Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Travel Image

ভ্রমণের যত কথা



সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন,

“তিনটে চারটে ছদ্মনামে
আমার ভ্রমণ মর্ত্যধামে”

ভ্রমণপ্রিয় মানুষ বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন নামে ভ্রমণে যেতে চান। ভ্রমণ পিপাসু মানুষের এরকম আকাঙ্ক্ষাই কাম্য। সত্যি কথা বলতে কি এই আধুনিক সময়ে ভ্রমণ ভালোবাসেন না কিংবা করতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। রসকসহীন মানুষও ভ্রমণের গন্ধ পেলে কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসেন। এমনকি অনেকে ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে পঞ্চাশ ষাট জন মিলে চলে যায় আনন্দ ভ্রমণে। কিন্তু বর্তমান ব্যস্ত সময়ে মানুষ ভ্রমণের সুখ খুব কমই পায়। তারা অনেক সময়েই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান। বিভিন্ন ভ্রমণ কাহিনী পড়ে সময় কাটান। এদিক দিয়ে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট হচ্ছে সৈয়দ মুজতবা আলীর “দেশে বিদেশে” কিংবা অন্নদাশঙ্কর রায়ের “পথে প্রবাসে”। এরপরেই বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণ একটি বিশেষ স্থান করে ফেলে। ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা ভ্রমণ করেন এবং তা লিপিবদ্ধ করে রাখতে চান যা কিনা ভ্রমণের জনপ্রিয়তারই নির্দেশক। এক্ষেত্রে পেশাদার অপেশাদার উভয় ভ্রমণকারীরাই ভ্রমণ করে এসে কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। অন্নদাশঙ্কর রায় এ নিয়ে একটি সুন্দর উক্তি করে গেছেন। তিনি বলেন, “ভ্রমণ থেকেই হয় ভ্রমণ কাহিনী। কিন্তু ভ্রমণকারীদের সকলের হাত দিয়ে নয়”। তবু প্রতি বছর বাংলাদেশে অন্তত শ’খানেক ভ্রমণ বই প্রকাশিত হয়। দৈনিক পত্রিকাগুলো এ নিয়ে আলাদা পাতা বের করেন। এমন কি ভ্রমণকে ভিত্তি করেই বের হয় বিভিন্ন পত্রিকা। এ সব কিছু ভ্রমণের জনপ্রিয়তারই নির্দেশক। অন্যদিকে যারা পেশাদার লেখক তাদের ভ্রমণ কাহিনীগুলো হয়ে যায় ভ্রমণ বিষয়ক কালজয়ী বই।

ছোট্ট এই বাংলাদেশে ভ্রমণের জায়গা খুব কম নয়। সুন্দরবন, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা, জাফলং ইত্যাদি খুব পরিচিত জায়গা ছাড়াও এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক ভ্রমণ জায়গা। আর এসব জায়গার দৃশ্যও অনেক মনোরম। যেমন কক্সবাজারের প্রতিটি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত নতুন এবং সুন্দর। এজন্য কবি জীবনানন্দ দাশ বার বার এই বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছেন এবং ধবল বকদের ভীড়ে তাঁকে খুজতেও বলেছেন।

পেশাদার অপেশাদার সকল ভ্রমণকারীরাই এই ভ্রমণকে এক ধরনের বিনোদন হিসেবেই বিবেচনা করেন। পেশাদারদের কাছে আবার এটি নেশাও বটে। তারা অবসর, চাকুরী বা ব্যবসাজনিত কারণে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে থাকেন যাদেরকে পর্যটকও বলা যেতে পারে। এই ঘুরে বেড়ানো জিনিসটাও আজ শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্ব পর্যটন সংস্থা বা World Tourism Organization পর্যটনের নিম্নমুখী এবং ঊর্ধ্বমুখীতা যাচাই করে মানদন্ড প্রণয়ন করে থাকে। এটি স্পেনের মাদ্রিদে অবস্থিত জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে বিবেচিত। তারা কোন ব্যক্তিকে পর্যটক রূপে আখ্যায়িত করতে গিয়ে বলেছেন,

“যিনি ধারাবাহিকভাবে এক বছরের কম সময়ের মধ্যে কোন স্থানে ভ্রমণ ও অবস্থানপূর্বক স্বাভাবিক পরিবেশের বাইরে দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে অবসর, বিনোদন বা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ অন্যান্য বিষয়াদির সাথে জড়িত, তিনি পর্যটকের মর্যাদা উপভোগ করবেন।”

