শীমের ইংরেজী নাম Bean। শীতকালে দেশী শিম খুবই জনপ্রিয় সবজি। শীত মৌসুমের শুরুতেই সরবরাহ কম থাকায় দাম থাকে চড়া। আমিষ সমৃদ্ধ এই শিম তরকারি হিসেবে দু’ভাবে খাওয়া হয়। দেশী শিম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শীতকালীন সবজি। এটি পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং সব শ্রেণীর লোকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। শিমের কচি শুঁটির বীজে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও শ্বেতসার থাকে বলে খাদ্য হিসেবে খুবই উপকারী। তা ছাড়া এতে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ থাকে। আমাদের দেহের পুষ্টি সাধনে এসব পুষ্টি উপাদানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিম সব ধরনের মাটিতেই চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি দেশী শিম চাষের জন্য বেশি উপযোগী। পানি জমে না এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি শিম চাষের জন্য বেছে নেয়া ভালো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিটিউট উদ্ভাবিত দেশী শিমের জাত বারি শিম-১ ও বারি শিম-২ চাষের জন্য বেশ ভালো। এ ছাড়া বারমাসী সাদা ইপসা-১ ও বারমাসী বেগুনি ইপসা-২ জাত দুটিও প্রায় সারা বছর চাষ করা যায়।
শিম (Bean) সাধারণভাবে শিম, বরবটি ইত্যাদি নামে পরিচিত লিগিউম জাতের (leguminous) উদ্ভিদ বা তাদের বীজ। সারা পৃথিবীতে নানাজাতীয় শিমের চাষ হয়। এগুলি মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্য। মানুষের খাদ্য হিসেবে যেসব শিম ব্যবহূত হয় সেগুলি প্রায় ১৪টি গণের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে অন্তত ২৮টি প্রজাতির শিম বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিমের বীজ সাধারণত বৃক্কাকার (kidney-shaped) এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ।
দেশী শিম (Country bean) দেশের সর্বত্র ফলানো শীতকালীন সবজি প্রজাতি Lablab niger। এর শুঁটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন ও ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ। সাধারণত ১৫-২০ দিনের চারা জুন-আগস্ট মাসে মাঠে লাগিয়ে ৮০-৯০ দিন পর ফসল তোলা হয়। হেক্টর প্রতি গড়ে ১০-১২ মে টন শিম ফলে। প্রধানত সবজি হিসেবে ব্যবহার্য। কাঁচা শিমের জন্যই এর চাষ হয়। শুকনো বীজ দিয়ে নানা খাবার তৈরি হয়।
ফ্রেঞ্চ বিন (French bean) শিমের অন্যতম প্রজাতি Phaseolus vulgaris, স্থানীয়ভাবে নানা নামে পরিচিত। এসব নামের অধিকাংশই শুধু প্রজাতির মধ্যেকার নির্দিষ্ট প্রকারগুলির (ভড়ৎসং) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, প্রকারের গোটা লহরীর জন্য নয়। স্নাপবিন, সালাদ বিন, গ্রীন বিন, কিডনি বিন, হ্যারিক্ট বিন ইত্যাদি সবজি হিসেবে ব্যবহার্য জাতগুলির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, আর ডাল হিসেবে ব্যবহার্যগুলি হলো ড্রাইবিন, নাভাল বিন ইত্যাদি। বাংলাদেশে ফেঞ্চ বিনের চাষ না হলেও বাড়ির সবজি বাগানে প্রায়ই লাগানো হয়। বর্ষজীবী এই লতানো বা খাড়া গুল্মের মুখ্য মূল দ্রুত এক মিটার গভীরে পৌঁছে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে। লতানো জাতের কান্ড ১-৩ মিটার লম্বা, তাতে ১৫-৩০টি লম্বা পর্ব। পাতাগুলি একান্তর, ত্রিপত্রিক, কিছুটা রোমশ, দীর্ঘবৃন্তক; উপপত্র ক্ষুদ্র; পত্রিকা ডিম্বাকার, অখন্ড, দীর্ঘ। ফল সাধারণত সরু ও লম্বা, ৫-৭ বীজীয়। অঙ্কুরোদগম মৃদভেদী।
কচিফল ও পাকা শুকনো বীজের জন্যই ফ্রেঞ্চ বিনের চাষ হয়। অনেক প্রজাতির জাবপোকা (aphid) ও পাতার শোষক পোকা (leafhopper) শিমের ক্ষতি করে। সাধারণ রোগের মধ্যে অ্যানথ্রাকনোজ, রাস্ট, মোজাইক ও গোড়াপচা উলে¬খযোগ্য। [নিশীথ কুমার পাল]
