Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.
Sports Image

প্রোটিয়াস ট্র্যাজেডির শেষ কোথায়



তারা প্রতিটি বড় বড় টুর্নামেন্টে হট ফেভারিট হয়ে আসে। বিশ্বের মস্তবড় ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং লাইনআপ নিয়ে তারা মাঠে নামে। কিন্তু নামের পাশে যে চোকার খেতাব রয়েছে সেটা তো আর মুছতে পারেনা! অনেক চেষ্টা করেছে তারা বিনিময়ে কতটুকু সাফল্য হয়েছে সেটা সবারই জানা। বাংলাতে একটি কথা আছে “ছেলে খেলে খেলে ভালো কিন্তু বল পায়না”। একদমই! তাদের সামর্থ্য অপ্রতুল কিন্তু বাস্তবতার কাছে তারা বারবারই পরাস্থ। হিমশিম খেতে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকা।

ওইযে কথায় বলেনা “সারা পথে দৌড়াদৌড়ি কিন্তু খেয়াঘাটে গোড়াগুড়ি”। সাধারণ দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিদেশীয় সিরিজে প্রোটিয়াদের সাফল্য আকাশচুম্বী কিন্তু এই বিশ্বকাপের মত আসরে তারা প্রথম থেকে দারুণ সূচনা করলেও শেষ রক্ষা হয়না। ‘খেয়াঘাট ‘ এ এসে থেমে যেতে হয় তাদের। নৌকা আর পার হওয়া সম্ভব হয়না তাদের ক্ষেত্রে। বাস্তবে একটি কথা আছেনা যে ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’! একটু ইতিহাস ঘুরে আসা যাক। ১৮৮৯ সালে টেস্ট স্টাটাস পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই বছরই পোর্ট এলিজাবেথে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে প্রোটিয়াদের। এরপর থেকে জীবনের পথচলা শুরু। থামতে নারাজ ছিলো তারা। কিন্তু হঠাৎ এক মানবসৃষ্ঠ ঘুর্নিঝড়ের কবলে পড়ে ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৬১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা নামক দেশটি কমনওয়েলথ ত্যাগ করে। আর এর ফলেই কপাল পুড়লো তাদের।

কারণ কমনওয়েলথের অধীনে থাকা দলগুলোই তৎকালীন সময়ে ক্রিকেট খেলতে পারতো। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা কমনওয়েলথ ত্যাগ করার পরে তৎকালীন আইসিসি (ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স) এর এক সভায় দক্ষিণ আফ্রিকার সদস্যপদ বাতিল ঘোষণা করা হয়। ছিটকে পড়লো তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট থেকে। তবে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাদের। ১৯৬৪ সালে আইসিসির নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়। সহযোগী দলগুলোকে আবার সদস্যপদ দান করা হয়। বাংলাতে একটি কথা আছে বিপদ যখন আসে তখন সবদিক দিকেই আসে। সেটাই হলো আবার দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের বিপক্ষে। ১৯৭০ সাল। পুরো আফ্রিকা জুড়ে বর্নবাদের আন্দোলন।

১৯৪৮ সাল থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও ১৯৭০ সালের দিকে এটি চরম পর্যায়ে আঘাত হানে। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার ঘোষণা দেয় যে ‘আজ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল কোনো কৃষ্ণাঙ্গ দলে বিপক্ষে খেলতে পারবেনা’। দলটি শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ দলের বিপক্ষে ক্রিকেট খেলতে পারবে। তখনকার সময়ে শুধুমাত্র ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড দলই শ্বেতাঙ্গ দল হিসেবে ছিলো। তাই এদের বিপক্ষেই দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার থেকে ক্রিকেট খেলার অনুমতি দেয়। কিন্তু আইসিসি এটার বিরোধিতা করে।

তারপর সেই বছরেই (১৯৭০ সাল) আইসিসি দক্ষিণ আফ্রিকা সদস্যপদ কেড়ে নেয় এবং দলটিকে নির্বাসন দেয়। ফলে, গ্রেইম পোলক , ব্যারী রিচার্ডস , মাইক প্রোক্টরের মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা থেকে বঞ্চিত হন। এছাড়াও, অ্যালান ল্যাম্ব , রবিন স্মিথের ন্যায় উদীয়মান ক্রিকেটাররাও অভিবাসিত হয়ে ইংল্যান্ড এবং কেপলার ওয়েসেলস‌ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলেন। পরবর্তীতে অবশ্য কেপলার ওয়েসেলস পুণরায় দক্ষিণ আফ্রিকা দলের পক্ষ হয়ে খেলেছেন। ইতিমধ্যে ৪টি বিশ্বকাপ খেলা হয়ে গেছে অন্যান্য দলগুলোর।

