বৈশাখের বিচিত্র আবহে আঁলিয়স ফ্রঁসেজের গ্যালারী জুমে একমুঠো জোনাকী উড়িয়ে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো লুবনা চর্যার চিত্রকর্ম।
হ্যাঁ, পুর্ণেন্দু পত্রীর বিখ্যাত কবিতা ‘এক মুঠো জোনাকী’র মতোন লুবনা চর্যার শৈল্পিক ভাবনা রঙ তুলির রেখায় যেনো চিত্রকর্মে ঠাঁই করে নিয়েছে। এবং সত্যি সত্যিই চিত্রকর্মগুলো যেনো সময়ের জয়ধ্বনি। আর ‘ফায়ারফ্লাই’ বা জোনাকি লুবনা চর্যার একক চিত্র প্রদর্শনী, যা আঁলিয়স ফ্রঁসেজে শুরু হয়েছে ২৪ এপ্রিল শুক্রবার থেকে।
লুবনা চর্যার ‘চিত্রশিল্পী’র পরিচয়ের আগে তিনি একজন কবি। জিওগ্রাফি ইন অ্যা জ্যু, শয়তানের অভিনব কারখানা, পপকর্ন তার প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ। কবি হিসেবে তার পরিচিতি থাকলেও, চিত্রশিল্পী হিসেবে তার পরিচিতিটা খুব পুরনো নয়। তবে কবি সত্ত্বার আড়ালে মনের ক্যানভাসে তিনি রঙ তুলি চালিয়েছেন সচেতন অবচেতনে। একজন কবিও তো শিল্পী, তাকেও দৃশ্যকল্প নিয়ে কাজ করতে হয়। কবি শুধু মনের ক্যানভাসে আঁকা দৃশ্যগুলো শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তুল ধরেন তার কবিতায়, আর একজন চিত্রশিল্পী তার ভেতর গেঁথে থাকা দৃশ্যগুলো রঙ তুলির আচরে তার ক্যানভাসে আঁকেন।
শিল্পকলার সর্বস্তরে বিচরণ করার সাহসী মনোভাবতো একজন কবির দ্বারাই সম্ভব। লুবনা চর্যাও তাই করলেন। কারণ লুবনা চর্যা প্রতমত একজন কবি। আর তার কবি ও আঁকিয়ে সত্ত্বার সম্মিলনে এঁকে চলা সৃজনশীল চিত্রকর্ম নিয়ে প্রথমবারের মতো আত্মপ্রকাশ ঘটলো একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর।
লুবনা চর্যার ১৮টি অভিনব চিত্রকর্ম নিয়ে ঢাকার ধানমিন্ডর আঁলিয়স ফ্রঁসেজে ২৪ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত চলছে তার একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। চিত্রকর্মগুলো নিয়ে কথা হলো তার সাথে।
একজন আর্টিস্টটের কাছে তার প্রত্যেকটি চিত্রকর্মই আপন, মায়ের কাছে প্রত্যেকটা সন্তান যেরকম। তারপরও লুবনা চর্যার ‘ফেইসবুক আর্টিস্ট,’ ‘ড্রিমস এন্ড ড্রিম ইটার’, ‘এম্পটি পোট্রেট’, ‘উইংস অব টার্টলস’, ‘ব্যাড টাইম এন্ড স্যাড টাইম’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলো অসাধারণ লেগেছে। এই চিত্রকর্মগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে চিত্রশিল্পী লুবনা চর্যা হেসে ধন্যবাদ জানালেন। এবং মুগ্ধ হয়ে বলতে শুরু করলেন তার সৃষ্টিকর্মগুলো সম্পর্কে।
‘ফেসবুক এডিক্ট’ নামের চিত্রকর্মটি বর্তমান সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। বর্তমান সময়ে ফেইসবুক আসক্তি যে মাদকের নেশা থেকেও ভয়াবহ হয়ে উঠছে, শিল্পী ‘ফেইসবুক এডিক্ট’ চিত্রকর্মটির মাধ্যমে সে বিষয়টিই চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। চিত্রকর্মটিতে দেখা যায়, ফেইসবুকের টিকার লাগানো একটি সিরিঞ্জ দিয়ে মাদক নেয়ার মতো করে নিজের শরীরে পুশ করছেন একজন।
