একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে আমি চাকরী করি। এর আগে টিউশনি করতাম, তারো আগে কিছুদিন বাসের হেলপারী করেছি। সাত বছর আগে মাষ্টার্স পাশ করেছি আমি। সামনের এই লাশটা আমার স্ত্রী। শুধু আমার স্ত্রীই নন, উনি আমার অতি প্রিয় মানুষ ছিলেন, ছিলেন আমার প্রান। আমার সেই প্রানকে মেরে ফেললো আমাদের কোম্পানীর মালিক আবদুল মালেক। কথাগলো বলে কেঁদে উঠল মামুন নামের যুবকটি উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে।
কাওরানবাজারে একটি স্থানে দাঁড়ালে অনেক সাংবাদিকের উপস্থিতি ঘটে, বিশেষ করে এরকমভাবে একটা লাশ দুহাতে ধরে নিয়ে এসে দাঁড়ালে তো কোন কথাই নেই। অনেক মানুষ আর সাংবাদিক এসেছেন মামুনের কথা শুনতে, সামনে এক নারীর মৃতদেহ। একটা পিকআপ ভ্যান দাঁড়িয়ে তাদের পেছনে। অবাক বিষ্ময়ে অপেক্ষা করছেন তাঁরা কী বলে ছেলেটা। কিছুক্ষন পর কান্না থামিয়ে মুখ খোলেন মামুন, মনে হয় অনেক দুর থেকে কথা বলে উঠলেন মামুন।
উত্তরের এক গন্ডগ্রামে ছিল আমাদের বাড়ী। ও মানে মিলারা চার ভাই বোন, ও-ই বড়। মোটামুটি নিম্নমধ্যবিত্ত ছিল ওরা। কিছু জমি ছিল ওদের। সেটা আর গঞ্জের ওদের একটা মুদিরখানার দোকানের কল্যানে দিন গুজরাণ খুব খারাপ হতোনা ওদের। কিন্তু নদী-ভাঙ্গনের এলাকা হওয়ায় দোকান এবং বসতবাড়ী দুটিই কয়েকদিনের ব্যবধানে এক বর্ষায় ভেঙ্গে নদীগর্ভে চলে যায়। নি:স্ব হয়ে পড়ে ওরা মাত্র একরাতের মধ্যেই। প্রচন্ড বিড়ি খেতেন মিলার বাবা। তাই ভেতরে ভেতরে হার্টের অসুখও হয়তো ছিল। বসতভিটা যেদিন ভেসে যায়, সে রাতেই মিলার বাবা সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মারা যান। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে পরিবারটি। মিলা তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী।
এই ঘটনার বছর দুই আগে থেকেই আমি গ্রামে থাকতামনা। গ্রামে আমাদের বাড়ীঘরও ছিলনা বলতে গেলে। নদীভাঙ্গনের কারনে আমাদের বসতভিটাও ভাঙত। আমরা অন্যত্র চলে যেতাম, সেখানে কোন এক চরের মধ্যে গড়ে তুলতাম বসত। সেই চর ভাঙতে ভাঙতে আবার আমাদের বসত ভেঙ্গে যেত। আবার আমরা চলে যেতাম অন্য কোথাও। এভাবেই একদিন বাবাকে হারাই আমি, আর মাকে তো হারিয়েছি কবে, মনে নেই। বড় এক ভাই ছিল আমার, অনেক বড়। আমাদের সেরকম খোঁজখবর রাখতনা। বাবার মৃত্যুর পর ইন্টার পাশ আমি এক আত্মীয়র বাসায় জায়গীর থেকে লেখাপড়া করে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করি।
গঞ্জের যে কলেজে আমি পড়তাম তার পাশে মিলাদের ছিল স্কুল। স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়ার পথে আমাদের দেখাদেখি হতো। বেশি আগ্রহ ছিল আমারই। কেন যেন খুব ভাল লাগত ওকে আমার। ও-ও অপছন্দ করতনা আমাকে, কমপক্ষে সেরকমই মনে হতো আমার।
ওদের বসতভিটা ভেসে যাওয়ার খবর আমি পাই আমার লজিংবাড়ীতে বসে। ছুটে যাই গ্রামে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাই ওদের পাশের এক বেড়ীবাঁধে। দেখি নিদারূন কষ্টের ওদের জীবন। অসুস্থ মা, ছোট দুটো ভাই আর ছোট বোনটাকে নিয়ে খেয়ে-না-খেয়ে মিলার করুন জীবন দেখে আপ্লুত হয়ে পড়ি আমি। বিয়ের প্রস্তাব দেই ওকে ওর মার সামনে। অতি বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখায় ও, বলে
আপনি কী মানুষ!, দেখেননা এখানে আমরা বাস করছি কত অসহায় অবস্থায়, আমাদের সকলের অবস্থা দেখে কোন লজ্জায় আপনি এটা বলতে পরেলেন?
