‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে
জন্মেছিলো একটি ছেলে
মা তাঁর কাঁদে
ছেলেটি মরে গেছে
হায়রে হায় বাংলাদেশ!’
বাংলাদেশ শব্দটি এতটা হতাশা নিয়ে স্বাধনীতা পরবর্তী সময়ে আর কোন গানে এভাবে উচ্চারিত হয়েছিলো কী? একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নতুন জাতি গঠনের যে সংকট ও অস্থিরতা তার পুরোটাই যেন এই গানের মধ্যে ফুটে উঠেছে। মূলত সে সময়ের হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের ভিতর থেকেই বের হয়ে আসেন বাংলা ব্যান্ডের সবচেয়ে বড় নাম আজম খান।
আজম খান অস্ত্র হাতে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে নেমেছিলেন, আবার তিনিই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তরুণ সমাজের বিশাল অংশের আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য যুদ্ধের ময়দানেও তিনি কেবল অস্ত্র হাতে লড়াই করে থেমে থাকেন নি। সেখানেও তিনি গান দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন যোদ্ধাদের।
যুদ্ধের পর উচ্চারণ নামক ব্যান্ড দিয়ে শুরু। এরপর তার দেখাদেখি অনেকেই এসে যুক্ত হলো এই ধারায়।তবে এদেশে আজম খানের হাত ধরে শুরু হওয়া ব্যান্ড সংগীতের পথচলা কখনোই মসৃন ছিলো না। ‘অপসংস্কৃতি’ নামক ডিসকোর্সের সাথে তাকে সবসময় লড়াই-সংগ্রাম জারি রাখতে হয়েছে। সে লড়াইয়ের পথে মূলধারায় আজম খান অনেকটা ব্রাত্যই হয়ে ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ব্রাত্যজনই তাকে কাছে টেনে নিয়েছিলো।আজম খান মানেই হয়ে উঠেছিলো তারুণ্যের উপচে পড়া ভির। নিজেদের নাগরিক দুঃখ, ক্লেদ এবং হতাশা নিয়ে সবাই একাকার হয়ে গেয়ে উঠেছেন-‘হারিয়ে গেছে খুঁজে পাবো না, ওরে সালেকা ওরে মালেকা কিংবা আলাল ও দুলাল।’
এসব গানে তরুণরা নিজেদের প্রকাশের একটা জায়গা পেয়ে গেলো। এরপর অনেকেই এগিয়ে আসলো গিটার হাতে। রকের ভাষায় নিজেদের গল্পবলা শুরু করলো। সে সময়ে আজম খানের গান যে কতটা আলোড়ন তুলেছিলো এবং বাংলা ব্যান্ডের বিকাশে আজম খানের যে প্রভাব তা নিয়ে কবীর সুমনের বলা কথাগুলো পড়ে নেওয়া যেতে পারে-
“দশ বারো বছর আজম খান ছিলেন বাংলাদেশের একচ্ছত্র রকসম্রাট। তারপর তিনি আর গান করেননি। কিন্তু আজও তিনি যদি গান করতে মঞ্চে উঠেন তো দর্শক ও ভক্ত সমাগম যা হবে তা দুই বাংলার অন্য কোন শিল্পীর ভাগ্যেই জুটবে না। তার অসংখ্য ভক্তের কাছে তিনি আজও গুরু’। লক্ষ লক্ষ বাঙালির মনে তাঁর অদ্ভুত আবেদনের কারণে ক্ষীণকায়, লম্বা, আপনভোলা, প্রতিষ্ঠানবিমুখ, প্রচারনিস্পৃহ আজম খান সিরিায়াস গবেষণার বিষয় হতে পারেন। সঙ্গীত ও সমাজের সম্পর্ক বাংলার বিদ্দজনদের মস্তিস্কে তেমন গুরুত্ব পায়নি (ফলে এই মস্তিষ্কটি আমার মতে গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত)। আর আধুনিক সঙ্গীত ও তার সামাজিক ভূমিকা বিষয় হিসেবে ব্রাত্যই থেকে গেল। তাই আজম খানের সঙ্গীত, পরিবেশনার আঙ্গিক ও তার গণআবেদন নিয়ে গবেষণাধর্মী তেমন কোন কাজই হলো না। অকল্পনীয়রকম জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও আজম খান বাংলাদেশের সমাজে প্রান্তবাসীই থেকে গিয়েছেন। ”
সংগীত যে শোনার বিষয় না, এটি যে দেখার বিষয়ও হতে পারে আজম খানই প্রথম তা জানিয়েছেন। তার কণ্ঠ ছিলো এমনিতে একটু অন্যদের চেয়ে আলাদা। তার সাথে যোগ হয়েছিলো মঞ্চ পরিবেশনায় অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গির সমন্বয়। সবমিলিয়ে আজম খান নামটাই হয়ে উঠেছিলো বাংলা ব্যান্ডের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনের নাম।
কিন্তু এই মানুষটা এইসব খ্যাতি ও অর্থের মোহ থেকে অনেক দূরে পুরান ঢাকার একটি গলিতে রীতিমত সন্তের মতো জীবন কাটিয়ে গেছেন। অথচ তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে অনেকের রকস্টার হওয়ার স্বপ্ন। অনেকের কাছে এখনো তিনি আইডল। তিনিই যে বাংলাদেশের প্রথম রকস্টার।