Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তাপস কিরণ রায়

৮ বছর আগে লিখেছেন

দূরের আলেয়া (শিশু-কিশোর গল্প)


চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোডশেডিং চলছিল। গ্রাম-গঞ্জ জাগায় এমনি হয় ! লাইট চলে যাবার ঠিকানা থাকে না–কখন থাকবে আর কখন যাবে, কেউ বলতে পারে না।

তিন বন্ধুতে বসে গল্প জমিয়ে ছিলাম। খেলার গল্প, ঘোরা বেড়ানোর গল্প, আগামী পিকনিক কবে হবে তার গল্প। এমনি সময় লাইট গোল ! চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেলো। আমি তাড়াতাড়ি মোম বাতি জ্বালিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখলাম। মোমের আলো ঘন অন্ধকারকে তত পরিষ্কার করতে পার ছিল না–শিখা থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল। আমাদের গল্পের মোড় ঘুরে গেলো। মনে হয় পরিবেশকে ঘিরে, আসরে এবার ভূতের গল্পের উত্থাপন হল।

ভূত আছে কি নেই এ নিয়ে কথা চলছিল। টপিক বড় জব্বর ! আধ গাঁ, আধ শহরের ছেলে আমরা। ভূতকে বিশ্বাস না করার কথা না। তবু মহান, গলায় জোর নিয়ে বলে উঠলো, না, না, ভূত বলে কিছু নেই !

–কি করে জানলি ? ভোলা সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন করে উঠলো।

–শুধু গল্প শুনলাম, চোখে তো কোনও দিন দেখতে পেলাম না!

–যে দিন দেখবি সে দিন তোর কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছিস ? আমি মহানের কথায় জবাবে বলে উঠলাম।

–ও সব দেখে কাজ নেই, মহান কেন যেন শান্ত হয়ে গেলো। আসলে ওই আমাদের মধ্যে সবচে ভীতুরাম ! ভূত দেখে নি কথা ঠিক, কিন্তু ভূতের গল্প শুরু হলে বেচারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। একা রাস্তায় চলতে সাহস পায় না। অনেক সময় আমাদেরই ওকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে হয়। এমনি সময় হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে ঘরের মোমবাতি কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেলো।

মহান, এই রে, বলে আমার কাছ ঘেঁষে এসে বসলো।

আমি বললাম, বাইরে হাওয়া দিচ্ছে, ওই খোলা জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকে মোম নিভে গেলো।

–জ্বালা, জ্বালা, আলোটা তাড়াতাড়ি জ্বালা, মহান বলে উঠলো।

আবার মোম জ্বেলে দিলাম। জানলা দিয়ে ভালো হাওয়া আসছিল। ভোলাকে বললাম, ভোলা, জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে আয় না !

ভোলা এগিয়ে গেলো জানলা বন্ধ করতে। জানলার কাছে গিয়ে ও দাঁড়িয়ে গেলো। বাইরে ও উঁকি মারছিল বারবার। বাইরে এত মন দিয়ে ও কি দেখছে !

আমাদের বাড়িটা গ্রামের শেষ প্রান্তে। আমরা যে ঘরে বসে ছিলাম তার জানলা দিয়ে তাকালে দিনের বেলা দেখা যায় ধূ ধূ মাঠ, বেশ দূরে দূরে মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়, আর একটা খাল। খালের ওপারে হালকা জঙ্গল–যেটা ক্রমশ: ঘন হতে হতে বহু দূর পর্যন্ত চলে গেছে। ওই জঙ্গলের  মাঝে মাঝে ছোট ছোট আদিবাসীদের গ্রাম আছে। দিনের দৃশ্যটা খারাপ না। কিন্তু রাতে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখার মত থাকে না!

তবে একেবারেই দেখার যে কিছু থাকে না, তা নয়–পা চলা সরু রাস্তা ধরে শনিবারের হাট ফেরা দূর গ্রামের দু চারজন লোক রাতে আপন গ্রামে ফেরে। ওদের হাতে থাকে মশাল, তার আলোতে পথ দেখে হাঁটে। শুরুতে ভয় হতো, পরে জেনেছি, পায়ে হাঁটা পথ ধরে খালের পার বেয়ে ওই দূরের বন পেড়িয়ে যে গ্রাম আছে সেখানকার লোকেরাই হাট-বাজার করে মশাল হাতে নিয়ে নিজেদের গ্রামে ফেরে।

ভোলা কি দেখছিল কে জানে ! একটু পরেই ও আমায় ডাক দিলো, তপন, আয়, আয়, দেখবি আয় ! তাড়াতাড়ি জানলার দিকে ছুটলাম। মহান আমায় জাপটে ধরল, বলল, দাঁড়া আমিও যাবো। দুজনে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

–দেখ, দেখ, ভোলা আমাদের দেখাল, ওই দেখ, খালের ওই কোনাতে কতগুলি আগুন জ্বলছে না !