‘ব্যাড টাইম এন্ড স্যাড টাইম’ চিত্রকর্মটিও জীবনের কথা বলে। জীবন চলার বাক বদলে নানা ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে হয় মানুষকে। চলতে পথে কখনো প্রতিকূল সময় চেপে বসে ঘারের উপর। সেই প্রতিকূল সময়ের প্রতিনিধি হয়ে ‘ব্যাড টাইম এন্ড স্যাড টাইম’ চিত্রকর্মটিতে একজন মানুষের উপর বসে আছে এক মস্ত কাক, আর চারদিকে ছড়ানো গাছের শুকনো পাতা। তাই বলে থেমে যেতে নেই। প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে, শিল্পী লুবনা চর্যা সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন একটি জীবন্ত সবুজ ছোট্ট গাছ ও পাতার মধ্য দিয়ে। যা শুকনো খড়কুটোর মধ্য এক টুকরো নতুন জীবনের আবাহন।
‘এম্পটি পোট্রেট’: বাহির দিয়ে এতো জৌলুস, এতো আড়ম্বর অথচ ভেতরে ফাঁকা খোলস ছাড়া কিছুই না ‘এম্পটি পোট্রেট’ চিত্রকর্মটির মধ্যে তাই তুলে ধরা হয়েছে। কর্পোরেট জীবনকে স্যাটায়ারের মাধ্যমে তুলে ধরায় এটার লক্ষ্য। চিত্রকর্মটিতে দেখা যায়, দড়ি দিয়ে মানুষের একটি অবয়ব। যার গলার নিচ থেকে টাইয়ের মতোন একটি দড়ি ঝুলে আছে।
লুবনা চর্যার প্রায় চিত্রকর্মগুলোই প্রতিকী, ব্যঙ্গ আর স্যাটায়ারের মাধ্যমে সমকালীন সমাজকে তার চিত্রকর্মে তুলে ধরেন কি না এ সম্পর্কে জানতে চাইলে লুবনা চর্যা বলেন, ‘শুধু যে স্যাটায়ার তা কিন্তু না; বরং প্রতিনিয়ত যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাই, সেই কনটেম্পরারি বিষয়গুলোই আমার চিত্রকর্মে তুলি ধরি’।
চিত্রকর্মে লুবনা চর্যার কোন অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তিনি সশিক্ষিত এবং চিত্রকলা তার নিজেকে উপস্থাপনের একটি বিশ্বস্ত মাধ্যম। অনেকে তার ছবিগুলোকে বলেন, দার্শনিক ছবি। তিনি নিজে তার ছবিকে বলেন, কাব্যিক। তার ছবির ভাবনা ও উপস্থাপন কবিতার সাথে মিলে যায়। প্রতিটি ছবিরই রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প। শুধু ছবি আঁকার জন্যই তিনি ছবি আঁকেন না।
এক নজরে লুবনা চর্যা ও তার ‘ফায়ারফ্লাই’:
চিত্রশিল্পী: লুবনা চর্যা। তার জন্ম খুলনাতে। পড়াশুনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। কিন্তু তিনি ছবি আঁকেন এবং নিজের মতো গড়ে নিয়েছেন এক ছবির জগৎ। তার ছবিগুলো তার চিন্তা ভাবনারই প্রতিনিধিত্ব করে। চারপাশের যা কিছু তাকে ভাবায় তাই তিনি আঁকেন এবং শেয়ার করতে চান অন্যদের সাথে। তার স্টাইল, রঙের ট্রিটমেন্ট, কম্পোজিশন একান্তই তার নিজের।
চিত্রকর্ম: ১৮টি
স্থান: গ্যালারী জুম, আঁলিয়স ফ্রঁসেজ, ধানমিন্ড, ঢাকা
সময়: সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা এবং শুক্রবার ও শনিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনীটি খোলা থাকবে। রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ। প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত।