লবণের বৈয়ামের দিকে তাকিয়ে মুন্নুজানের চোখের কোণ লবণাক্ত হয়ে ওঠে। মাসের এই সময়টা সামলে চলতে চাইলেও এখন আর আগের মত পারেন না। হিসেবে ভুল হয়ে যায়। তাই মাসের শেষে সংসারের লবণটা বা তেলটা টান পড়ে যায়। এমন না যে তার সংসারে অভাব আছে। মাসের শুরুতেই বাজারের সময়ে হিসেবে কমবেশি হয়ে যায়। তাই হুটহাট মানুষটাকে বাজারে পাঠানো লাগে। অসময়ে বুড়ো মানুষটাকে বাজারে পাঠাতে মুন্নুজানের খুব কষ্ট লাগে। এখন নিশ্চয়ই তিনি আয়েস করে কম্বলের তলে পা গুঁজে বসে পত্রিকা পড়ছে। একটু আগেও কোরআন পড়ার আওয়াজ আসছিল। তাদের দুইজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে, এই মাসে কে আগে কোরআন খতম করবেন। মুন্নুজান এই প্রতিযোগিতাতে কখনো জিততে পারেন না। দুইজনের সংসারে কাজ কম মনে হলেও জীবনের দৈনন্দিন কর্মপ্রণালী অন্যান্য জনবহুল সংসারের মতই। তাই সব কাজ সেরে পড়তে বসতে গেলে মুন্নুজান স্বামী নাজিমুদ্দিনের কাছে হেরেই যান। প্রতি মাসে একবার করে কোরআন খতম দেওয়ার পর মানুষটা যখন বেশ খুশি খুশি চেহারায় তার দিকে তাকিয়ে বলে, কী, এবারও পারলে না তো? তখন মুন্নুজানের ভালই লাগে। দুইবছর আগে হজ সেরে আসার পর থেকে দুইজন নিঃসঙ্গ মানুষ নিজেদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা করেন যাতে মুন্নুজান আজ অবধি একবারও জিততে পারেননি।
এশার নামাজের ওয়াক্ত হয়নি। মসজিদে যেয়ে জামাতে নামাজ পড়বেন নাজিমুদ্দিন। কিন্তু যে কোনো মনোহরী দোকানে যেতে হলে খানিকটা হেঁটে বড় রাস্তায় যেতে হবে তাকে। শীতের রাত। স্বামীকে লবণ ফুরোবার খবরটা দিবেন কিনা তা নিয়ে মুন্নুজান দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকেন। সাঁইত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে এই একই ধরনের দ্বিধার সাথে বসত তার। অথচ তার স্বামীর কোনো বিরক্তিই নেই কোনো আবদারেই। মুন্নুজান ভাল করেই জানেন ঠিক এই মুহূর্তে বাইরের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা আর অন্ধকার কুয়াশার মাঝেও তাকে লবণ নিয়ে আসতে বললেই তিনি ছুটবেন। রাগতো করবেনই না বরং যেতে যেতে বলবেন, আর কিছু থাকলে বল। নাহ্ এই শীতের ভেতরে বুড়ো মানুষটাকে দোকানে পাঠাতে ইচ্ছে হচ্ছে না মুন্নুজানের। এমনিতেই গতকাল অনেক খাটিয়েছেন তাকে। চেয়ারের উপর দাঁড় করিয়ে তিন ঘরের মাকড়শার জাল পরিষ্কার করা, পর্দা খোলানো, ছাদে আচার দেয়া, সংসারের আরও টুকিটাকি কাজ করেছেন কাল দু’জন মিলে। এমনিতে মুন্নুজানের স্বামী নাজিমুদ্দিন বরাবরই সংসারী লোক। এই যে তিনি রান্না সেরে ফেললে তাকে আর বলতে হয় না। নিজেই মেঝেতে দস্তরখানা পাতেন, খাওয়ার পানিটা গরম করে নেন। বার্ধক্য জীবনের একাকীত্ব তাদের আরও আপন করে দিয়েছে। তাই বলে মানুষটাকে এই শীতে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।
মুন্নুজান পড়েছেনও বিপদে। লবণ ছাড়া তরকারি বসাবেন কী করে? পাশের ভাড়াটিয়া মেয়েটাও নেই। বাবার বাড়ি গেছে পিঠা-পুলি খেতে। থাকলে কোনো চিন্তাই ছিল না। মেয়েটার মনটা খুব ভাল। মেয়েটার নাম সাথী। স্বামী হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। সাথী সারাদিনই দুই বুড়ো-বুড়ির খোঁজ-খবর নেয়। বাটিতে করে এটা-সেটা দিয়ে যায়। মেয়েটা আর ওর ছোট বাচ্চা টুম্পার দিকে তাকিয়েই তো তিনি সিফাত আব্বার দূরে থাকার কষ্ট ভুলে থাকেন। পাশের দু’এক বাড়ি ঘরও বেশ দূরে। নাজিমুদ্দিনের কর্মজীবন কেটেছে সরকারি চাকরির সুবাদে জেলায় জেলায়। অফিসার্স কোয়ার্টারের পড়শীময় জীবনে মাসের শেষে তেল, নুন আর মরিচের অভাব দুর হয়েছে ভাবীদের সাথে বিনিময় প্রথায়। দিনগুলো কত মধুরই না ছিল! পেনশনের টাকা আর সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে নিজের জেলা টাঙ্গাইলে, শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক চিলতে জমির উপর একতলা বাড়ি করেছেন নাজিমুদ্দিন। দুই ইউনিটের বাসায় একটাই ভাড়াটিয়া আর তারা দুইজন। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন গত বছর। মাস দুই-তিন পর পর ছেলে না হয় ছেলে-বৌমা দুজনেই ক’দিনের জন্য ঘুরে যায়। এই তো আবার আসার কথা ওদের।
মুন্নুজান আর নাজিমুদ্দিনও ঘুরে আসেন ছেলের সংসারে। এইবার দু’জন কোরবানির ঈদ করেছিলেন ঢাকায়। নিজেদের বাড়িঘর রেখে ছেলে থাকে ঢাকায় ভাড়া বাড়িতে। মুন্নুজানের মনটা কেমন করে। ছেলেটা বৌমার নতুন হাতে কী খায় না খায়! এই তো ঈদের সময় বৌমা সাদা সাদা কী এক চায়নিজ কারি রাঁধল সিফাত আব্বাতো খেতেই পারল না! আবার নিরামিষের তরকারিতে দিল পাঁচফোড়ন। মুন্নুজান মৃদু আপত্তি করলেন, আমার আব্বা তো পাঁচফোড়ন খায় না বৌমা! বৌমা উত্তর দিল, না তো মা...উল্টো বলবে কম দিছো ক্যান। শুনে মুন্নুজানের বুকের ভেতরটা খচখচ করে উঠেছিল। ছেলের পাতের দিকে তাকিয়ে কেবল তার মনে হচ্ছিল, পেট ভরে না ছেলেটার। (চলবে) <span
Comments (8)
শুভেচ্ছা জানবেন, ভালো থাকবেন।
মন্তব্যহীন পোষ্ট।
যেহেতু এটি একটি রসরচনা ক্যাটাগরীর লেখা তাই নিজের পোষ্টে নিজেই মন্তব্য বাড়িয়েও কি কৌতুক করা যায় !! মনে হয় যায়।
হাঁহাঁহাঁ । ভালো লাগলো ।
অসাধারণ, অনেক অনুপ্রেরণা পেলাম। ভালো থাকবেন।