Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তাপস কিরণ রায়

৮ বছর আগে লিখেছেন

রমাকান্ত নামা—জীবন ধারাপাত


জীবনে কটা ফাগুন দেখেছেন রমাকান্ত ? তাঁর বয়েস যদি ষাটের কাছাকাছি হয়, তবে বলতে হয় ষাটের কাছাকাছি হবে তাঁর ফাগুন দর্শন। তবে চোখে দেখা আর মনে উপভোগ করা অন্য কথা। মনের ফাগুনের কোন গোনাগুনতি নেই, নেই তার ধরে রাখার ক্ষণ মুহূর্ত। যখন তখন মন পারে রং ধরতে--বয়সের সীমানা সেখানে নেই...

রমাকান্ত অকসর দুপুর বেলায় জানলার ধারের চেয়ারটায় এসে বসেন। পথ চলতি মানুষদের দেখেন। তার মাঝেই মানবীর আনাগোনাও তাঁর চোখে পড়ে। এটা চরিত্রের খুঁত নয়, একটা পুরুষালী ধর্ম বলা যেতে পারে--মনের ধর্মও বটে। মানব-মানবীর পরস্পরের প্রতি টান হল আত্মগত টান। 

রমাকান্ত মাঝে মাঝে ভাবেন, কত বড় চতুর আমাদের এই সৃষ্টি কর্তা ! এই দেহ দিয়েছেন, সঙ্গে মন নামক একটা বস্তুও বেঁধে দিয়েছেন। ভাবতে গেলে দাঁড়ানো থেকে মাথায় দু হাত রেখে মাটিতে লেপটি মেরে বসে পড়তে হয় ! মন নামক বস্তু কত ওয়াটের তেজস্বীতা ধরে থাকে তা কেউ বলতে পারে না—তা একে বারে মাপজোপের বাইরে। মন সবচে দ্রুতগামী শুধু নয় আশ্চর্যতমও বটে। মনের লীলা খেলার এক বিন্দুও নাকি এক মানব জন্মে খরচ হতে পারে না!  

ধুস তর ভাবনা--ওই যে এক মানবী পথ হাঁটছেন। ধীর গতি তাঁর, মাথার মধ্যে বদ বুদ্ধি নিয়ে চলছেন না তো ? তা না হলে একা একা মুখ টিপে কেউ হাসতে পারে ? জানলার একেবারে পাশটিতে এসে সে মহিলা দাঁড়িয়ে গেলেন। কি ব্যাপার, এমনটা কেন ? রমাকান্ত মাথাটা সামান্য নিচু করে নিলেন। দুরের জিনিস কাছের জিনিস ইদানীং তিনি একটু ঝাপসা দেখেন। এ সময় চশমা লাগানো থাকে না তাঁর। তবে সামনের মহিলার তো চোখ খারাপ হবে এমন কোন কথা নেই ! মাথা নিচু করে গেলেন তিনি, এমন তো নয় মহিলা অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁকে দেখেই এমনি থেমে গেলেন?

না আর বসা যাবে না--রমাকান্ত ধীরে ধীরে সরে গেলেন। সামান্য আড়াল নিয়ে দেখলেন, না, ভদ্রমহিলার কোন বদ মতলব  আছে বলে মনে হল না তাঁর। তা হলে কি রমাকান্তর নিয়মিত এখানে বসেন তা ওঁ  আঁচ করেছেন !

এমনি সময় ঘরের বেলটা কর্কশ স্বরে বেজে উঠলো। চমকে উঠলেন রমাকান্ত। বেলের আওয়াজটা মোটেই ভালো নয়। আচমকা ক্যাঁ, ক্যাঁক করে ওঠে। ভালো জাতের বেল লাগিয়েছিলেন তিনি। দু দিন তিন দিন মিষ্টি সুর ভাজিয়ে ওনারা চির চুপ হয়ে গেছেন। তাই সস্তা সুন্দর মজবুত এই বেলটা এক বছরের গ্যারান্টি পত্রে নিয়ে এসেছিলেন। আবার কর্কশ ডাক পারল বেলটা। আবার চমকালেন রমাকান্ত, এত ঘন ঘন বেল বাজাবার কোন মানে হয় !  মনে ভয় ধরল, ওই মেয়েছেলেটা  নয় তো ? মনটা কেমন যেন ধুকু ধুকু করে উঠলো তাঁর! 