দেখ, আমি বলি, চাচা নেই, তোমাদের কোন মুরুব্বি নেই আপাতত:। তাই-
তাই কী! তাই করূনা দেখাতে এসেছেন এখানে না? বেরিয়ে যান এখান থেকে। আমি, হাঁ আমি একাই আমার পরিবারকে দেখব। কারো অযাচিত করূনা আমাদের দরকার নেই, যান।
ফিরে আসি আমি এবং বারে বারে যাই ওখানে ওদের দেখতে। দুর থেকেই দেখি পাছে মিলা দেখে ফেলে আর আমার অসদুদ্দেশ্যের কথা চিন্তা করে। ওদের জন্যই একটা টিউশনি খুঁজে নেই এবং সমুদয় টাকা দিয়ে আসি ওর মার হাতে। প্রথমদিন নিতে চাননি উনি কোনমতেই। কিন্তু কেন জানি উনাদের অবস্থা দেখে সেদিন আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। বলেছিলাম
মা আপনি বিশ্বাস করেন আমি মিলার কারনে নয়, আমার মা-বোনেরা এই অবস্থায় থাকলে আমি কী কিছু না করে থাকতাম? মনে করেন আপনার একজন ছেলে আমি ।
মা বলেন, ওরা মানে মিলা তো কিছু করছে বাবা। এক বাড়ীতে গিয়ে সেলাইয়ের কাজ করছে, ওর ছোট ভাইটাকে এক হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। আর সরকারী ত্রাণ যা পাওয়া যাচ্ছে, যদিও খুবই কম, তবুও তো কিছু পাচ্ছি, তা দিয়েই চলে যাচ্ছে বাবা, লাগবেনা।
শেষে আমার চোখে পানি আসা দেখে যখন একটু নরম হওয়া ভাব দেখি আমি তাঁর মধ্যে, একরকম জোর করেই টাকা ক’টা গুঁজে দেই মায়ের হাতে, মুখে বলি আমি আপনার ছেলে হলে কী আপনি না করতে পারতেন মা! সবসময় আমাকে আপনার ছেলে মনে করবেন আপনি।
সেদিন চলে আসি এবং এরপর মোটামুটি নিয়মিত-ই যেতাম ওখানে। একদিন শুনি ওরা দুরের এক চরে বাঁশ আর ছন দিয়ে ছোট্ট একটা বসত বানিয়েছে এবং চলে গেছে ওখানে। মিলা ঢাকা চলে গেছে একটা চাকরী যোগাড় করতে, ওর এক কাজিন গার্মেন্টসে চাকরী করে, সেখানে।
শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার প্রচন্ড একটা ইচ্ছা আমার ছিল। আর তাই গ্র্যাজুয়েট হয়েই থেমে থাকতে চাইনি আমি। বড় ভাইয়ের কাছে কিছু টাকা নিয়ে আশা ইউনিভার্সিটিতে মাষ্টার্সে ভর্তি হয়ে যাই এবং টিউশনি করে চলতে পারব মনে করে চলে আসি ঢাকায়।
ঢাকায় টিউশনি চাইলেই খুব সহজে পাওয়া যায়না আর দিনযাপন তো করতে হবে। উপায়ান্তর না দেখে একটা বাসে হেলপারি করা শুরু করি। সেফটি বাস, মিরপুর টু আজিমপুর চলে বাসটা। হঠাৎ একদিন মিলাকে দেখে চমকে উঠি আমি। পরিচয় দেইনা এবং দেখিওনা। এভাবে আরো একদিন দেখি এবং প্রায়ই দেখি বাসে করে সে কোথায় কোথায় যেন যায় এবার ফিরে যায় মিরপুরে। একদিন ও আমাকে নাম ধরে ডাকে বাসের মধ্যেই। আমি ওর দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাইনা, এমন ভাব দেখাই যেন আমি আহসান নই। আমার লজ্জা লাগে বাসের কন্ডাক্টর বলে নিজেকে পরিচয় দিতে। ওরও হয়ত সন্দেহ ছিল আর তাই আর ডাকেনি।
