Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Travel Image

এশিয়ার বৃহত্তম বটগাছ



ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নের অমতর্গত বেথুলী গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোণে বটগাছটি অবসিহত। কালীগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ১০ কিঃ মিঃ পূর্বদিকে কালীগঞ্জ-আড়পাড়া-খাজুরা সড়কের ত্রিমোহনী সংলগ্ন স্থানে এ প্রাচীন বটগাছের অবস্থান। অনেক প্রজাতির ছোট-বড় গাছ আছে বাংলাদেশে। যে সব গাছ বিশালকায় ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে তন্মধ্যে বটগাছ বিশেষ উল্লেখযোগ্য
বটগাছ Moraceae গোত্রের চির সবুজ সুবৃহৎ বৃক্ষ, Ficus bengalensis ছড়ানো শাখা থেকে ঝুরি মাটিতে নেমে আসে ও ক্রমে কান্ডের আকারে সতম্ভমূলে রুপান্তরিত হয়। বয়স্ক বটগাছ বিশালাকৃতির আচ্ছাদন তৈরী করে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশের সর্বত্র বটগাছ জন্মে। ফল ছোট, গোলাকার, পাঁকলে লাল হয়। বটগাছকে পবিত্র বলে গণ্য করে হিন্দুরা।

বটগাছ মানুষের তৈরী কোন পুরাকীর্তি নয়। ইহা একটি বৃক্ষ, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রকৃতির অবদানে এই বটগাছ জন্মে। সেজন্য ইহাকে প্রাকৃতিক পুরার্কীর্তি বলা যায়। ঝিনাইদহের অধিকাংশ লোক এ বটগাছের নাম জানেন। একারণে ইহাকে পুরাকীর্তি শ্রেণীভুক্ত করে বৃক্ষটির বৃত্তান্ত এখানে তুলে ধরা হলো। বটগাছের কাঠ বেশী একটা গুরতত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু এ বৃক্ষের আকার হয় বিশালকায়। কাঠ ধূসর, মাঝারি রকমের শক্ত। সতম্ভমূলের কাঠ গুঁড়ির কাঠের তুলনায় বেশি মজবুত এবং তাবুর খুঁটি, পালকির ডান্ডা ও সসতা আসবাবপত্রে ব্যবহার্য। বিরাটকায় বটবৃক্ষ পথিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অতি সহজে। বৃহত্তম এই বটগাছ ঝিনাইদহের একটি গৌরব। এ গাছ এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গাছ বলে সনাক্ত করা হয়েছে।

এ বটগাছের অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি ও কিংবদন্তি। কারো কাছে সুইতলার বটগাছ, কারো কাছে সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ। আবার কারো কাছে বেথুলী বটগাছ বলে পরিচিতি। প্রকৃত পক্ষে এর অবস্থান হলো বেথুলী মৌজায়। বেথুলী মৌজায় এর অবস্থান হলেও সে সময় এলাকায় তেমন জনপদ গড়ে উঠেছিল না। পথশ্রান্ত লোকজন বটগাছের নীচে বসে বিশ্রাম করতো, সময় কাটাতো। এজন্যই মল্লিকপুর গ্রামের কতিপয় ব্যক্তি বটতলার পার্শ্বে দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। মল্লিকপুরের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কেন্দ্র নামেই মল্লিকপুরের বটগাছ পরিচিত লাভ করে।

প্রায় ২৫০ বছর আগে এই গাছের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য জানা যায় না। এলাকার বয়োবৃদ্ধদের নিকট হতে জানা যায়, একটি কুয়ার পাশে ছিল এ গাছের মূল অংশ। তখন জনবসতি ছিল খুবই কম। রাস্তার ধারের এ গাছটি ডাল পালা ও পাতায়পূর্ণ। গাছের নীচে রোদ বৃষ্টি পড়তো না। মাঘের শীতের রাতেও গাছ তলায় গরম লাগতো। গ্রীষ্মকালে গাছের তলা ঠান্ডা থাকতো। পথিকরা গাছতলায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিতো। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায় বাস্তবে এ এলাকায় সুইতলা নামক কোন স্থানের অস্থিত্ব নেই। বয়োবৃদ্ধদের ধারণা পথশ্রান্ত পথিকরা এই মনোরম স্থানে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতো, তখন থেকেই অনেকের কাছে সুইতলা বটগাছ বলে পরিচিতি লাভ করে। সেখান থেকেই নামকরণ হয় সুইতলা বটগাছ।

তবে বটগাছটির জন্ম যে কুয়ার পড়ে সেই কুয়া কোথায় এবং কে খনন করেন তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কারো মতে, যে স্থানে কুয়া ছিল ঐ জায়গাটি ১৯২৬ সালে রেকর্ডের পূর্বে নাকি বেথুলী গ্রামের ভূষণ সাহাদের পরিবারের কারো নামে রেকর্ড ছিল। বর্তমানে পুরোটাই সরকারের খাস জমির অন্তরভুক্ত।

কুয়ার পাড়ের সেই বটগাছটি কালত্রুমে ঝুরি নেমে নেমে পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহ দখল করে নিয়েছে। মূল গাছটি কালত্রুমে অনেকগুলো ছোট গাছে বিভক্ত হয়ে গেছে। মোট ৪৫টি উপবৃক্ষ ও ১২ দাগে প্রায় ১১ একর (২.৩৩ হেক্টর) জমি দখল করে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ বটগাছটি। দক্ষিণ-পূর্ব পাশের গাছ গুলো জমাটবদ্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে কিছুটা ফাঁকা ছাউনি দিয়ে বেষ্টিত। গাছটির ৩৪৫টি ঝুরি মাটির সাথে সংযুক্ত এবং ৪০টি ঝুরি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। মূলগাছ এখন আর নেই। মাঝখানে কিছু অংশ ফাঁকা এবং চারপাশে শাখা-প্রশাখায় বেষ্টিত। বটগাছটির বয়স আনুমানিক ২০০ থেকে ২৫০ বছর।