বরবটি (Yard-long bean) দীর্ঘ কান্ডবিশিষ্ট লতানো সবজি উদ্ভিদ Vigna sesquipedalis। এর লম্বা, সবুজ অথবা বেগুনি রঙের শুঁটি ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’, ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ। সম্ভবত দক্ষিণ চীন অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর আবাদ প্রথম শুরু হয়। মার্চ-এপ্রিল বরবটি চাষের সর্বোত্তম সময়। বীজ বপনের পর থেকে ৪৫-৫০ দিনের মধ্যেই ফসল সংগ্রহ করা যায়। বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি গড় ফলন ১০-২০ মে টন। বরবটির পাতা থেকে খড় ও সবুজ সার পাওয়া যায়। [এ.কে.এম মতিয়ার রহমান]
শিমের পুষ্টি উপাদান :
আহার উপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম কচি শুঁটিতে
- পানি ৮৫ গ্রাম,
- খাদ্যশক্তি ৪৮ কিলোক্যালরি,
- আমিষ ৩ গ্রাম,
- শর্করা ৬.৭ গ্রাম,
- চর্বি ০.৭ গ্রাম,
- খনিজ লবণ ০.৪ গ্রাম,
- ভিটামিন বি-১,
- ভিটামিন বি-২,
- ভিটামিন সি,
- ক্যালসিয়াম ২১০ মিলিগ্রাম,
- লৌহ ১.৭ মিলিগ্রাম,
- ক্যারোটিন ১৮৭ মাইক্রো মিলিগ্রাম এবং
- আঁশজাতীয় উপাদান বিদ্যমান।
পরিপক্ব শুঁটিতে পানি কম থাকে এবং কিছু উপাদান বেশি থাকে। যেমন শ্বেতসার ৬০ গ্রাম, আমিষ ২৫ গ্রাম, স্নেহ ০.৮০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৬০ মিলিগ্রাম, তাপশক্তি ৩৪০ কিলোক্যালরি।
রোগ প্রতিরোধে শিম
সহজলভ্য সবজি শিম সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও আমিষের একটি ভালো উৎস। অতি উপকারী এ সবজি শিম সব দেশেই জন্মে। গবেষণায় জানা গেছে, শিম অন্ত্রের ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপদানগুলোকে মানুষের শরীর থেকে বের করে দিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এতে রয়েছে সিলিকন জাতীয় উপাদান। এ উপাদান হাড়কে মজবুত করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফলেট। এ উপাদান গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিশেষ উপকারি। শিমে থাকা ফ্ল্যাভেনয়েড শরীরে ফ্রি র্যা ডিকেলস তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এ সবজি হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও বন্ধুর ভূমিকা পালন করে। কারণ এতে আছে ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট। মানুষের ত্বককে সজীব রাখে এর জিঙ্ক। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে নিয়মিত শিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান বের করতে পর্যাপ্ত পরিমাণে শিম খেতে হবে। শিমের পরিপক্ব বীজে প্রচুর আমিষ ও স্নেহজাতীয় পদার্থ আছে। শিমগাছ শিকড়ের সাহায্যে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে মাটিকে উর্বর করে।
শিম ভাজি করে খাওয়া যায়, মাছ দিয়ে তরকারি রান্না করেও খাওয়া যায়। শিম ভর্তাও বেশ মুখরোচক খাবার। এটি রুচিবর্ধক খাবার। শিমের পাকা বা শক্ত বিচিও বেশ মুখরোচক। যা ভেজেও খাওয়া যায়। শিমের রয়েছে নানা জাত। নলডগি শিমই বেশি প্রিয়। এর দামও বেশি। বড় মাছ এবং শিমের বিচি একসঙ্গে রান্না করলে তা যেমন সুস্বাদু হয়, তেমনি এর উপকারও অনেক। অতএব পরিমিত শিম খান, সুস্থ থাকুন।
উপকারিতা
আঁশজাতীয় অংশ খাবার পরিপাকে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ডায়রিয়ার প্রকোপ কমায়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, যা প্রকারান্তরে হৃদরোগের ঝুঁঁকি হ্রাস করে। পাকস্থলি ও প্লিহার শক্তি বাড়ায়, শরীরের ভেতরের গরম ভাব দূর করে। লিউকোরিয়াসহ মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে, শিশুদের অপুষ্টি দূরীভূত করে। মাছসহ বিভিন্ন খাবারের ফুড পয়জনিং প্রতিরোধী অ্যান্টিডোট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। শিমের ফুল রক্ত আমাশয়ের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়।
সতর্কতা : শিমে সামান্য পরিমাণে ক্ষতিকর সায়ানোজেনিক গ্লুকোসাইড আছে। কাজেই শিম পরিমাণে খুব বেশি খাওয়া উচিত নয়। শুকনো শিমে এ উপাদানের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি। তাই শিমের শুকনো বিচি রান্না করার সময় অবশ্যই একবার পানি পরিবর্তন করা উচিত। শিম খেলে অনেক সময় বমি বমি ভাব হতে পারে।