আররেকদিন বাসের মধ্যে আমার মোবাইল বেজে ওঠে। অপরিচিত নাম্বার দেখে ধরিনা। মিলা তখন বাসেই বসা। দেখি আজ আর মিলা নামেনা, নামে একেবারে মিরপুরে, বাসের সবর্শেষ গন্তব্যে। বাস থামার আগে আবার একবার মোবাইলে রিং দেয় ও।
বিপদের আঁচ পেয়ে আমি তড়িঘড়ি দুরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু পারিনা। কোমল একটা হাত আমাকে তা করতে দেয়না। বলে কেন তুমি পরিচয় দাওনা আহসান?
আমি বাসের কন্ডাক্টর, আর তুমি চাকুরীজীবি। তোমাকে কেমনে পরিচয় দেই বলো।এরপর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় কিছু দুরের ওর বাসায়। যেতে চাইনি আমি। কী হবে প্রচুর্য দেখে ওর। আমি যে সামান্য বাসের কন্ডাক্টর।
পল্লবীতে বাস যেখানে থামে, সেখান থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে আমরা যে বাসার সামনে থামলাম, সেটা একটা ছয়তলা এ্যাপাটর্মেন্ট। এরই ৫ম তলায় একটা বাসায় নিয়ে গেল মিলা আমাকে জোর করেই। বাসাটায় ঢুকতেই যুবকমতো একজন বেরিয়ে গেল বাসাটা থেকে। কিছুই বললনা মিলা। তখনই আন্দাজ করতে শুরু করলাম অস্বাভাবিকতা। ভেতরে মিলার ঘরে আরেকটি বিছানায় শুয়ে আছে আরেক নারী অগোছালো অবস্থায়। কোন নড়াচড়া না করেই সে শুয়ে থাকল ওভাবেই। বুঝতে কিছু আর আমার বাকি থাকলনা মিলা কী করে।
মিলার দিকে তাকিয়ে আছি, ভাবছি কীভাবে হলো এসব! কীভাবে এই পঙ্কিল জীবনে এলো ও?
ভাবছ, কীভাবে হলো এসব, তাইতো? আমার ভাবনা বুঝে নিয়ে প্রশ্ন করে বসে ও।
হাঁ, তাইতো। বলি আমি।
আগে বলো, কতখানি ঘৃণা করতে শুরু করেছ আমাকে।
দেখ মিলা, আমি যা মনে করি, মানুষ চুড়ান্তভাবে বাধ্য না হলে এপথে আসেনা। তোমার উপর তোমার মা-ভাই-বোন নির্ভরশীল হয়ে আছেন, আমি শুনেছিলাম তুমি গার্মেন্টসে চাকরী করার জন্য ঢাকা এসেছ, নদীতে তোমাদের ঘরবাড়ী সব ভেসে গেছে মুহুর্তের মধ্যে। এই অবস্থায় তোমার এপথে আগমন এমনি এমনি হয়নি বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
জানতে চাইলেনা, গার্মেন্টসে চাকরী না করে কেন আমি এপথে এলাম?
