চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যে প্রতিষ্ঠানটি সবচাইতে বেশি পরিচিতি ও খ্যাতি কুড়িয়েছে তা হলো হলিউড। আমেরিকার চলচ্চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু হলিউডের প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রেই সেই পুরনো আমল থেকে লেগে আছে খানিকটা ভিন্নতার ছোঁয়া।
নানা সময়ে নানারকম রূপধারণ করলেও হলিউড নিজেকে সাজিয়েছে চলচ্চিত্রের প্রায় সব ধারাতেই। এর ভেতরে যেমন রয়েছে ওয়েস্টার্ন, যুদ্ধভিত্তিক কিংবা সাইকো থ্রিলার ঘরানার চলচ্চিত্র, তেমনি রয়েছে রোমান্টিক, কমেডি কিংবা জীবনধর্মী বা সামাজিক চলচ্চিত্রও। প্রত্যেকটি ধারাতেই নিজস্বতার ছাপ রেখেছে হলিউড। এদের ঝুলিতে অসংখ্য বিখ্যাত আর ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র রয়েছে।
তারপরও কিছু চলচ্চিত্র রয়েছে যেগুলোর গায়ে সবসময়ের জন্যে ক্ল্যাসিক আর মনে রাখার মতো চলচ্চিত্রের তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন মানুষ। হলিউডের চলচ্চিত্রের তালিকায় থাকা যে চলচ্চিত্রগুলো দেখা অনেকটাই অত্যাবশ্যকীয়।
ওয়েস্টার্ন ধারার চলচ্চিত্র- দ্য সাচার্স
১৮৩৬ সালে যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের দ্বারা ছোট্ট একটি মেয়ে অপহৃত হয়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজের ভঙ্গীতে উপন্যাস লেখেন লেখক অ্যালান লে মে। আর ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত সেই উপন্যাসের আলোকেই ১৮৫৬ সালে জন ফোর্ড নির্মান করেন হলিউডের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্ল্যাসিক ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্র দ্য সাচার্স। জন ওয়েইন অভিনীত এ চলচ্চিত্রে এক পশুচিকিত্সকের কথা বলা হয়, যে কিনা যুদ্ধের সময় নিজের অপহৃত ভাগ্নিকে খুঁজতে বের হয়। এতে জন ওয়েইনের সঙ্গে আরো অভিনয় করেন জেফরি হান্টার, ভিরা মাইলস, নাটালি উড, ওয়ার্ড বন্ডসহ আরো অনেক তারকা। নিজের জীবনের সবচাইতে সেরা অভিনয়টা এ ছবিতে করেছেন বলে আজো প্রশংসিত হন জন ওয়েইন।
বায়োপিক- রেগিং বুল
হলিউড পরিচালকদের ভেতরে সেরা মার্টিন স্করসেসের অন্যতম সাদা-কালো চলচ্চিত্র রেগিং বুলকে ধরা হয় এখন অব্দি নির্মিত হলিউড বায়োপিক বা জীবনীভিত্তিক চলচিত্রগুলোর অন্যতম। এতে ইতালিয়ান আমেরিকান বক্সার জ্যাক লা মোট্টার জীবনকে তুলে ধরা হয়। নিজের বেশ কিছু ভুলের জন্যে জীবনের শেষটায় এসে ভুগতে হয় মোট্টাকে। আর সেই ভুলগুলো আর জীবনের নানা শিক্ষাগুলোকে নিয়েই ১৯৮০ সালে মার্টিন তৈরি করেন এ চলচ্চিত্রটি। আকর্ষনীয় দৃশ্যায়ন আর প্রচন্ড মারামারির কারণে বেশ আলোচিত হয় চলচ্চিত্রটি।
এতে জ্যাকের ভূমিকায় অভিনয় করেন অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো। রেগিং বুলে নিজের অভিনয়ের জন্যে তিনি অস্কারও পান। তবে এতকিছু কেবল তার অভিনয়ের জন্যেই পাননি নিরো, আরো অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ২৭ কেজি ওজন কমিয়েছিলেন। সে সময় ওজন কমানোর কাজটা কোনো অভিনেতার জন্য সহজ ছিল না।
থ্রিলার- সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস
থমাস হ্যারিসের লেখা উপন্যাসের অনুকরণে ১৯৯১ সালে সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস নামে হলিউডের সর্বকালের সেরা থ্রিলার চলচ্চিত্রটি নির্মান করেন পরিচালক জনাথন ডেমে। সিরিয়াল কিলার ও মনরোগ বিশেষজ্ঞ এক ব্যক্তি হানিবল লেকটারকে ঘিরে গড়ে ওঠে ছবির কাহিনি। এ চরিত্রটিতে অভিনয় করেন হপকিন্স। ঘটনাক্রমে হানিবলের কাছ থেকেই এফবিআই এজেন্ট জোডি ফস্টার অন্য এক সিরিয়াল কিলারকে ধরার সাহায্য নেয় আর জড়িয়ে পড়েন হানিবলের জালে। হলিউডের এখন অব্দি নির্মিত ভিলেনগুলোর ভেতরে সবচাইতে সেরা ভিলেন হিসেবে হপকিন্সের চরিত্রটি সবসময়ই মনে থাকবে দর্শকদের। সে বছর সেরা পরিচালক, সেরা ছবি, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা অভিনেতা ও অভিনেত্রীর পুরস্কারসহ একসাথে পাঁচটি অ্যাকাডেমিক অ্যাওয়ার্ড পাওয়া দুইটি চলচিত্রের পাশে নিজের নাম লেখায় সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস। এখন পর্যন্ত সেই জায়গাটি আর কেউ দখল করতে পারেননি।
