Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

তৌফিক পিয়াস

০ সেকেন্ড আগে লিখেছেন

বেওয়ারিশ লাশ

আমি একটা বেওয়ারিশ লাশ। এমন না যে আমার বাবা মা নাই। এরকমও না যে তারা কেউ বেঁচে নাই। তারপরেও আমি বেওয়ারিশ। আমার দেহটা পরেই আছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ মর্গে। আমার এমন অবস্থা কিভাবে হল তা শুনবেন? আসুন তাহলে শুরু থেকে শুরু করি। আমার নাম শংকর দাস। ধর্মে হিন্দু তা তো বুঝাই যায়। আমাদের জাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কারণ আমরা নিচু জাতের। তবে আমাদেরও জাত আছে। শুদ্র। ধর্মের কথা আগে আনার কারণ আছে। সেটা শেষে গিয়ে ধরতে পারবেন আশা করছি। আমার বাবা দাওকান্দি গ্রামের একজন মুচি। দাওকান্দি বাজারে রাস্তার ধারের একটা গাছের নিচে বসে উনি হাজার মানুষের জুতা সেলাই করেন। মানুষটা ভগবানের আশীর্বাদে খুব কষ্ট করেন। আমি তার একমাত্র সন্তান। আমার আগে আরও একটা ছেলে হয়েছিল। ভগবান তার ভাগ্য বলে কিছু লিখেনাই। আড়াই মাসের মাথায় নিওমনিয়া হয়ে মারা যায়। বাবা জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। তার যুগে জাত-জাতি ভেদাভেদির কারনে উনি ইচ্ছা থাকা সত্তেও পড়াশুনা করতে পারেননি। কিন্তু আজ যুগ পাল্টে গেছে। তাই আমার বাবাও চায় না যে আমরা তার মত কষ্ট করি। তাই আমাকে পড়াশুনা করানোর জন্য তিনি সব কিছু করেছেন। ধার-কর্য, কিস্তি করে হলেও তিনি কোনদিন আমার পড়াশুনার কমতি করেননি। নওহাটা কলেজ থেকে পাশ করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট এ ভর্তি হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস নওহাটা কলেজ পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে আসে। নওহাটা থেকে দাওকান্দি ১৬ কিলোমিটার হয়। আমার বাড়ি আরও সাড়ে চার কিলো। যাওয়া আসার সমস্যার কারনে মাদারবক্স হলে থাকি। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার করে আমি বাড়ি আসি। মা খুব খুশি হয়। হলের খাবার ভাল হয়না ভেবে আমার জন্যে বেলে মাছ এর ভর্তা আর খেসারির ডাল রান্না করে। আমি আসলে বাবা খুব লজ্জা পান। এখন থেকেই বাবা আমাকে একটা সম্মান দেওয়া শুরু করেছেন। তার ধারণা, যে সংসার চালায় সে-ই ঘরের গুরুজন। বিগত এক বছর ধরে আমি বাবা মায়ের হাতে সংসার খরচটা দিচ্ছি। ৩-৪ টা টিউশনি করে আর কোচিং এ কাজ করে মাস শেষে হাজার পাঁচেক টাকা হাতে আসে। ৬০০ টাকা নিজের কাছে রেখে বাকিটা বাসায় দিয়ে পাঠাই। আমার বাবার মোবাইল নাই, কেনার যোগ্যতাও নাই। তাই আমিও মোবাইল রাখিনি। কার সাথে কথা বলবো?