একবার ভাবলেন, ঘরের স্ত্রীলোকটা গেল কোথায় ? দুপুরের নিদ্রা ছেড়ে তিনি কি একবার উঠে গিয়ে দেখতে পারেন না !  অগত্যা ভয়ে ভয়ে দরজার ছিটকিনি খুললেন তিনি। আর দরজার পাট খুলেই চমকে উঠলেন। এ যে তাঁরই স্ত্রী, শৈলবালা ! সঙ্গে সঙ্গে রমাকান্তর মনে পড়ে গেল, আরে শৈলবালা তো একটু আগে বলেই গিয়েছিল, আমি একটু ঘুরে আসছি, বলে ! 

--কি হল, এত দেরী হল কেন দরজা খলতে ? দুপুরে জানলা খুলে বসে থাকার স্বভাবটা দেখছি গেল না তোমার ? আমি বিশ্রাম নিই আর তুমি সেই অবসরে--শৈলবালা মুখিয়ে উঠলেন। 

--কি যে বল না তুমি--মিনমিনিয়ে উঠলেন রমাকান্ত। 

--ঠিক বলছি--জানলা দিয়ে কি দেখো সারা দিন ? এই বয়সেও তোমার উঁকিঝুঁকি মারার বদ অভ্যাস গেল না! 

--তুমি না, মাঝে মাঝে এমন--

--ধরা পড়ে গেছ ? তাই কথা পালটাবার চেষ্টা করছ ? জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আমি স্পষ্ট দেখলাম, তুমি জুলজুল করে আমার দিকেই তাকিয়ে আছ--

ওরে বাবা! তাহলে ওটা শৈলবালাই ছিল ? প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কাজে লাগালেন রমাকান্ত, স্ত্রীর সুর ধরে এগিয়ে গেলেন তিনি, তোমার দিকে তাকাবো না তো কি পরস্ত্রীর দিকে তাকাবো ? রমাকান্তর কথন বটিকা কাজে লেগে গেল, স্ত্রীর মুখের ফ্লো পাল্টে গেল--হ্যাঁ, জানি, আমায় তুমি কতটা দেখো, আমি তা জানি --

টারনিং পয়েন্টে এসে গেল ব্যাপারটা, মনে হল আরও কিছু মশলা দিয়ে যদি প্লাস্টার করে দেওয়া যায় তবে একেবারে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। রমাকান্ত তাকিয়ে থাকলেন শৈলবালার চোখের দিকে—মনে হল যেন স্ত্রীর প্রতি তিনি ঈষৎ মোহিত ও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। শৈলবালারও চোখে পড়ল ব্যাপারটা--অবশেষে এই বয়সেও চার চক্ষুর মিলন !

--এই হচ্ছেটা কি ? শৈলবালা ডাক ছাড়লেন। 

--কেন গো ?

--তোমার বয়সের ভীমরতি ধরেছে দেখছি, আর দাঁড়ালেন না শৈলবালা, দ্রুত পায়ে ঘরের ভিতর ঢুকে গেলেন। 

এমনটা করতেই হয়, চটে গেলে ভদ্র মহিলা দানবী হয়ে ওঠেন। তাই বশীকরণ মন্ত্র স্তোত্র পাঠ আর সম্মোহন বিদ্যার প্রয়োগ রমাকান্তকে ঘরের শান্তি রক্ষার্থে করতে হয়।

এ ত ধর্ম, সংসার ঠেকাতে গেলে এমনটা করতেই হয়। হ্যাঁ, যা ভাবছিলেন রমাকান্ত, রং গুলাল দেখলে কার মন না গদগদ হয়ে ওঠে ? তাই যদি না হবে তবে নারী সাদা পরলে তাকে বিধবা বলে কেন ? চমক রঙে বেশভূষা পরবে আর কেউ দৃষ্টি দেবে না , এমনটা তো হতে পারে না। 

