Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

Azimul Haque

৯ বছর আগে লিখেছেন

অমোঘ আকর্ষন

রাত গভীর হয়ে চলেছে ক্রমেই, পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে, ঘুম নেই শুধু শুকতারার চোখে। কী ভেবে চলেছে ও! কেন ভেবে চলেছে? কোন অভাব তো নেই সংসারে ওদের। নিজে ডাক্তার, বড় ডাক্তার মা-ও। একই বাসায় থাকে দু’জন ওরা। আর কোন সদস্য নেই। অভাব না থাকারই কথা, নাই-ও। তবে!

ভেবে চলেছে শুকতারা, কে তার বাবা, কোথায় সে? জীবনের ছাব্বিশটা বছর কেটে গেছে, আজো চিনলনা কে ওর বাবা। শুনেছে, ওর জন্মেরও অনেক আগে মা-কে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন উনি অমূলক এক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যে, এই মেয়ে তার নয়। ও যখন বড় হয়েছে, অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে, অনেক জায়গায় খুঁজেছে ও বাবাকে। পায়নি, শুনেছে সেই যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে বাবা, আর আসেনি, কেউ আর কোনদিন দেখা পায়নি উনার। বাবার আত্মীয়রা বলেন, জাপান চলে গিয়েছিল বাবা, দু’চার বছর ওঁদের সাথে যোগাযোগ ছিল, তারপর থেকে আর উনি যোগাযোগ করেননি।

ভেবে পায়না শুকতারা, কেন এমন হলো। মা কী খুব উচ্ছৃংখল ছিল! মামা-খালারা তো বলেন, না মোটেই উচ্ছৃংখল ছিলনা তোর মা, খুব শান্ত ছিল। এরপর যে বর্ননা শুনেছে শুকতারা, তাতে কোনমতেই মনে হয়না যে, ও অন্যের ওরসজাত। তবে! হাঁ, বাবার একটা ভুলের মাশুল-ই বয়ে বেড়াচ্ছে ওরা। কী জবাব দেবে ও আজ মিনারকে? অনেকদিন বলতে চায়নি ও পুরো বিষয়টা ওকে। হাঁ, সংকোচ তো বটেই কিছুটা। আর ও নিজেও চায়না কারো সাথে হৃদয়ের কোন টানে জড়াতে। আবার মিনারকে ও উপেক্ষা-ও করতে পারেনা। কেন যেন ছেলেটা পিছু ছাড়েনা। একরকম জোর করেই ও জয় করে নিয়েছে শুকতারাকে। আকৃষ্ট হয়নি তা বলেনা শুকতারা। কলেজে ছয় বছরের শেষের তিনটা বছর ওরা অনেক কাছাকাছি থাকত। ইন্টার্নশীপের সময়টায় একত্রে নাইট ডিউটি পড়ে গেলে তা-ও করেছে ওরা একসাথে। তবে শুকতারার দিক থেকে কেন জানি সেরকম কোন সাড়া পায়নি মিনার আজো। রাগ করে তাই আজই বেঁধে দিয়েছে শেষসময়।

মাত্র নয় বছর বয়সে শুকতারা যখন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী, তখন ওর মার সাথে আর একজনের ঘরে চলে যায় ও। মা বলে তোর সৎবাবা। সৎ-এর অর্থ তখনো ভাল করে বুঝে ওঠেনি ও। শুধু ‘বাবা’ শব্দটা আছে বলে মুখে অনাবিল এক হাসি দিয়ে বরন করে নেয় ও ওর সৎবাবাকে। দিনকয় পর সৎবাবার রহস্য বুঝে উঠতে শুরু করে ও অতি ধীরে।

খুব সুন্দর দু’টো চোখ আছে মার, আর এটাই হলো কাল। কারো দিকে তাকালেই মনে হতো তার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে। আর এটাই সৎবাবার সন্দেহের ভিত্তি, যার বেড়াজালে পড়ে মাত্র তিন বছরের মাথায় সৎবাবার ঘর ছাড়তে বাধ্য হলো মা। সাথে নিয়ে এলো ফুটফুটে এক শিশু, ওর ভাই। সেই থেকে একসাথে ওরা তিনজন। সময় সময় সৎবাবা আসত, এসে ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে যেত, দু’একদিন পর ঠিকই আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেত।

সৎবাবা ওকে খারাপ নয়, ভালই বাসত। তবে কেমন যেন এক ধরনের স্বাথর্পরতা ভর করে থাকত তার মধ্যে। বিশেষ করে মার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলোতে শুকতারার তা-ই মনে হতো। কেন যেন মার এতটুকু ব্যথা-বেদনা সহ্য করতে পারতনা শুকতারা। আর এভাবেই সৎবাবা আর ওর মধ্যে একটা ঘৃণার ভাব তৈরী হয়ে উঠতে শুরু করে। সৎবাবা আর ওর মধ্যে স্পষ্ট এক দুরত্ব তৈরী হয়ে যায় আপনাআপনি। ডাক্তার হয়ে যাওয়ার পরও দুর হয়নি সেই ভাব ওর।

