Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শফিক সোহাগ

৭ বছর আগে লিখেছেন

রাঙ্গুনিয়া ভ্রমণে থিয়েটার ওয়ার্কশপ চট্টগ্রাম

থিয়েটার ওয়ার্কশপ চট্টগ্রামের নতুন নাটক “ইজ্জত” মঞ্চে আনতে দীর্ঘ দিন সময় লেগে গেলো । দীর্ঘদিন টানা কাজ করে সবাই অনেকটা ক্লান্ত । তাই একটু সতেজতার জন্য দলীয় সভাপতি তাপস দাদাকে অনেক দিন ধরেই আমি বলে আসছিলাম একটি ভ্রমণ আয়োজন করার কথা ।দাদা রাজি হলেন । অতঃপর ভ্রমণ আয়োজনের দায়িত্বভার আমার কাঁধেই চড়ালেন । আমাকে আহ্বায়ক করে ভ্রমণ পরিচালনা কমিটি ২০১৭ গঠন করা হল । কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন আশরাফুল, উদয়ন ও কামরুল । ভ্রমণের তারিখ নির্ধারণ করা হল ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। ,শুরু হয়ে গেলো ভ্রমণ পরিচালনা কমিটির কর্ম তৎপরতা ।ভ্রমণের শুভেচ্ছা ফি সংগ্রহ, বাজেট তৈরি, আনুষঙ্গিক আয়োজন এবং সবাইকে বিন্দু পরিমাণ কষ্টমুক্ত রেখে সুন্দর একটি দিন উপহার দেওয়ার জন্য কমিটি বড়ই ব্যস্ত।

১৫ ফেব্রুয়ারি আমি আর আশরাফুল রাঙ্গুনিয়া গিয়ে ভ্রমণের স্থান সমূহ রেকি করে এলাম । আমাদের ভ্রমণের স্থান বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান “কোদালা চা বাগান” ও “শেখ রাসেল এভিয়ারি এন্ড ইকো পার্ক”। ,সেই সাথে লুসাই কন্যা কর্ণফুলীর মন মাতানো ঢেউয়ের উপর নৌকা বিলাস তো থাকছেই ।১৬ ফেব্রুয়ারি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ভ্রমণ কমিটির সর্বশেষ প্রস্তুতি সভায় অসমাপ্ত কাজগুলো বণ্টন করে দিলাম ।প্রতিটি ভ্রমণের পূর্ব রাত আমার কাছে চাঁদরাতের আমেজময় মনে হলেও; দায়িত্বের কারণে এই ভ্রমণের পূর্ব রাতটি ছিল আমার কাছে পরীক্ষার পূর্ব রাতের স্বরূপ ।

 

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ । ,সকাল সাড়ে ৭ টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে বাস এসে হাজির । মাইক সহকারিরা বাসে মাইক লাগাতে ব্যস্ত । ধীরে ধীরে ভ্রমণ পিয়াসীগণ সমবেদত হতে শুরু করেছেন । সকাল ৮ টা ৫০ মিনিটে আমাদের যাত্রা শুরু হল ।সবার চোখে মুখেই উল্লাসের আভা ।সকলেই মেতে উঠেছেন উল্লাসে । সেই সাথে সেরে নেওয়া হচ্ছে সকালের নাস্তা । এরই মধ্যে হঠাৎ মাইক্রো ফোন হাতে নিয়ে মারুফ শুরু করলো ব্যতিক্রমী পারফর্মেন্স । সুরে সুরে তালে তালে অবিকল ভিক্ষুকের অভিনয় ! আমরাও সবাই তাকে ভাংতি পয়সা দিতে ভুল করলাম না ।

 