আমি মারা গিয়েছি আজ থেকে ৯ দিন আগে। ২২শে নভেম্বর এ। আমার সব মনে আছে সেই দিনটার কথা। আমি ক্লাস শেষ করে টুকিটাকি চত্তরে আনোয়ার ভাইয়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম। সবাই জানে এই জায়গাটা রাজনৈতিক হানাহানির শিকার। তবে আমি এখানে মারা যায়নি। চা খাচ্ছিলাম যখন, তখন হটাৎ করে হইহই রইরই শুরু হয়ে যায়। দুই দলের মাঝে সামান্য কি একটা কথা নিয়ে রগ কাটাকাটি হয়ে গেছে। সমস্যা হল, সবার দৌড়া দৌড়ীর মাঝে আমি একটা ঝটিকা মিছিলের মাঝে ঢুকে পড়েছিলাম। ভগবান সাথে ছিল বলে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। সেইদিন আর ক্লাস করতে যাইনি। ক্লাস হয়নি। স্যাররা সবাই ‘ডে ডিসমিস’ করে চলে গিয়েছিলেন। আমাদের ভার্সিটিতে এটা খুব হয়। সামান্য মারামারি লাগলেই ‘ডে ডিসমিস’। হলে ফিরে আসলাম। স্নান সেরে ডাইনিঙে খেতে গেলাম। সেখানে আজকের মারামারি সম্পর্কে একটু ফিসফিসানি শুনলাম। কাকে যেন রগ কেটে দেওয়া হয়েছে। সে এখন আরএমসি তে। তাছাড়া লাঠিশোটা নিয়ে সব এসেছিল। কিন্তু পুলিশ এসে ফাঁকা ফায়ার করায় আর তেমন কিছু হয়নি। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি আমার রুমে ফিরে আসি। ঘরটা খুব নোংরা হয়ে ছিল। আমার রুমমেট বাড়ি গিয়েছিল। ভাবলাম যে এই সুযোগে ঘরটা পরিস্কার করি। করলামও। কিন্তু শুরু হল হাঁচছি। আমাদের রাজশাহীর ষাট শতাংশ মানুষের এই সমস্যা আছে। আমাদের রক্তে ইসোনোফিল বেশি থাকার কারনে সামান্য ধুলাবালিতে হাঁচছি হয়। আমার এটা আবার মাঝে মাঝে হাপানির টান ধরে ফেলে। আমার ঠাকুমারও এই সমস্যা ছিল। যাই হোক, টান উঠার পর মনে পড়ে ইনহেলারের কথা। তখনকার মত অবশ্য কিছু ছিল। কিন্তু সেদিন বিকালে একটা ইনহেলার না আনলেই না। বিকালে বের হলাম। বিনোদপুর বাজার ছাড়া আমার ইনহেলার এখানে আর কোথাও পাওয়া যায় না। ভেবেছিলাম যে ইনহেলারটা নিয়ে ভদ্রাতে পড়াতে যাব। ইনহেলার নিলাম। হাতে সময় ছিল, তাই আর অটো ধরলাম না। বিকালে একটু হাটাহাটি করা ভাল। তাছাড়া ভদ্রা বেশি দুরেও না। আমি খেয়াল করেছিলাম না, কিন্তু ওষুধের দোকান থেকে তিনটা দাদা আমাকে ফলো করছিল। আমার তেমন সন্দেহও হয়নি। আমি রাজনীতি করি না, কারো টাকা মারিনি, কারো সাথে প্রেমট্রেম করি না- তেমন কিছুই করি না যে আমাকে ফলো করতে হবে। তারপরেও করেছিল। রুয়েট আর ভার্সিটির মাঝে একটা রাস্তা আছে ভদ্রা যাওয়ার শর্টকাট হিসেবে। আমি সেটাতে গেলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর জায়গাটা একটু নির্জন হয়ে গেলে সেই তিনজন পিছন থেকে আমাকে ডাকে। আমি থেমে যাই। তারা কাছে এসে বলে,
- কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
-ভাই, ভদ্রাতে।
-কেন?
-ভাই, প্রাইভেট পড়াতে।
- আজ মিছিলে কি করছিলি?
- ভাই আমি মিছিল টিছিল করি না।
কথাটা শুনে তাদের দুইজন হো হো করে হেসে ফেলল। আরেকজন চটাশ করে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
-আমাদেরকে মিথ্যা কইতাসিস হালার পো?
-না ভাই সত্যি কইতাসি।
-তুই আজ সকালে মিছিলে যাস নাই?
-না ভাই।
এরপর অন্য দুইজনের দিকে ইশারা করে বড়ভাই আমার থুৎনি চেপে ধরল। অন্য দুইজন সাথে সাথে আমার হাত দুইটা দুইপাশ থেকে ধরে ধস্তা ধস্তি শুরু করল। সামনের জন সাথে সাথে একটা রুমালের মধ্যে শক্ত কি যেন একটা দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে দিল। আমাকে এরপর উল্টো করে মাটিতে ফেলে আমার হাত পা রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেলল ওরা। এরপর আর কোন কথা নাই। তিনজন মিলে যে যেভাবে পারে, লাত্থি-কিল-ঘুষি মেরেই চলল।

আমার চোখের পানি, ফাটা নাকের রক্তে সাথে মিশে গিয়েছিল। আমার গলার উপর কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়েছিল। আমি নিশ্বাস নিতে পারি নি। যা কিছু দেখছিলাম সব লাল, যা কিছু বলছিলাম সব গোঙানি। কেউ ছিল না শোনার জন্য। আমি এভাবে কিছুক্ষণ মার খাওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপর ওরা আমার পায়ের রগ কেটে দিয়ে যায়। আমি সেখানেই পড়ে থাকি। কেউ দূর থেকে দেখলেও আমাকে বাঁচাতে আসেনি। হায়রে অমানুষ!!!