–হ্যাঁ, গ্রামের লোকরা ঘরে ফিরছে হয় তো–আমি বলে উঠি।

মহান সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, তা কি করে? আজ তো হাটবার নয় !

–তবু কোন কাজে লোকেরা এদিকে এসেছিল হবে, আমি বলি।

ভোলা বলল, না রে, তেমন বলে মনে হচ্ছে না, আলোগুলি তো একই জাগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে !

মহানের মুখ ভয়ে চিমসে গিয়েছিল। হঠাৎ ও চীত্কার করে বলে উঠলো, এ আগুন নয়, ভূত,  আলেয়া ! আলেয়া !!

লক্ষ্য করলাম, সত্যি, খালের ও দিকে পায়ে হাঁটা পথ নয়, আলোগুলি খালের শুরুর দিকের এক কোনায় দেখা যাচ্ছে। খালের ও জাগায় জল কম, শ্যাওলা জমা চড়া মত পড়েছে। ভীষণ কাদা, ওখানে নাকি দলদল আছে, দলদলের পাঁকে ডুবে যাবার ভয়ে খালের ওই কোনার দিকে কেউ যায় না। এ ছাড়া কিছু গাছপালা, বাঁশের ঝাড় ওই কোনকে জঙ্গলের মত ঘিরে আছে।

মহান আবার চীৎকার করে উঠলো, উরে বাবা রে !

–আবার কি হলা ? তাকালাম মহানের দিকে।

মহান বলল, ওই দেখ, একটা আগুন ওপরে উঠে গেলো !

ভোলা বলল, সত্যি তো, লোকের হাতের মশাল এত ওপরে উঠবে কেন !

দেখলাম সত্যি, আলোগুলি যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে ! ওপরে নীচে—এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে !

মহান প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে উঠলো, ভূত, ভূত, আলেয়া !

আমি ভয়ে জানলা, ঠাস, করে বন্ধ করে দিলাম। তাড়াতাড়ি ওর খিল এঁটে দিলাম। জানলা বন্ধ করার শব্দ, আমাদের চীৎকার চেঁচামেচিতে মামা এসে ঘরে ঢুকল, কি হয়েছে তোদের? এত চেঁচামেচি করছিস কেন?

আমার মুখ খোলার আগেই মহান বলে উঠলো, মামা, ভূত ! ভূত !!

মামার নাম দীনেশ। কলেজের স্টুডেন্ট। আমাদের গ্রামের থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে ছোট শহরে যে কলেজ আছে তাতে রোজ বাসে চেপে যায়। খুব সাহসী। মামা ঈষৎ বিস্মিত হল, ভূত !

হ্যাঁ, মামা, আগুন, অনেকগুলি আগুন…ভোলা বলল।

–কোই, কোথায় আগুন ?মামা জিজ্ঞেস করল।

–ওই খালের ধারে, ভয়ে ভয়ে আমি বলে উঠলাম।

–কোথায় ? জানলা খোল, আদেশের সুরে মামা বলে উঠলো। জানলার খিল খুলে তার দুটো পাট ভয়ে ঝটকা মেরে খুলে দিলাম। মামাকে দেখালাম, ওই দেখ মামা, চার পাঁচটা আগুনের গোলা কেমন ঘুরছে ! ও গুলি কখনো জ্বলে উঠছে, কখনো নিভে যাচ্ছে !

মামা আলোগুলি দেখতে দেখতে আশ্চর্য হয়ে কি যেন ভাবলেন। সাহসী মামা হঠাৎ বলে উঠলেন, চল তো দেখে আসি কিসের আগুন ওগুলি !