আমরা পৌঁছে গেলাম ফেরিঘাটে । সেখানে পূর্বেই বুকিং করা দুটো ইঞ্জিন চালিত নৌকা প্রস্তুত ছিল । সবাই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে নৌকায় উঠে বসলাম । শুরু হল আমাদের নৌকা বিলাস ।তাপস দাদা আর বৌদি দুজনেই ভয়ে শক্ত হয়ে আছেন । সাঁতার না জানায় ভয় । অবশ্য আমি নিজেও সাঁতার জানি না । টিপু ভাই সেলফি তোলার জন্য উঠে দাঁড়ালে নৌকা হাল্কা নড়ে উঠে । আর তখনই তাপস দা চিৎকার দিয়ে বলেন, “ঐ টিপু, আরে বস বেটা, ছবি পরে তুলিস, নৌকা নড়ে”,টিপু ভাই আরও উৎসাহ নিয়ে ছবি তুলতে লাগলেন ।





আমরা উপভোগ করছি লেকের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য সেই সাথে সবাই মিলে গেয়ে চলেছি গান । নদী আর লেক নিয়ে যত গান আছে খুঁজে খুঁজে তা গেয়ে চলেছি ।  মামুন ভাই নৌকায় চড়ে লেকের জলে পা ভিজিয়ে তৃপ্তি গ্রহণে ব্যস্ত ।ইমু আর লিটন ভাই বক বকানিরত । তাদের গবেষণামূলক বকবকানির বিষয়বস্তু হল লেকের পাড়ে গড়ে ওঠা টয়লেট সমূহ, যা লেকের জলকে দুষিত করছে ।  সূর্য তখন পূর্ণ যৌবনময় । বিপরীত দিক থেকে আসা অপর একটি ভ্রমণ দলের বড় নৌকা আমাদেরকে অতিক্রম করার পর শুরু হয় ছোট ছোট ঢেউ; তার সাথে আমাদের দোল দোলনি । আমি গুনগুন করে গেয়ে চলেছি সেই জনপ্রিয় গানটি -


ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত

লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে

যার গই কর্ণফুলী     


 

ইতিমধ্যে ২৭ মিনিট নৌকা ভ্রমণ শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান- কোদালা চা বাগানে ।১৮২৮ সালে কোদালায় এই চা বাগানটি গড়ে উঠে । লেকের পাড় ঘেঁষে সবুজ বনায়নে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর চা বাগানটি । প্রকৃতির নান্দিকতা উপভোগে আমরা সবাই ব্যস্ত । এমন নয়নাভিরাম পরিবেশে এসে সবার মধ্যেই উৎফুল্লতা বিরাজমান । সুন্দর এই মুহূর্তকে ক্যামেরা বন্দী করে রাখতেও কেউ ভুল করেন নি । সেলফি, সিঙ্গেল ছবি, গ্রুপ ছবি সবই চলছে । টিটু দা পরেছেন মহা ডিএসএলআর বিড়ম্বনায় । তাঁর কাছে ডিএসএলআর থাকায় সবাই শুধু বিরক্তই করে যাচ্ছে। আর যেখানে ছবি নেশায় চরম আসক্ত জুয়েনা আফসানা আছে সেখানে টিটু দা বেচারার কি পরিস্থিতি হতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । জয় দা’ও টিটু দা’কে কম প্যাড়া দেন নি । এদিকে তাপস দাদা, মাসুম ভাই, টিপু ভাই নায়কের স্টাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত ।

 


 




চা বাগান ভ্রমণ শেষে আমরা পুনরায় নৌকায় চড়ে ফেরীঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । সবার মধ্যেই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের আত্মতৃপ্তি বিরাজ করছে । চা বাগানে যাওয়ার পথে ২৭ মিনিট সময় লাগলেও আসার পথে সময় লেগেছে প্রায় ৪৮ মিনিট (প্রিয় পাঠক, চা বাগান থেকে ফেরার পথ স্রোতের বিপরীতে হওয়ায় সময় বেশি লেগেছে । ভ্রমণের সময় আপনারা সেভাবেই পূর্ব প্রস্তুতি রাখবেন) । , প্রতিটি ভ্রমণে আমি সময়ের পরিমাণ লিখে রাখলেও এবার তা পারিনি । তবে সময়ের পরিমাণ মনে রাখতে আমাকে সহযোগিতা করেছে প্রিয় বান্ধবী ইমুর শিশু কন্যা মিষ্টি মা’মনি স্মিতা ।  

 