রমাকান্তকে চরিত্রবান বলতে হবে। জীবনে তিনি কাউকে ছোঁয়াছানির আগে বাড়েন  নি। এটুকু দুষ্টি সব পুরুষেরই থাকে। ব্যাপার হল গিয়ে আসল জাগায় পৌঁছাতে পার নি, তার মানে তুমি চরিত্রবান।

নিজের স্ত্রীকে নিয়ে তৃতীয় ব্যক্তির কথা ভাবতে গেলে কেমন যেন মনটা তালগোল পাকিয়ে যায়। রমাকান্ত জানেন, স্ত্রী জাতির মাঝেও রং প্রভাব আছে--সুন্দর জিনিসের প্রতি কার না নজর যায় ? আর ভাবনার সঙ্গে শরীরের দৌর্বল্য মিলে গেলে তো কথাই নেই। তবে রাখা ঢাকা ব্যাপারটা স্ত্রীজাতির মজ্জাগত, তা না হলে যে সব ফাঁস!

উন্মীলিত দ্বার নারীজাতির জন্যে নয়। শরীর ফান্দা নারীকে অচল করেছে। না হলে তাঁদের মনেও পাখনা আছে, উড়ে যেতে চাওয়ার সীমানা তাঁদের বাঁধা নেই, তবে ওই, শুধু মনে মনে !

চাইলেই নারী পুরুষোচিত হতে পারেন না। তাঁরা দৈহিক বন্ধনে অনেকাংশে পরাধীন। দেহকুম্ভ তাঁদের বড় বাধ-বন্ধে লালিত। সেখানে অনধিকার প্রবেশ নেই। কোন চৌর্য প্রবেশ যখন তখন তাঁদের বিষাক্ত করে তুলতে পারে। যে কোন সময় অবৈধ বীজ বপনের শত-প্রতিশত আশঙ্কায় তাঁরা আতঙ্কিত। অবৈধ বপিত বীজাঙ্কুর নারীত্বের স্খলন। আর ঠিক এ দিক দিয়ে বিচার করে দেখলে বোঝা যায় যে নারী আর পুরুষের প্রকৃতি কোন দিন এক হতে পারে না। যত দিন নারীত্বের মূল্য আছে ততদিন সমস্ত  নারীজাতিকে স্তব্ধতার বন্দিত্ব স্বীকার করে নিতেই হবে। চঞ্চলতার পাখায় পুরুষের মত তাঁরা বাস্তবে উড়তে পারেন না। পুরুষ তো পতনেই স্বস্তি পান, নির্ভেজাল শরীর নিয়ে তাঁরা পুনর্বার যথেচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারেন। আর স্ত্রীর বেলায় কিন্তু তা নয়—তাঁদের নিষ্ফলা হলেও ধারণ করতে হয়। তাঁদের দৈহিক মর্ম ব্যথা সারা জীবনই বয়ে বেড়াতে হয়।        

সংসার নারীকে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে। সংসারে এসে তাঁরা স্বভাবত উড়ু উড়ু পুরুষকে বাঁধার চেষ্টা করেন।

ধুত্তুরি তোর ভাবনা—রমাকান্তর এই একটা ব্যাপার, মন একটু খালি-স্থান পেল কি রস-বেরসের ভাবনাগুলি এসে জুড়ে বসবে!        

বয়সের ধাক্কায় হবে রাতে কোন দিন ঘুম না এলে শৈলবালা সারা ঘর পায়চারী করে বেড়ান। স্ত্রীর বিধানেই রমাকান্তর শয্যা ব্যবস্থা অন্য ঘরে। ছেলে নাকি বড় হয়েছে। এখন আর বেলেল্লাপনা সাজে না। কিন্তু ওই স্ত্রীর মাথা ব্যথার দিন রমাকান্ত ধীরে ধীরে তাঁর ধারে কাছে এগোতে চেষ্টা করেন। 