ক্রাইম- দ্য গডফাদার
এখন পর্যন্ত হলিউডে নির্মিত ক্রাইম বা গ্যাংস্টার সম্পর্কিত চলচ্চিত্রের মধ্যে এতটা আলোচিত হয়তো আর কোনো ছবিই হয়নি, যতটা হয়েছে গডফাদার। এর প্রথম চলচ্চিত্র ও তার দুইটি সিক্যুয়েলে বর্ণনা করা হয় ক্যারোলিয়ন পরিবারের গল্প। মারিয়ো পুজোর লেখা গডফাদার উপন্যাসকে নির্ভর করে তৈরি হয় এই চলচ্চিত্রটি। যাদের প্রত্যেকটিই হয় ব্যবসাসফল আর জনপ্রিয়। ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন মার্লোন ব্রান্ডো। তবে ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলা নির্মিত এই চলচ্চিত্রে আরো ছিলেন রবার্ট ডুভাল, জেমস কান ও আল পাকিনোর মতো আরো বিখ্যাত তারকারা।
রোমান্টিক- কাসাব্লাঙ্কা
হলিউড আর আমেরিকার দর্শকদের কাছে এখন পর্যন্ত সবচাইতে রোমান্টিক চলচ্চিত্রের তালিকায় প্রথমেই যে চলচ্চিত্রটির নাম চলে আসে তা হচ্ছে- ১৯৪২ সালে একটি মঞ্চ নাটককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চলচ্চিত্র কাসাব্লাঙ্কা। মাইকেল কার্টিজ নির্মিত এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন হামফ্রে বোগার্ট, ইনগ্রিড বারগম্যান ও পল হ্যানরেইড। একটি জুটি ও তৃতীয় একজন মানুষকে নিয়ে তৈরি হয় কাসাব্লাঙ্কার কাহিনি। অস্কারে মোট ৮টি শাখায় মনোনয়ন পায় চলচ্চিত্রটি। জিতে নেয় মোট তিনটি পুরস্কার।
যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র- অ্যাপোক্লিপস নাউ
ভিয়েতনাম যুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা জোসেফ কনার্ডের উপন্যাস হার্ট অব ডার্কনেসের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭৯ সালে ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলা নির্মান করেন তার ঐতিহাসিক ও অনন্য চলচ্চিত্র অ্যাপোক্লিপস নাউ। চলচ্চিত্রের গল্প আবর্তিত হয় এক অফিসারকে ঘিরে। যার ওপর দায়িত্ব থাকে আরেক অফিসারকে হত্যা করার। বিখ্যাত এই ছবিতে অভিনয় করেন মার্টিন শেন, ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন, হ্যারিসন ফোর্ডসহ আরো অনেকে।
হরর- সাইকো
বিখ্যাত নির্মাতা আলফ্রেড হিচকক ১৯৬০ সালে নির্মান করেন তার অন্যতম বিখ্যাত হরর মুভি সাইকো। রবার্ট ব্লচের উপন্যাস অনুসারে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন অ্যান্থোনি পারকিন্স, জ্যানেট লেইগ, ভেরা মাইলস ও জন গেভিন। তীব্র ভয়ের এই ছবিটি মুক্তির পর মানুষের ভেতরে তৈরি হয় নতুন নতুন ফোবিয়া। বিশেষ করে গোসল করা নিয়ে তৈরি হয় একরকমের ভীতি।
কমেডি- মডার্ণ টাইমস
চার্লি চ্যাপলিনের নিরব ছবিগুলোর ভেতরে অন্যতম ও শেষ পর্যায়ের চলচ্চিত্র ছিল মডার্ণ টাইমস। এতে চার্লি তার অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে দেখান- বিশ্বায়ন ও শিল্পায়ন কী করে মানুষ আর পৃথিবীকে নেতিবাচক দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও এটি মুক্তির পর জাপান আর ইতালিতে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এখন অব্দি কঠিন কিছু বাস্তবতাকে তরল হাস্যরসাত্মক চিন্তার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা এ চলচ্চিত্রটি সেরা কমেডি ঘরানার মুভি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।