খাই তখন আমাদের রক্ত চিনি মিশে গিয়ে রক্তের শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করে। অগ্নাশয় থেকে ইন্সুলিন নিঃসৃত হয়। যত বেশি চিনি গ্রহণ করা হবে তত ইন্সুলিন বেশি নির্গত হবে। সাধারণত ইন্সুলিন আমাদের দেহের চিনিকে রক্ত প্রবাহে হয় শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে বা চর্বি হিসেবে সংরক্ষণ করে। শরীরে অতিরিক্ত পরিমান ইন্সুলিন উৎপাদন দেহের ওজন বৃদ্ধির জন্য দায়ী বিশেষ করে পেটের মেদ। ইন্সুলিন এবং চিনির এই সংযোগ জানার পর আমাদের শরীরের গঠনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এড়াতে চিনি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরী।
তাই দেহে অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার কি কি খারাপ প্রভাব পড়তে পারে সে সম্পর্কে কিছুটা জানা প্রয়োজন সবারই-
- প্রতিরোধক ক্ষমতাকে দমন করে
- মেজাজ নিয়ন্ত্রণে না থাকা, বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, মনোযোগে সমস্যা
- ট্রাইগ্লিসারাইডের অতিরিক্ত উৎপাদন
- ভালো কোলেস্টেরলের(HDL)উৎপাদন হ্রাস এবং খারাপ কোলেস্টেরলের(LDL) উৎপাদন বৃদ্ধি
- উচ্চ রক্তচাপ ও কোরোনারী হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ায়
- দাঁতের ব্যাথার সৃষ্টি
- খাবারের আগের রক্তের শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বাড়ায়
- ওজন বৃদ্ধি করে ও স্থূলতার ক্ষেত্রে বড় ভুমিকা রয়েছে।
- বার্ধক্যের প্রক্রিয়াকে দ্রুত করে বলিরেখা এবং চুল সাদা করার মাধ্যমে
- ফ্যাটি লিভার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়
- স্তন, কোলন, প্রোস্টেট ক্যান্সারসহ বেশ কিছু ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
তবে শেষকথা হচ্ছে সুস্থ থাকতে চাইলে চিনি আপনার উপর নিয়ন্ত্রণ করার আগেই আপনি চিনির খাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ আনুন। যদি আপনার মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস থেকেই থাকে তাহলে আস্তে আস্তে পরিবর্তনের চেষ্টা করুন। এর পরিবর্তে খেজুর, মিষ্টি ফল, কিশমিশ, নারিকেলের দুধ, দারুচিনি ইত্যাদি খেতে পারেন।