মামার কথা শুনে মহান কেঁদে উঠে বলল, ওরে বাবা, আমি ঘরে যাবো।

–যা ঘরে যা, মামা ঠাট্টা করে মহানকে বলে উঠলো—কারণ মহানের সাহসের দৌড় তার জানা ছিল। কিন্তু এ সময় মহানকে পৌঁছাবে কে ? অগত্যা মহান আমার একহাত জাপটে ধরে ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো, চল তা হলে–

মামা হাতে লাঠি ও টর্চ নিলো। আমরা ছোট খাট লাঠি হাতে নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মামার সাথে আলেয়া দেখতে বের হলাম। পা চলা সরু পথ–এঁকে-বেঁকে সাপের মত চলেছে। মাঠের আল, উঁচু নিচু পথ ঠেঙিয়ে চলেছি। চারদিক যেন কালো তালিমারা  অন্ধকার। আলেয়ার আগুন বেশ কিছুটা দূরে। অন্তত তিন মিনিট হাঁটলে পৌঁছানো যাবে সেখানে। অন্ধকার চিড়ে ঝিঁঝির ডাক আর দূরের খালের ব্যাঙের টর টর, আওয়াজ কানে আসছিল। মামা আগে আগে, পেছনে, আমার আর ভোলার মাঝখানে ভয়ে কুঁচকানো মহান ! বাতাস বেশ জোরে জোরে বইছিল। হালকা শনশন শব্দ হচ্ছিল। মাঝে মাঝে মৃদু ধুকধুক শব্দ পাচ্ছিলাম–ওই শব্দ আমাদের হৃদপিণ্ডেরই  হবে–ভয়ের ধুকধুকানি !

আর বেশী দূরে না, খালের প্রায় কিনারে আমরা এসে পড়েছি। বেশী হলে দু শ হাতের মত দূরত্ব। পায়ে হাঁটার পথ এখান থেকে অন্য দিকে মুড়ে গেছে। মামা দাঁড়িয়ে গেলো, চীৎকার করল, কে, কে ওখানে? সে চীৎকার চারদিকের স্তব্ধতা চিড়ে ফিরে আমাদের বুকে এসেই যেন আঘাত করল !

মহান চমকে উঠে বলে উঠলো, ওরে বাবা, কালো বড় ওটা কি? আমি জানি ওটা একটা মরা গাছ, খাল পারের ডালপালা ছড়ানো মরা গাছটা দেখে মহান ভয় পাচ্ছিল। মামার ডাকের কোন সাড়া এলো না। বন্দুক না থাকলেও চীৎকার করল মামা, আমার হাতে বন্দুক আছে, কথা না বললে আমি গুলি করবো। চুপচাপ সব, চারিদিকে আগুনের গোলাগুলি খেলে বেড়াচ্ছে যেন ! জ্বলছে নিভছে–ওপরে যাচ্ছে, নীচে নেমে আসছে !

আমরা কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলাম। মামা আরও কিছু সময় চুপ থেকে বলে উঠলো, বুঝলি তপন, ভূতটুত কিছু না–এর নাম হল আলেয়া, কোন জাগায় বহু দিন জল জমে লতাপাতা, শ্যাওলা জমে পচে এক রকম গ্যাসের সৃষ্টি হয়।

আমরা ঘরের দিকে ফিরছিলাম। মামা আলেয়ার রহস্যের কথা বলে যাচ্ছিল…সেই গ্যাসের নাম হল মিথেন গ্যাস। এই গ্যাসের নিজের কিন্তু জ্বলার ক্ষমতা নেই! আশপাশের শুকনো বাঁশ পাতা,শুকনো কাঠের ঘর্ষণের ফলে যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় তা থেকে ওই গ্যাসে আগুন লেগে যায় আর এমনি আলেয়ার সৃষ্টি করে ! আমরা তাকেই ভূত বলে ভয় পাই, বলি, আলেয়া ভূত !

মামা বলল, আলেয়ার ইংরেজী নামগুলি কিন্তু সুন্দর !–will-o’-the wisp, trier’s lantern, jack-o’-lantern.

সমাপ্ত

 

* আমার ‘ভূত ও ভূতুড়ে’ গল্পের বই থেকে নেওয়া

Likes Comments
০ Share

Comments (5)

  • - মনজুরুল আলম প্রিন্স

    আশেপাশের হেঁটে যাওয়া-
    মেয়েদের শরীর হতে ভেসে আসে গন্ধ;
    মাতলামি বাড়ে
    গান ওঠে গলায়,

     

    খুব ভালemoticons

    • - সুমন সাহা

      অনেক ভালোলাগা মন্তব্যে প্রিয়।

      অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানবেন।emoticons

      ভালো থাকবেন।

    - সুমন দে

    খুব সুন্দর । শুভেচ্ছা ।

    • - সুমন সাহা

      ভালো লাগলো জেনে প্রিয়।

      শুভেচ্ছা আপনাকেও।emoticons

    - পিয়ালী দত্ত

    khub valo

    • - সুমন সাহা

      ভালো লাগলো খুব, জেনে সত্যিই আপ্লুত হলাম অনেক।

      সুন্দর অনুভূতির জন্ম হলো।

      শুভেচ্ছা জানবেন।emoticons

      ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।

    Load more comments...