বিশ্বব্যাপী নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত এটি। উচ্চ রক্তচাপে হার্ট এ্যাটাক, ব্রেন এ্যাটাক, হৃদরোগ, কিডনি বিকল এবং অন্ধত্ববরণের শিকার হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ আক্রান্ত হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপে। সারাবিশ্বে প্রায় দেড় শ’কোটি লোক উচ্চ রক্তচাপের শিকার এবং প্রতিবছর এ রোগে মারা যায় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশেও উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ ও স্ট্রোকের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২ দশমিক ৫ ভাগ হৃদরোগে এবং ২ ভাগ স্ট্রোকে আক্রান্ত। আর হৃদরোগে আক্রান্তের শতকরা ৭ দশমিক ৭ ভাগ রোগী এবং স্ট্রোকে আক্রান্তের শতকরা ৮ দশমিক ৯ ভাগ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকে। এর চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। তাই যেকোন উপায়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, রক্তনালী বা ধমনীর দেয়ালের বিপরীততে রক্ত প্রবাহের ধাক্কাকেই রক্তচাপ বলে।
রক্তচাপ খুব বেড়ে গেলে তা হৃদপিণ্ডের কাজ অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি করে। ১২০/৮০-এর অধিক রক্তচাপকে উচ্চ রক্তচাপ বলে। ওপরের মাত্রাটিকে সিস্টোলিক চাপ বলে, যা হৃদযন্ত্রের স্পন্দনের সময়কার রক্তচাপ। নিচের মাত্রাকে ডায়াস্টোলিক চাপ বলে, যা হৃদস্পন্দনের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের রক্তচাপ যখন হৃদযন্ত্রে রক্ত এসে জমা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপের কারণ জানা যায় না। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনকে নীরব ঘাতক বলা হয়।
বছরের পর বছর এটি উপসর্গহীন থাকতে পারে। প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন জানে না যে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। এটি হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, রক্তনালী, মস্তিষ্ক এমনকি কিডনিরও ক্ষতি করতে পারে, যদি এর চিকিৎসা না করা হয়। যাদের রক্তচাপ ক্রমাগতভাবে স্বাভাবিক মাত্রার সামান্য ওপরে থাকে; অর্থাৎ সিস্টোলিক মাত্রা ১২০ থেকে ১৩৯ এর মধ্যে এবং ডায়াস্টোলিক মাত্রা ৮০ থেকে ৮৯ এর মধ্যে থাকলে তাকে প্রি-হাইপারটেনশন বলে। এদের উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হবার ঝুঁকি অনেক বেশি।
চিকিৎসকেরা তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে রক্তচাপ কমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। গড়ে রক্তচাপ ১৪০/৯০ বা এর ওপরে থাকলে কোন উপসর্গ না থাকলেও ধরে নিতে হবে, আপনি রক্তচাপে ভুগছেন। রক্তচাপ ১৮০/১১০ বা এর ওপরে হলে তা উচ্চ রক্তচাপের বিপজ্জনক পর্যায়, অস্থির না হয়ে এ অবস্থায় কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার রক্তচাপ মাপুন। এর পরও রক্তচাপ বেশি থাকলে দ্রুত হাসপাতালে যাবার জন্য এম্বুলেন্স ডাকুন। এই অবস্থা থেকে হার্ট এ্যাটাক, কিডনি ফেইলিয়র, জ্ঞান হারানোর মতো মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও অসহ্য মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, নাক দিয়ে রক্তপাত, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
আইসিডিডিআরবি-এর গবেষণায় বলা হয়, তুলনামূলকভাবে বেশি বয়সী, অধিক শিক্ষিত এবং ধনীদের মধ্যেই সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বেশি দেয়া যায়। উচ্চ রক্তচাপের সন্তোষজনক ব্যবস্থাপনা উচ্চ রক্তচাপের কারণে সৃষ্ট জটিলতা এবং মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে। হৃদরোগ সৃষ্টি, স্ট্রোক এবং কিডনি অকার্যকর করার পেছনে উচ্চ রক্তচাপ একটি বড় ধরনের ঝুঁকি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন , ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং কায়িক পরিশ্রমের অভাব- এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করলে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকজনিত শতকরা ৮০ ভাগ মৃত্যু এড়ানো সম্ভব। অধিকাংশ ব্যক্তি যতক্ষণ জেগে থাকে তার অর্ধেকেরও বেশি সময় কর্মক্ষেত্রে কাজের মধ্যে থাকে। সেজন্য স্বাস্থ্যকর কর্ম পরিবেশ একান্ত দরকার। খেতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। ধূমপানকে ‘না’ বলতে হবে। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। লবণ কম করে গ্রহণ করতে হবে। হৃদরোগ প্রতিরোধে সারাদেশে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বাড়াতে হবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম। হৃদরোগ চিকিৎসাসেবা বাড়াতে হবে। দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা হাঁটতে হবে (সকালের চেয়ে সন্ধ্যায় হাঁটা উত্তম)। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। ওজন কমানোর সঙ্গে সঙ্গে মানসিক চাপ পরিহার করতে হবে। যেসব পরিবারের মা-বাবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের ইতিহাস আছে, তাদের সন্তানদের উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই বিশ বছর বয়সের পর প্রতি বছরই ওই পরিবারের সন্তানদের ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা করা উচিত। আর যারা ইতোমধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তাদের উপরোক্ত পরামর্শ মানা ছাড়াও প্রতি তিন মাস পর পর হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার জানান, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হাসপাতালের সেবা প্রাপ্তদের শতকরা ১৫ দশমিক ৫৬ ভাগ উচ্চ রক্তচাপের রোগী। ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সের রোগীরাই অধিক হারে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে হাসপাতালে আসেন। ১৯ বছরের নিচে শিশু-কিশোরদের মধ্যেও ইদানিং উল্লেখযোগ্য হারে উচ্চ রক্তচাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের প্রধান কারণ হলো পরিবর্তিত জীবনাচরণ অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস এবং স্থূলতা। এছাড়াও তাদের উচ্চ রক্তচাপের জন্য পারিবারিক ইতিহাস, ডায়াবেটিস, কিডনির রোগও কম দায়ী নয়।