হাঁ, সেটা জানতে চাই, বলো।
সেদিন কিছু জানা হয়নি এসম্পর্কে। প্রশ্নটা শুনে মিলা নীচের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে হঠাৎ করে জানতে চায় আমি তাকে একদিন বিয়ে করতে চেয়েছিলাম কী কারনে। আমি তাকে ভালবাসি সেজন্যে, না-কি ওর উপর নিতান্ত-ই এক দায়িত্বের বোধ থেকে।
বলি আমি, দু’টোই মিলা। আমি তোমাকে ভালও বাসতাম আর তোমাদের ঐ অবস্থায় দায়িত্ববোধ কেন আমার থাকবেনা বলো।
এখন তো ভালবাসা সব উবে গেছে তাইনা!
এটা কেন বলছ মিলা? তোমাকে এই অবস্থায় দেখে তোমার উপর আমার দু:খবোধ, দায়িত্ববোধ তো আরো বেড়ে গেছে আমার।
আর ভালবাসা?
দু:খবোধ, দায়িত্ববোধ থাকলে ভালবাসা থাকেনা মিলা? তবুও তোমার জানার জন্য বলছি, তোমাকে আগে আমি যত ভাল বাসতাম, এখনো সেরকমই বাসি।
এখানকার বাসিন্দা জেনেও?
হাঁ মিলা, জেনেও। আমি তোমাকে নিয়ে অন্যত্র ঘর বাঁধতে চাই। আর একটা কথা জেন, তোমার জায়গায় আমি হলে সংসার বাঁচানোর আমার আর কোন পথ না থাকলে এই পথেই কিন্তু আসতাম আমিও।
করুন চাহনীতে চেয়ে আছে মিলা আমার দিকে, চোখে পানি চিক্ চিক্ করে ওঠে ওর। মুছিয়ে দেই আমি সেই পানি আপনজনের মতো করে অতি মমতায়।
কিছু বলেনা ও। উঠে চলে আসি আমি একসময়, ও এগিয়ে দেয় দরজা পযর্ন্ত।
এরপর আমাদের মধ্যে মোবাইলে কথা হতো। আসলে গার্মেন্টসে চাকরী করার সময়ই জিএম কর্তৃক রেপড্ হয়ে যায় মিলা একদিন এবং পরে চাকরীর ভয় দেখিয়ে আরো অনেকদিন। পরে জিএম-এরই সহায়তায় এই ফ্ল্যাটে বাস করা শুরু করে ও জিএম-এর রক্ষিতা হয়ে। সংসার খরচা সব সে-ই দেয়, আর কড়া নজর রাখে ওর উপর।
আমাদের বিয়ের আগে তওবা করতে চায় মিলা, করেও এবং আমরা দশদিন একটা গোপন স্থানে চলে যাই। একা সময় কাটাই। শর্ত থাকে আমাদের মধ্যে যে, অবৈধ কাজ করবনা আমরা।
মহান আল্লাহর কাছে আমরা ক্ষমা চেয়ে সময়টা কাটিয়ে দেই।
একসময় কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেলি আমরা, আর একটা অতি ছোট্ট বাসায় বসবাস করতে শুরু করি। কিন্তু পিছু ছাড়েনা জিএম।
মিলার কথায় জিএম-ই আমাকে তার ফ্যাক্টরীতে চাকরী দেয়। পরে সে আর তার আগের অভ্যাসের বদল করতে চায়না। মিলাও কোনমতেই রাজী হয়না। আর এই দ্বন্দ্বের ফলেই খুন করে জিএম মিলাকে।
বন্ধুরা, এ-ই হচ্ছে আমাদের ইতিহাস, মিলার খুন হওয়ার ইতিহাস। জানিনা এ-খুনের বিচার হবে কি-না। তবে যাতে হয়, সেজন্য মিলার প্রিয় জন্মভূমিতে ওর লাশ নিয়ে যাওয়ার আগে আপনাদের অবগত করলাম।
Comments (4)
বেশ ঝাঁজালো...
ধন্যবাদ । শুভেচ্ছা জানবেন ।