--কি হল এখনও তুমি ঘুমাও নি ? কি ছাই পাশ করো রাত জেগে ? স্ত্রী তাঁর জানেন যে একটু আধটু সাহিত্য চর্চা করেন রমাকান্ত। ঘুম না এলে কাগজ কলম নিয়ে আঁকিবুঁকি করতে লেগে যান। আর রমাকান্ত জানেন, মূল্যহীন মনের প্রকাশ ছাড়া আর যে তাঁর কিছুই করার নেই। সময় মেরে দিনান্তে এগিয়ে চলা আরকি ! তিনি জানেন, অনেকের কাছে এটা অর্থহীন ফন্টেবাজী ছাড়া আর কিছুই নয় !

কিন্তু এই মুহূর্তে রমাকান্তর অন্য নেশা চাপছে, প্রেম কাতর স্বরে তিনি স্ত্রীকে বললেন, তোমার মাথা টিপে দেব ?

--না থাক, তারপর নীরবতা, রমাকান্ত জানেন মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। স্ত্রীকে শুয়িয়ে নিজে পাশটিতে বসে মধ্যম গতিতে তিনি স্ত্রীর মাথা টিপে দিচ্ছেন। বয়স বাড়লেও শরীরের ধর্ম কমে যেতে থাকলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না। রমাকান্ত জানেন, শৈলবালা ঘুমান নি। স্ত্রী পুরুষের মাঝে দৈহিক ও প্রাকৃতিক পরিবর্তন থাকলেও মূল জাগায় এসে সব এক। 

কখন যেন রমাকান্ত মাথা টিপতে টিপতে স্ত্রীর গালে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলেন !

--কি গো ঘুমিয়ে পড়েছ ? ধীরে প্রশ্ন করলেন রমাকান্ত। সাড়া নেই, কিন্তু স্ত্রী যে ঘুমান নি এ ব্যাপারে তিনি একশ পারসেন্ট নিশ্চিত। 

--বুঝলে ?

--এ্যাঁ, স্ত্রীর এলানো কণ্ঠ বেজে উঠলো। 

--তোমার পাশে একটু শুবো ?

আবার নীরবতা, দ্বিধাহীন স্ত্রীর পাশটায় এবার জাগা করে নিলেন রমাকান্ত। 

এবার পূর্বরাগ শুরু হবে--জগতের চিরন্তন সে লীলা খেলা--সৃষ্টি স্থিতির মূলাধার স্থাপনের খেলা। যদিও বয়সের ভারে আজ তাঁরা ভ্রষ্টবীজ, সেই তাণ্ডবতা আজ  হারিয়ে গেছে, স্তব্ধতার মাঝে নিজেদের জাগিয়ে রেখে এক সময় উভয়েই নেতিয়ে পড়বেন ঘুম বাসরে।  

 

সমাপ্ত                      

Likes Comments
০ Share

Comments (0)

  • - মামুন

    তবে কি সুন্দরের আশা করাটাই ভুল?
    মিথ্যের বেসাতি এত বেড়ে গেছে, সত্যরা গেছে নির্বাসনে।
    আমার স্বপ্নগুলো স্বপ্নই রয়ে যায়। সত্যি হয় না কোনোদিনই। ... চমৎকার লাগল! তবে আপনি সত্য লিখেছেন। কিন্তু মিথ্যেদের সাথে নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হবে আমাদের। আহসাকে জিইয়ে রাখতে হবে ভাই।

    শুভেচ্ছা রইলো...emoticons

    • - আহমেদ রব্বানী

      আজ আমরা বৃত্তবন্দী। এই চক্র থেকে বেরুবার পথ যেন রুদ্ধ। তবু আশাহত হলে চলবে না।

    - মনজুরুল আলম প্রিন্স

    অনেক সুন্দর দাদা

    • - আহমেদ রব্বানী

      ধন্যবাদ প্রিন্স ভাই।

    - আলমগীর সরকার লিটন

    প্রাণের উচ্ছ্বস বেশ লাগল রব্বানী দাদা

    • - আহমেদ রব্বানী

      ধন্যবাদ বাউল ভাই।

    Load more comments...