খারাপ লাগতনা সৎবাবাকে শুকতারার। উনিও ডাক্তারই ছিলেন, মার সাথে একই অফিসে চাকরী ছিল ওনার। জীবনে কোন পুরুষের সাথে একই বাসায় বাস, যে পুরুষ মাকে ভালবাসেন, আর মা-ও তাকে। মনে পড়ে শুকতারার, যেদিন ওঁরা ওর সম্মতি নিতে এসেছিল। কী বলবে কিছু না বুঝে ও শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল, একবার মার, আরেকবার ওর আজকের সৎবাবার দিকে। পাশে বসিয়ে উনি সেদিন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। স্নেহমাখানো সেই আদরের কথা মনে পড়লে আজো ওর মধ্যে আশ্চর্যরকমের এক শিহরণ বয়ে যায়। জীবনে বাবার মতো কারো প্রথম আদর। ক্রমেই এভাবে সৎবাবা ওর মনে একটা শ্রদ্ধার জায়গা দখল করে নিয়েছিল। অন্যকোন সিনিয়র পুরুষের সান্নিধ্যে না আসায় সৎবাবাকে-ই তার একধরনের আদর্শ মনে হতো। কিন্তু পৃথিবীতে মায়ের স্থান সবার উপরে। দুরত্বটা তাই সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।

মায়ের আসা দেখে চমকে উঠে শুকতারা। মা তুমি এতো রাতে!

কয়েকদিন থেকে দেখছি তুমি ঘুমাওনা রাতে, মানে তোমার ঘুম খুব কম হয় ইদানিং, কেন?

তুমি তো জানো মা আমি আমার বাবাকে আজো খুব ফিল করি, ইদানিং ফিলিংসটা বেশী হচ্ছে মা, এই আর কী; আর, আর মিনারটাও জ্বালাচ্ছে খুব, ডেডলাইন দিয়েছে কাল।

বুঝে ফেলেন বেগম মমতাজ আর নয়, জানাতে হবে শুকতারাকে সবকিছু। মেয়েটা কষ্ট পাবে বলে এতদিন জানাননি। বাবা ইহজীবনে আর বেঁচে নেই জানলে যেকোন সন্তানই দু:খ পাবে, এজন্য গোপন করে রেখেছেন যে কথাটি, আজ আর সেটি গোপন করা ঠিক হবেনা বলে মনে হয় তাঁর।

আসলে একটা অঘটনের মাধ্যমে তোমার জন্ম। তুমি যাকে তোমার আপন বাবা বলে কল্পনা করো, সে তোমার বাবা নয়। তার সাথে আমার অনেক ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। বিয়েও হয়েছিল, তবে বিয়ের আগেই এক রাতে নাইট ডিউটিতে আমি ধর্ষিতা হই। অবশ্য সম্পূর্ন ধর্ষিতা বলবনা, বললে তা হবে সত্যের অপলাপ। আমারও খুব একটা অসম্মতিতে হয়নি অঘটনটা। ধর্ষকও আমাদেরই ব্যাচমেট, সেদিন একইসাথে আমরা নাইট ডিউটি করছিলাম। ঘটনার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা বিয়ে করব। তোমার কল্পনার বাবাকে নয়, যার সাথে তখনো আমার সম্পর্ক ছিল। ও-ও রাজী ছিল। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি, হঠাৎ করে এক রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা যায় ও, তোমার জন্মদাতা বাবা।

হিম হয়ে আসে শুকতারার সারা শরীর। এতোদিন বলোনি কেন, এজাতীয় প্রশ্ন করা ছাব্বিশ বছর পর আজ বাহুল্য মাত্র। আর তাই কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে ওরা অনেক, অনেকক্ষন। ডুকরে কেঁদে উঠতে থাকে শুকতারা এক আধবার। জীবনে বাবার আদর তো দুরের কথা, বাবাকে চোখে না দেখাটা অতি বড় এক অভিমানের জায়গা ওর। হেঁচকি তুলে উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে ও একসময়। কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়া মা বুকে টেনে নেয় ওকে।

ছোট্ট শহরটার একপ্রান্তে অবস্থিত কবরস্থানটার পাশে কিছু বাড়ীঘর গড়ে উঠেছে। ওখানেরই একটা বাড়ীতে জ্বলজ্বল করছে একটা সাইনবোর্ড, ডা. শুকতারা। এখানেই বাস করে আসছেন উনি প্রায় বিশটা বছর। না, আর কেউ না, মিনারও। মিনারকে না করে দিয়েছেন সেদিনই। নিজেকে খুব একটা বৈধ মনে করেননা শুকতারা আর এজন্যই এই অবৈধতা নিয়ে আর কারো যাতে আর জন্ম না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। সহজে মানতে চায়নি মিনার, মা-ও জোরাজুরি করেছিলেন অনেক। কিন্তু শুকতারার কাঠিন্যের কাছে হার মানতে বাধ্য হন সবাই। পৃথিবীতে বাবাকেই শুধু তাঁর যেকোন অপরাধের জন্যই হোক-না-কেন, মাফ করে দেয়া যায় বলে কেন জানি মনে হয় শুকতারার, আর কাউকে নয়।

প্রতিদিন ভোরে উঠে বাবার কবরের কাছাকাছি এসে দাঁড়ানো আর রাতে সব কাজ শেষে বিছানায় যাওয়ার আগে বাড়ীর বারান্দা থেকে কিছুক্ষন কবরের দিকে তাকিয়ে থাকা, এ-ই হচ্ছে ডা. শুকতারার নৈমিত্তিক রুটিন। এভাবেই কেটে গেল বিশটা বছর, আরো যে যাবে বছর কত…
Likes Comments
০ Share

Comments (2)

  • - টোকাই

    সুন্দর ভাই ।