Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

শফিক সোহাগ

৭ বছর আগে লিখেছেন

মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রিয় স্বাধীনতা



আজ ১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার দিবস । ১৭ এপ্রিল-মুজিবনগর সরকার-মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা প্রত্যেকেই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । এদিনই আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের । যার নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আস্থাভাজন সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান । বাংলাদেশের জন্ম থেকে অদ্যবদি পর্যন্ত যতগুলো সরকার গঠন হয়েছে তন্মধ্যে এই মুজিবনগর সরকারই সবচেয়ে বেশি সফল ও সার্থক সরকার । মাত্র ৯ মাসে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করা, নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, দেশি-বিদেশী চক্রান্ত মোকাবেলা, মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন এসব কিছুই পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ।   

 

২৫ মার্চ ভয়াল কালো রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পরে নিরীহ বাঙ্গালীর উপর । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান গ্রেপ্তার হন । সমগ্র নিপীড়িত জাতি হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন । এই ক্লান্তিকালে জাতিকে রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জাতীয় চার নেতার একজন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ তাৎক্ষনিক দুটি সিদ্ধান্ত নিলেন । (১) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই; (২) এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসাবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের  জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া ।

 

৩০ মার্চ সন্ধ্যায় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে সাথে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে পৌঁছান । ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে তাঁরা ভারতে পদার্পণ করেন । মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক ই এলাহি (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা) সীমান্ত অতিক্রমে তাঁদের সহায়তা করেন । সীমান্ত অতিক্রম করার পর তাঁদেরকে তৎকালীন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার সম্মান প্রদর্শনপূর্বক নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন ।

 

৩ এপ্রিল রাত ১০ টায় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদ সাক্ষাৎ করেন । তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নিকট মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার জন্য ভারতে আশ্রয়, ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা এবং অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য আহ্বান জানান । এছাড়াও দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর শরণার্থী ভারতে ঠাই নেবে, তাদের আশ্রয় ও আহারের ব্যবস্থা করার জন্য আহ্বান জানান । ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন । ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাফল্যজনক সাক্ষাতের আলোকে ভারতসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে তাকে পরিচালনার জন্য অবিলম্বে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় । অবশেষে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অসহযোগ আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মী শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যারা ছায়া সরকারের কাজ করেছিলেন; তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে ।

 

১০ এপ্রিল কারাবন্দী শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় । এ ছাড়া ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, খোন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়।সেদিনই বাংলাদেশ সময় রাত ১০ টায় আকাশবানী কলকাতা রেডিও থেকে তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন । পরদিন আকাশবানীসহ বেশকিছু প্রচার মাধ্যমে তা সম্প্রচারিত হতে থাকে । তাঁর এই ভাষণে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতভয় সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনের কথা । পাক হানাদারদের রুখে দেয়ার জন্য সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন অংশে ইতিমধ্যে পাক বাহিনীকে পরাস্ত করার সংবাদ ফুটে উঠেছিল তাঁর এই ভাষণে । স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সেবায় আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা আহ্বান জানাচ্ছি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান, ইনজিনিয়ার, সংবাদপত্র সেবী, বেতার শিল্পী, গায়ক ও চারুশিল্পীদের, তারা যেন অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন । আমাদের সামনে বহুবিধ কাজ-তার জন্য বহু পারদর্শীর প্রয়োজন এবং আপনারা প্রত্যেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করবার সুযোগ পাবেন”।

 

১৭ এপ্রিল ১৯৭১, শনিবার । নবগঠিত মন্ত্রীসভার প্রকাশ্য শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হল কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদনাথতলায়। তাজউদ্দীন আহমদ এর নামকরণ করেন “মুজিব নগর” । ,স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী । অনুষ্ঠানে দেশি বিদেশী প্রায় শতাধিক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন । গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে কিছু চেয়ার, চৌকি ও বাঁশ আনা হলো । মেহেগনী গাছের নিচে নির্মাণ করা হলো ছোট্ট একটি মঞ্চ । ঐ দিনের পরিবেশ সম্পর্কেস্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের তাঁর “একাত্তর আমার” গ্রন্থে লিখেছেন, “আশেপাশের বাড়ি থেকে চৌকি এবং বাঁশ আনা হলো। উন্মুক্ত মঞ্চ এটি। উপরে শামিয়ানা লাগানো সম্ভব হলো না। নিভৃত গ্রাম এলাকা। লোকবসতি শহরের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে যে আয়োজন তাতেও মানুষ হলো প্রচুর। দেখতে দেখতে সভাস্থলে অন্তত হাজার পাঁচেক লোক জমায়েত হলো"।