সাড়ে তিন ঘণ্টার মত মরে পড়ে থাকা আমার এই দেহ দেখতে পায় ৮ বছর বয়সের এক টোকাই। সে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে লোক জরো করে। পুলিশ আসে। সারা সন্ধ্যারাত ধরে নানা রকম তদন্ত করে আমাকে একটা চাটাইয়ে পেঁচিয়ে একটা ভ্যানে উঠিয়ে মতিহার থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমার লাশ পড়ে থাকা অবস্থায় এক হাবিলদারকে বলা হয়েছিল আমার মানিব্যাগ থেকে এভিডেন্স নিতে। মানিব্যাগের সবই সে এভিডেন্স বক্সে রাখে, শুধু আমার ৫০০ টাকা বাদে। হাবিলদার চালু ছিল। রিপোর্টে লিখে যে আমার পকেটে ১৩২ টাকা পাওয়া গেছে। আসলে কিন্তু ছিল ৬৩২ টাকা। হায়রে দেশের পুলিশরে!!!

থানার সামনে আমার লাশ পড়ে থাকল ২ ঘন্টা। পুলিশ ভার্সিটি থেকে খোঁজ নিয়ে অনেক সুত্র বের করে আমার নাম ঠিকানা জোগাড় করে। এরপর আমার লাশ পাঠানো হয় মর্গে। ময়না তদন্তের জন্যে। মর্গের কষাই ডাক্তার আমাকে যে কত টুকরা করল তা আমিও বলতে পারব না। তবে যত টুকরা করা হয়েছিল, তত টুকরা ফেরত আসে নি। আমার চোখ খুলা ছিল। সে সামান্য বিশ হাজার টাকা দিয়ে আমার কিডনি দুইটা বেঁচে দিল। হায়রে ডাক্তার রে!!!! পুলিশ গিয়েছিল দাওকান্দিতে, আমার বাবা মার কাছে। গিয়ে লাভ হয়নি। সংবাদ দিয়েছিল যে আমার খুন হয়েছে। কিন্তু লাশ দেয়নি। বলেছিল যে থানায় যেতে। বাবা গিয়েছিলেন। থানা থেকে ইনভেস্টিগেশান চালানোর খরচ বাবদ ১৫০০০ টাকা চায়। বাবা দিতে পারেননি। থানা থেকে ক্লিয়ারেন্স দেয়নি। বাবা টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করেন অনেক, পারেন নি। কেউ দেয়নি। হায়রে সমাজ !!! মর্গে একটা লাশ এর খোঁজ ৭ দিনের ভিতর থানা থেকে দেওয়া না হলে সেটা বেওয়ারিশির জন্যে আবেদন করা হয়। থানা থেকে তা সাক্ষর হয়ে চলেও আসে। হয়ে গেলাম আমি বেওয়ারিশ।

আজ নবম দিন। আমাকে তুলে দেওয়া হয়েছে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবকের হাতে। তারা আমার সৎকার করছে। আমি বুঝলাম না এরা কেমন স্বেচ্ছাসেবক। তাদের হাতে আমাকে কাগজ কলম সহকারে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে লেখা আছে আমার নাম শংকর দাস। আমি যে হিন্দু, সেটা সবার বোঝবার কথা। এরা কেন বুঝল না? একটা হুজুর ডেকে এনে আমাকে দাফন করে দিল গৌরাহাঙ্গা গোরস্থানে। হায়রে যুব সমাজ রে!!!! আমার দুঃখী বাপ আমার সাথে দেখা করতে আসবে। গোরস্থানের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে আশীর্বাদ করবে। আমি শুনবো। আমিও প্রার্থনা করি, “হে ভগবান! আমার বুড়ো বাপ-মা কে দেখাশুনার জন্যে এখন আর কেউ নাই। তুমি তাদের দেখো। আমার মুখে আগুন হল না। তাদের যেন তা না হয়। তোমার পায়ে পড়ি, হে প্রভু। ”

Likes Comments
০ Share

Comments (0)

  • - রুদ্র আমিন

     যতটুকু জ্ঞান আছে চেষ্টা করি। আপনার কবিতায় অনেক কিছু জানতে পারলাম ভাইজান। সুন্দর এবং শেখার মতো কবিতা।

    - জিয়াউল হক

    ছড়া পড়ে মুগ্ধ হলাম কিন্তু ভাবিত হলাম বাংলা একাডেমির ঘন ঘন বানান রীতি পরিবর্তনের কারণে। আসল সমস্যাটা যে কোথায় কে জানে!

    - শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

    বাঙলা একাডেমীর বানান রীতি অনুযায়ী আগে যা শিখছিলাম সব উল্টাপাল্টা লাগে। কি আর করা।

    Load more comments...