১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ডের পর্যটন সমিতির মতে,

“পর্যটন এক ধরনের অস্থায়ী, ব্যক্তির নির্দিষ্ট স্থানে স্বল্পকালীন চলাচলবিশেষ যা নিজস্ব আবাসস্থল, কর্মক্ষেত্রের বাইরের কর্মকাণ্ড। এছাড়াও, এতে সকল ধরণের উদ্দেশ্যমালা অন্তর্ভূক্ত থাকে।”

বাংলাদেশেও এই পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পর্যটন খাত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। আগস্ট ১৯৭৫ সালে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় হিসেবে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় খোলা হয়। ২৪ মার্চ, ১৯৮২ সালে এ মন্ত্রণালয়কে বিলুপ্ত করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। এরপর ১৯৮৬ সাল থেকে উক্ত মন্ত্রণালয়কে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে অদ্যবধি বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন নামে তার কার্যক্রম চালাচ্ছে। এটি বাংলাদেশের জাতীয় পর্যটন সংস্থা হিসেবে পরিচিত যা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

এই পর্যটন কয় স্তরের হতে পারে এবার সেই আলোচনায় আশা যাক। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক পর্যটন পরিসংখ্যানের সুপারিশমালায় তিন স্তরবিশিষ্ট পর্যটন রূপরেখা তুলে ধরা হয়।

-অভ্যন্তরীণ পর্যটন কোন নির্দিষ্ট দেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ।
-সীমাবদ্ধ পর্যটন কোন নির্দিষ্ট দেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত অস্থায়ী জনগোষ্ঠী বা বিদেশীদের জন্য বরাদ্দ।
-বহিঃস্থ পর্যটন অন্য দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট কোন নির্দিষ্ট দেশের স্থায়ী অধিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য।

বিদেশী পর্যটকরা বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান। তাই বিদেশী পর্যটকের ধারণাটা কিছুটা অন্যরকম। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ থেকে বলা হয় যে,

"সর্বোচ্চ ছয় মাস অবস্থানকালীন সময়কালে একজন ব্যক্তি পর্যটকের মর্যাদা উপভোগ করতে পারবেন।"

তারা এই বিষয়ক একটি দিনও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাদের অধীনস্ত বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সাল থেকে সকল সদস্য দেশে ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে বিশ্ব পর্যটক দিবস (World Tourism Day) হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

বিশ্বের অনেক দেশে পর্যটক খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তন্মধ্যে- ফ্রান্স, মিশর, গ্রীস, লেবানন, ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি, থাইল্যান্ড অন্যতম। এছাড়াও দ্বীপ রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাত মৌরীতাস, বাহামা, ফিজি, মালদ্বীপ, ফিলিপাইন, সিসিলিতেও পর্যটন শিল্প ব্যাপক বিকাশ লাভ করেছে। আর এসবের সাথে সাথে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা বাণিজ্য। এই ব্যবসা বাণিজ্যকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়।

-পরিবহন ব্যবস্থা বিষয়ক।
-থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা বিষয়ক।
-বিনোদন ব্যবস্থা বিষয়ক।

পর্যটকদের জন্য ট্যুরিস্ট গাইড নিয়োগ দেওয়াটাও এখন একটি বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। দিন যত যাচ্ছে এই খাত তত সমৃদ্ধশালী হচ্ছে।



উন্নত বিশ্বে এই ভ্রমণ ব্যাপারটি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। ছুটির সময়গুলোতে তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে জীবনকে সার্থক করে গড়ে তোলে। তাদের প্রয়োজনের চাহিদা মেটানোর জন্যে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অবকাশ কেন্দ্র। এগুলো বিভিন্ন ধরনের হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও কটেজ দ্বারা সমৃদ্ধ। তবে বাংলাদেশের ভ্রমণ পিপাসুদের আছে অর্থনৈতিক বাধা। স্বচ্ছল পরিবারগুলো সাপ্তাহিক ছুটিতে ঘুরে বেড়ানো একটি ট্রেডিশনে পরিণত হয়েছে। ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার মুখী মানুষ এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া ইত্যাদি স্থান প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের কারণে ভ্রমণের জন্য আকর্ষণীয়। আবার দেশের বাইরেও অনেক মানুষ প্রতিবছর অবকাশ যাপনের জন্য পরিবারসহ বিদেশ ভ্রমণ করছেন। দুই ঈদের সময় বা অন্যান্য ছুটিতে বিদেশ গমনেচ্ছুদের তালিকায় যেসব দেশ অগ্রাধিকার পায় সেগুলো হল নেপাল, ভুটান, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, তুরস্ক, মিসর, কেনিয়া, য্ক্তুরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ইত্যাদি।

বাংলাদেশে এই পর্যটনের সাথে জড়িত রয়েছে বিপুল সংখ্যক লোক। সর্বোপরি এর মাধ্যমে এক বিশাল জনসমষ্টির কর্মসংস্থান হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।