ফেরীঘাটে অপেক্ষমাণ আমাদের বাসে করে মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা চলে এলাম শেখরাসেলএভিয়ারিএন্ডইকোপার্কে । মাথাপিছু প্রবেশ ফি ২৩ টাকা হলেও বার্ডস ব্রিডারস এসোসিয়েশনের সভাপতি ও আমাদের থিয়েটার দলের সহ-সভাপতি টিপু ভাইয়ের সৌজন্যে আমরা পুরো টীম ফ্রি’তে প্রবেশ করলাম । গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই ডান পাশে চোখে পরে কৃত্রিম লেক ও কৃত্রিম দ্বীপ । তার পাশেই রয়েছে এই পার্কের মূল আকর্ষণ ক্যাবল কারের ষ্টেশন । আর সামান্য সামনে এগিয়ে বাঁ পাশে রয়েছে পাখি প্রদর্শনী গ্যালারী । ওখানেই আমরা সবাই বসে রেস্ট নিলাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো দুপুরের খাবার । খাবারের পর্ব শেষে সবাইকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত উন্মুক্ত ভাবে বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া হল ।

 




প্রায় ২১০ হেক্টর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পার্কটি । আমি, তনয়, রানা, উদয়ন, জিৎ, মাহবুব দল বেঁধে পাহাড়ের উপড় উঠতে থাকি । খানিক যাওয়ার পর বাঁ পাশে চোখে পরে দোলনা ও শিশুদের কিছু রাইডস । আমাদের টীমের শিশুরাও সেখানে আনন্দে মেতে উঠেছে । ডান পাশে দেখা গেলো সিঁড়ি; যা পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে মিলিত হয়েছে । কিছুটা সামনে এগুতেই চোখে পরে পাখির এভিয়ারি । সেখানে রয়েছে ককাটেল, টার্কি, বনমোরগ, ময়ূর, তিতির আরও অনেক পাখি ।             

 



আমরা এবার নিচে নেমে ক্যাবল কারের ষ্টেশনে এলাম । জনপ্রতি ২৩০ টাকায় টিকেট নিয়ে শুরু হল ক্যাবল কার এডভেঞ্চার । প্রায় ২.২ কিলোমিটার (যাওয়া-আসা ৪.৪ কিলোমিটার) লম্বা ক্যাবল দিয়ে এই কারে চড়ে উপভোগ করছি কাপ্তাইয়ের অপরূপ সৌন্দর্য ! ক্যাবল কারের ভ্রমণটি অনেকটা হেলিকপ্টারের ভ্রমণের মতই মনে হচ্ছিল । পাহাড়-আরণ্যের সৌন্দর্য উপভোগে আমরা মুগ্ধ ! আমার কলিগ নাজিমের গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনিয়া । আমি রাঙ্গুনিয়া ভ্রমণে এসেছি জেনে সে পার্কে ছুটে এলো দেখা করতে । তার সাথে দেখা হওয়াটাও ছিল একটা সারপ্রাইজ !

 



বিকাল সাড়ে ৪ টায় গ্যালারীতে শুরু হল আমাদের মূল পর্ব “আনন্দ আড্ডা” অনুষ্ঠান । অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা আমি নিজেই করেছি । শুরুতেই সভাপতি তাপস দাদাকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করলাম । দাদা এলেন । তাঁর অভিনীত যেকোনো একটি নাটকের যেকোনো একটি সংলাপ; যা তিনি খুব বেশি ফিল করেন, সে সংলাপটি অভিনয় করে দেখাতে অনুরোধ করলাম । দাদা বেধুয়া নাটকে তাঁর কন্যা চরিত্রে অভিনয় করা জুয়েনা আফসানাকে মঞ্চে আসার অনুরোধ জানালেন । তারপর দুজনে মিলে বেধুয়া নাটকের একটি দৃশ্য অভিনয় করে দেখালেন । এরপর একে একে প্রত্যেকেই যার যার অভিনীত নাটকের একটি অংশ অভিনয় করে দেখালেন ।  

 

