Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Entertainment Image

মাটির তলে চুপচাপ বসে আছে স্বাধীনতা জাদুঘর



শিখা চিরন্তন পার করেই এক দৃঢ় আলোকস্তম্ভ। এই শহরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পেরিয়ে অনেকটা পথ গিয়েও যার আলো চোখে পড়ে সন্ধ্যারাতে। সেই স্তম্ভের পাশেই জাদুঘর। স্বাধীনতা জাদুঘর। আন্ডারগ্রাউণ্ডে ঢোকার পথে মনে হয় এই জাদুঘর এইখানে বেশ চুপিসারেই পড়ে আছে। এতো চুপচাপ সব। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে টেরাকোটা ম্যুরালের নিচে ভূগর্ভে এ জাদুঘরের অবস্থান। ম্যুরালের নিচে কিছুটা পথ হেঁটে গেলেই জাদুঘরে প্রবেশের দ্বার।

প্রথম যে ঘর তাতে চৌকোণো গ্লাসের ফ্রেম কোণাকুণি বসানো বেশ কয়েকটা, যেন বই-এর একেক পাতা খোলা। আর পাতার উপরই লিখে রাখা ইতিহাস। খানিকটা আমাদের ঐতিহ্যের কথাও। সেই উয়ারী বটেশ্বর, রুপবান মোড়া, বৌদ্ধ বিহারের পোড়ামাটির ফলক, ভোজ রাজার ঢিবি, মুগল আলম, কিংবা শাহবাগ কি করে ‘শাহবাগ’- এইসমস্ত কিছু পড়তে পড়তে একেক পর্ব পার হয়ে যাওয়া চলে। আছে বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় উঠে আসা স্বাধীনতা সংগামের ইতিহাসের কথা। যেমন- ৮ মার্চ সংবাদ পত্রিকার মূল শিরোনামে ছিল ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম : মুজিব’। কায়েদে আজমের বক্তৃতার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। স্থান পেয়েছে ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কাছে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিপরিষদের কৃষি ও বনমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের শপথ গ্রহণের সেই দুর্লভ ছবি। আছে ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবসে ঢাকার নবাবপুর রোডে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের শোভাযাত্রার ছবি।


কিংবা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা সেসময় কি খবর ছেপেছিল তার দুর্লভ সব সংগ্রহও। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পোস্টারগুলোও সাঁটা আছে যাতে ধরে ধরে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যরীতি।

কোনো ফ্রেমের এক পিঠে ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময় মহাত্মা গান্ধীর ছবি আর অপর পিঠে অটিয়া মসজিদের চিত্র। সূর্যসেন, প্রীতিলতা, রবীন্দ্র-নজরুল, নীল বিদ্রোহ, ফকির আন্দোলন, ক্ষুদিরাম দেখতে দেখতে পড়তে পড়তে ৭-ই মার্চ আর ২৬শে মার্চে এসে দাঁড়াই। অতঃপর বিশাল দেয়ালজুড়ে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সেই ছবিটা, বিস্তৃত এক ইতিহাস নিয়ে দাঁড়ানো।
পরের পথটুকুর ভাবনা আপনাকে চমকে দিতে পারে। প্রশংসার যোগ্য কাজ করেছেন ডিজাইনার নিঃসন্দেহে। এরপরের পথে কালো টাইলস বিছানো, দেয়ালজুড়ে অন্ধকার! হবে নাই বা কেন, এখানে যে তুলে রাখা হয়েছে ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময়জুড়ে ঘটে যাওয়া গণহত্যা, ধর্ষণ আর বিপর্যয়ের চিত্র। এ অংশের নাম তাই ‘ব্ল্যাক-জোন’।


ব্ল্যাক-জোনের মাঝ বরাবর উজ্জ্বল এক কক্ষ আর বৃত্তাকার ফোয়ারা। তারপর সমস্তই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আর আন্দোলনের গল্প। আবার সেই চৌকো ফ্রেমে আমাদের সংবাদ বুলেটিন কিংবা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ কি করে বিস্তৃত তাই লেখা। আমাদের সেক্টর কমান্ডারদের ছবি কিংবা বীরমাতাদের দুর্লভ তথ্যসমৃদ্ধ ছবিও সংগ্রহ করা হয়েছে এখানে। দেশ-বিদেশের শিল্পীরা কার্টুন এঁকে যে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তার দুর্লভ চিত্রগুলোও সযতনে জমিয়ে রাখা হয়েছে এই জাদুঘরে।

তবে ঘুরতে ঘুরতে মনে হল কেউ বলেই যাচ্ছে ইতিহাস শুধু শুনতে পাওয়ার মতোন লোক জুটেছে মোটে দু-একজন। এর মধ্যে ১০-১২ বছরের এক কিশোরও হাঁটছিলো। রাতুল নামের ছেলেটা মা-র মুখেই শুনে জাদুঘরের কথা। মুক্তিযুদ্ধে আত্মসমর্পণের ছবিটা দেখে বলে এটা বইতে আছে আর ঐতিহাসিক সেই টেবিলটা দেখতে পাওয়ার বিস্ময় ছিল ওর দুটো চোখে।


অনেকে জানেনই না এখানে জাদুঘর আছে। যে দু-তিনজন তারাও ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছেন, দেখে যাচ্ছেন। অনেক জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে এখনো, কাজ হবে, হচ্ছে। জেনেছিলাম প্রজেক্টরে একটা ভিডিও দেখানো হয়, কিন্তু খুঁজে পেলাম না। পরে জানা গেল আপাতত প্রজেক্টর নষ্ট, সারাতে দেওয়া হয়েছে। এখনো তেমনভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি কর্মকর্তা-কর্মচারী। জাতীয় জাদুঘরের সহকারী কিপার মোঃ মনিরুল হক দেখাশোনার মূল দায়িত্বে আছেন। জানালেন – লাইটের কাজ বাকি কিছু। বৃষ্টির পানি পড়ার সমস্যাটা হচ্ছে ইদানীং, এটা সারাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখনো তো প্রচার তেমন করা হয়নি।

উদ্বোধনের সময় সংবাদ সম্মেলন হল তখনই যাদের চোখে পড়েছে এই আর কি। তবে পরিকল্পনা আছে আরও কিছুটা কাজ এগোলে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এসে দেখানোর কাজ হাতে নিবো আমরা। এতে মানুষ জানবে নিশ্চয়।


স্বাধীনতা জাদুঘর খোলা থাকে শনিবার থেকে বুধবার, সকাল ১০:৩০ মিনিট থেকে বিকাল ৫:৩০ মিনিট পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা অবধি। বৃহস্পতিবার বা অন্যান্য সরকারী ছুটির দিন জাদুঘরটি বন্ধ থাকবে।
প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ইতিহাসে জায়গাটির নাম লেখা রয়েছে বহুবার। এখানেই ইতিহাস ধরে রাখার এক প্রচেষ্টার নাম ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’। ২০১৫তে বাংলাদেশের ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় এ জাদুঘর।

হ্যাঁ, দুপুর শেষের রোদ মাথায় নিয়ে বের হয়ে আসতে আসতে আমিও ভাবছিলাম নিশ্চয় জানবে মানুষেরা। আসবে নিশ্চয় কেউ কেউ আড্ডার ফাঁকে, বন্ধুরা এক সাথে অথবা উজ্জ্বল মুখের শিশুদের সাথে নিয়ে।