এ বটগাছকে কেন্দ্র করে পার্শ্বেই বাংলা ১৩৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বেথুলি বা মল্লিকপুরের বাজার। ত্রুমে ত্রুমে বাজারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বর্তমানে অনেকগুলো সহায়ী দোকান আছে এ বাজারে। প্রতি শনিবারে ও বুধবারে সাপ্তাহিক হাট বসে। দূরদূরামত হতে লোকজন এসে সওদা করে। বৃদ্ধদের মতে, দিনের বেলায়ও গভীর ছায়া হয়ে থাকতো বটতলা। এখানকার অধিকাংশ সম্পত্তিই ছিল রায়গ্রামের জোতদার নগেন সেনের সস্ত্রী শৌলবালা সেন -এর নামে। পরবর্তীতে খাস হয়ে যায়। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে অনেক লোক রোগব্যাধি মুক্তির আশায় এ গাছের নামে মান্নত করে। এ বিশাল বটবৃক্ষে সব সময় পাখি বসে, কিচির মিচির শব্দ লেগেই থাকে। অথচ গাছে কোন পাখি বাসা বাঁধে না। কোন দিন কেউ শকুন বসতে দেখেনি। গাছের নীচে পশুপাখি বা প্রাণীর মল-মূত্র দেখা যায় না। বটতলায় কালীপূজার একটি সহায়ী পাঁকা বেদী নির্মিত হয়েছে। চাপরাইল গ্রামের গৌরপদ অধিকারী ও হাজারী লাল অধিকারীর আর্থিক সহায়তায় এ বেদী নির্মিত হয়। এ বেদিতে সাড়ম্বরে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বে এ গাছতলায় ১৫ দিন ব্যাপী রাসপূজা অনুষ্ঠিত হতো এবং এ উপলক্ষে মেলা বসতো।

১৯৮২ সালের পূর্ব পর্যমত এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম বটগাছ বলে পরিচিত ছিল কলকালাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছটি। এ গাছটির আচ্ছাদন ২.২২ একর জমি জুড়ে। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালের বিবিসির এক তথ্য অনুসন্ধানে প্রতিবেদনে প্রচারিত হয় যে, কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলী মৌজায় অবস্থিত সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের (শিবপুর) গাছ অপেক্ষা বড় এবং ইহা এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ। বাংলাপিডিয়া'- গ্রমেহ সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছটিকে বিশ্ববট' (The Great Banyan) বলা হয়েছে। ২.৩৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে এ গাছের বিসতৃতি।

অযত্ন, অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং নানামুখি অত্যাচারের কারণে এ ঐতিহ্যবাহী বটগাছের অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলিন হতে চলেছে। মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত হোসেন মিয়া জীবিত থাকাকালীন এ গাছ দেখাশুনা করতেন স্বেচ্ছায়। যে কারণে তিনি এ বটবৃক্ষের কাছে সর্ব প্রথম দোকান দেন এবং বাজার প্রতিষ্ঠিত করেন।

মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছের ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে অনেক স্থান থেকে প্রতিনিয়ত দর্শনার্থী এখানে আসেন। এ গুরত্ব বিবেচনা করে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ বটবৃক্ষের পাশে ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি রেষ্ট হাউস নির্মাণ করেন ১৯৯০ সালে। এ জন্য বটগাছের পার্শ্বে অবস্থিত ১৬৯ মৌজার ১৬ নং দাগের .৩২ শতক জমি মল্লিকপুর গ্রামের জহর আলী বিশ্বাসের সস্ত্রীক মোছাঃ কুণ্টি বিবি ১৯৯০ সালের ২৫ শে এপ্রিল ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের নামে দানপত্র লিখে দেন। বটবৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য ইহার চারদিকে দেয়াল দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এবং মানুষের জীবনে একটা দিক আছে শান্ত এবং স্নেহশীল, এ বটগাছ যেন তারই মূর্ত প্রতীক। দুপুরের তপ্ত রোদে পথিকদের আশ্রয় দেয়, ছায়া দেয় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত পথচারীদের। প্রখর খরতাপ ও প্রবল ঝড়-বৃষ্টির সময় পাখিদের আশ্রয় দেয় এ গাছ। সবার উপকার করার জন্যই যেন দাঁড়িয়ে আছে এ প্রাচীন বটগাছ।

বিশ্বব্যাপী গাছটির পরিচিতি ঘটে ১৯৮২ সালে বি,বি,সি এর সংবাদ ভাষ্যের মাধ্যমে গাছটি এ এলাকার আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। বহু দেশী-বিদেশী পর্যটক এখানে আসে। তবে বটগাছটির প্রতি নেই কোন সচেতন পরিচর্যা। অযত্ন, অবহেলা ও অত্যাচারে বিলীন হতে চলেছে গাছটি। প্রতিনিয়ত কাটা হচ্ছে এর ডালপালা।

বট গাছটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করেও পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে ১৯৯০ সালে সরকারি অনুদানে নির্মিত হয়েছে একটি রেষ্ট হাউজ। এই ঐতিহ্যকে গুরুত্বসহকারে কাজে লাগালে এ অঞ্চল হতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। এই বিস্তৃত বটগাছের দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখীর কল-কাকলি মুখরিত শীতল পরিবেশ বিমুগ্ধ চিত্তকে বিস্ময় ও আনন্দে অভিভূত করে।
ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারলে সুইতলা মল্লিকপুরের এ বটগাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র।