 

কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয় । এরপর জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে নবগঠিত সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় । অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রীগণ ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী মঞ্চে এলেন । উপস্থিত সকলে সমকণ্ঠে পরিবেশন করলেন জাতীয় সংগীত । অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান, এম এন এ (সাবেক মন্ত্রী) । , এরপর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী (সাবেক মন্ত্রী) । , উপস্থিত সকলের চোখে আনন্দাশ্রু । বিশ্ববাসী দেখলো এক নতুন ইতিহাসের সূচনা । মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধি (যিনি ১৯৭১ সালে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে ভূমিকা রাখেন) মুহাম্মদ নূরুল কাদির তাঁর দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা গ্রন্থে বলেন, “২০০ বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আমবাগানে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল আবার সেই প্রাচীন জেলা নদীয়ার আর এক অংশে মেহেরপুরের আমবাগানে সগর্বে আত্মপ্রকাশ করলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ-এর স্বাধীনতার সূর্য”।

 

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংক্ষিপ্ত অথচ তেজোদ্দীপ্ত ভাষণ দিলেন । ভাষণে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সহানুভূতি, সাহায্য আর স্বীকৃতির আবেদন জানান । প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ দ্বার্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে । স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য । সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন । দুনিয়ার কোনো জাতি এই নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না । আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এই নতুন জাতিকে । স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে”।,ভাষণের শেষাংশে তিনি বলেন,“বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চাইতে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি। অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা” ।

 

শুরু হয়ে যায় তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে নতুন সরকারের কর্ম তৎপরতা । রাষ্ট্র গঠন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়সহ নানান কাজের দায়িত্ব পালন করতে থাকে এ সরকার । এদিকে সরকারের মন্ত্রীসভায় ঘাপটি মেরে থাকা নব্য মীর জাফর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পাকিস্তান ও আমেরিকার সাথে একাত্ম হয়ে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় । দেশি-বিদেশী চক্রান্ত মোকাবেলা, নতুন রাষ্ট্র গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা সব একই সময়ে বিচক্ষণতার সাথে করতে হয় মুজিবনগর সরকারকে । লক্ষ শুধু একটাই; চূড়ান্ত বিজয় । 

   

প্রকৃতপক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠনের মাধ্যমেই সুশৃঙ্খলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে । ফলে আমরা অর্জন করতে পেরেছি প্রিয় স্বাধীনতা । আজ মুজিবনগর সরকার দিবসে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও সার্থক সরকার মুজিবনগর সরকারের নায়কদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ।         

 

শফিক সোহাগ

সভাপতি- বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি রক্ষা পরিষদ

Email: shafiq_shohag@yahoo.com

  

[তথ্যসুত্রঃ মূলধারা’৭১-মঈদুল হাসান, দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা- মুহাম্মদ নূরুল কাদির, তাজউদ্দীন আহমদঃ নেতা ও পিতা-শারমিন আহমদ, ওয়েবসাইড-তাজউদ্দীন আহমদ ডট কম, একাত্তর আমার-নুরুল কাদের, প্রামাণ্যচিত্র- তাজউদ্দীন আহমদঃ নিঃসঙ্গ সারথি]

Likes Comments
০ Share

Comments (0)

  • - সেলিনা ইসলাম

    চমৎকার লাগল একুশকে নিয়ে লেখা কবিতা। শুভকামনা রইল।  

    • - এস আহমেদ লিটন

      অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু। আপনাকে পেয়ে ভাল লাগল। ভাল থাকবেন সবসময়।