জমে উঠেছে আমাদের “আনন্দ আড্ডা” অনুষ্ঠান । পার্কে আগত অন্যান্য ভ্রমণ পিয়াসুরাও ভিড় জমিয়েছেন  অনুষ্ঠানে । মামুন ভাই গেয়ে শোনালেন গান । জিৎ পরিবেশন করে কৌতুক । ফয়সাল তাক লাগিয়ে দিলো জাদু দেখিয়ে । তৌফিক আঙ্কেল ও মারুফ দুর্দান্ত একটি পারফর্মেন্স করলেন নানা-নাতি চরিত্রে । বিটিভি’তে প্রচারিত এক সময়কার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল এটি । তাদের অভিনয়ের গানটি ছিল এমন – হে নানা বসে থাকিস না আর ঘরেতে, নানা চল যাই থিয়েটার ওয়ার্কশপের অনুষ্ঠানে ... ।

 



এরপর শুরু হল প্রতিযোগিতা । প্রথমে খুঁজে নেওয়া হল ৩ জন ভাগ্যবান পুরুষ ও ৩ জন ভাগ্যবতী নারীকে । প্রতিযোগিতাটি হল, আমি ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনবো, এর মধ্যে পুরুষ ৩ জনকে শাড়ি পরিধান করতে হবে । যিনি দ্রুত এবং সুন্দর ভাবে শাড়ি পরিধান করতে পারবেন তিনি হবেন বিজয়ী । পরে একই ভাবে নারীরা পরিধান করবেন লুঙ্গি । আইডিয়াটি পেয়েছি আমার ভার্সিটির বান্ধবী ইসরাত ও জেনিফার কাছ থেকে । আমি গুনতে শুরু করলাম । মারুফ, ফয়সান আর ইকু শাড়ি পরছে । অবশেষে সবার আগে এবং সুন্দর ভাবে শাড়ি পরিধান করে বিজয়ী হলো ইকু । এবার লুঙ্গির পালা । প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন বৌদি (মিসেস তাপস), আফসানা ও ইমু । সবার আগে লুঙ্গি পরে তাক লাগিয়ে দিলেন বৌদি । বিজয়ী দু’জন কে থিয়েটার ওয়ার্কশপ চট্টগ্রামের লোগো সম্বলিত মগ উপহার দেওয়া হল ।

 

শুরু হল বহু প্রতীক্ষিত র‍্যাফেল ড্র পর্ব । সবার মধ্যেই টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে । কে পাচ্ছেন পুরষ্কার ? অতঃপর একে একে ৬ জন বিজয়ী পুরষ্কার পেলেন । সূর্য হেলে পরেছে পশ্চিম আকাশে । শেষ বারের মত উঁকি দিয়ে আমাদের বিদায় জানাচ্ছে । আমরা সবাই একে অপরের হাত ধরে দাঁড়ালাম । সমবেত কণ্ঠে গেয়ে নিলাম আমাদের দলীয় সঙ্গিত- "ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ..." । , দলীয় সঙ্গিতের মাধ্যমে নাটকের প্রতিটি মহড়া সমাপ্তকরণের মতই সারাদিনের কার্যক্রম সমাপ্ত হল ।

 

আবারও বাসের মধ্যে নেচে-গেয়ে সবাই ফিরে এলাম শিল্পকলা একাডেমির প্রিয় আঙিনায় । সবাই চায়ে চুমুক দিয়ে শরীরকে চাঙা করে নিলাম । আনন্দ ভ্রমণে প্রত্যেকের পূর্ণ আত্মতৃপ্তির অভিব্যক্তি শুনে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে মনে হল । শিল্পকলা একাডেমি থেকেই পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসি । নিজের উদ্যোগে প্রিয় সংগঠনকে নিয়ে বহুদিনের প্রত্যাশিত এমন একটি দিন সারা জীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে ।

 

লেখকঃ শফিক সোহাগ

কলামিস্ট-বোস্টন নিউজ, যুক্তরাষ্ট্র ।

কলামিস্ট- কর্ণফুলী ডট কম, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া ।

Email: shafiq_shohag@yahoo.com 

Likes Comments
০ Share