ক্রিকেটে,ফেরার অপেক্ষায় দক্ষিণ আফ্রিকাও। ২১ বছর নির্বাসনের পরে ১৯৯১ সালে ভারতের বিপক্ষে ১০ নভেম্বরে ওডিআইতে অভিষেক হলো দক্ষিণ আফ্রিকার। ’৯২ সালে পঞ্চম আসরে সুযোগ পায় দলটি। তাদের অন্তর্ভুক্তির ফলে নয় দল নিয়েই সেবার ভিন্ন ফরমেটে আয়োজন করা হয় বিশ্ব আসর। অস্ট্রেলিয়া- নিউজিল্যান্ডে ’৯২ বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে নয় উইকেটে হারিয়ে উড়ন্ত সূচনা করে ম্যান্ডেলার দেশ। জানিয়ে দেয় ২১ বছর নির্বাসনে থাকার পরও তাদের ক্রিকেট চর্চায় ছেদ পড়েনি। ক্রিকেট বিশ্ব পেয়ে যায় আরেক শক্তিশালী দলকে যারা যোগ্যতা রাখে শিরোপা জয়ের। শুধু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই নয় গ্রুপ পর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৬৪ রানে, পাকিস্তানকে ৩৭ রানে, ভারতকে ছয় উইকেটে এবং জিম্বাবুয়েকে সাত উইকেটে হারিয়ে সবার আগে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায়।

তাদের সাফল্যে চমকে যায় পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। তবে ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’ প্রবাদটি আবারো চলে আসে সামনে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে বলতে গেলে ভাগ্যের কাছে হার মানতে হয় আফ্রিকানদের। বৃষ্টির জন্য খেলা কমিয়ে ৪৫ ওভারে নামিয়ে আনা হয়। ইংল্যান্ডের করা ২৫৩ রান চেজ করতে গেলে বৃষ্টির কারণে একাধিকবার খেলা বন্ধ হওয়ায় বদলে যায় ম্যাচের গতিচিত্র। বারবার খেলা বন্ধ হওয়ায় ওভারও কমতে থাকে, বাড়তে থাকে রানের গতি। শেষ পর্যন্ত জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১ বলে ২২ রান টার্গেট দেয়া হয়। যা পরিণত হয় বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তামাশায়। ২০ রানে হেরে বিদায় নেয় দক্ষিণ অফ্রিকা।

১৯৯৬ সালে পাক-ভারতে আয়োজিত পরের বিশ্বকাপেও আফ্রিকানদের শিরোপা জয়ের দৌড় থেমে যায় সেমিফাইনালে এসে। এবারো ভাগ্যের পাশাপাশি হিসাবের ভুল ও অনভিজ্ঞতাই দায়ী। এবারো গ্রুপ পর্বের পাঁচ ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ৭৮ রানে, পাকিস্তানকে পাঁচ উইকেটে, নেদারল্যান্ডসকে ১৬০ রানে, নিউজিল্যান্ডকে পাঁচ উইকেটে এবং আরব আমিরাতকে ১৬৯ রানে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেও ব্রায়ান লারা অতি মানবীয় এক ইনিংসের ফলে ক্যারিবীয়দের কাছে ১৯ রানে হেরে শেষ হয় তাদের বিশ্বকাপ মিশন। তিন বছর পর ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপের সপ্তম আসরেও দুরন্ত সূচনা করে প্রোটিয়রা। গ্রুপ পর্বে দাপটের সাথে হারায় স্বাগতিক ইংল্যান্ড, ভারত, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়াকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সুপার সিক্সে ওঠে।

এ পর্বেও পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ওঠে শেষ চারে। এবারো সেমিতে উঠেও পড়তে হয় ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে। প্রথম সেফিাইনালে অস্ট্রেলিয়ার করা ২১৩ রানের জবাব দিতে গিয়ে তিন বল হাতে রেখেই স্কোর লাইন সমতায় আনে দক্ষিণ অফ্রিকা, হাতে শেষ উইকেট। শেষ তিন বলে আর কোনো রান না নিলেও কম উইকেট হারানোর সুবাদে তারাই ফাইনালে খেলতো। এ হিসাবে না গিয়ে অ্যালেন ডোনাল্ড ও ল্যান্স ক্লুজনার তাড়াহুড়া করে রান নিতে গিয়ে রান আউট হওয়ায় আবারো শেষ হয় বিশ্বসেরা হওয়ার স্বপ্ন। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে নেমে আসে একটি কালো অন্ধকার। স্পট ফিক্সিং নামের একটি অদৃশ্য আত্মার কবলে ভারতের অজয় জাদেজা, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন এর সাথে জড়িয়ে পড়েন হ্যানসি ক্রুনিয়ে ও। ক্রিকেট থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয় তাদের।

কিন্তু দু’বছর ঘুরতেই বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে ক্রোনিয়ে ক্রীড়া বিশ্বকে দেন থমকে। ক্যারিয়ারে সজ্জন-ভদ্রলোক অধিনায়ক হিসেবে ক্রিকেট ভক্তদের কাছে আলাদা পরিচয় ছিল ক্রনিয়ের। এরপর অ্যালান ডোনাল্ডের অবসর, হ্যান্সি ক্রোনিয়ের পাতানো খেলার পর বিমান দূর্ঘটনায় অকালমৃত্যু এবং শন পোলকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের প্রেক্ষাপটে দলটি আরো একবার পরিবর্তনের ধাক্কায় পড়ে। ২০০৩ সালে পরের আসরে দেশের মাটিতে অল্পের জন্য ওঠা হয়নি সুপার সিক্সে। বৃষ্টির কারনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি পরিত্যক্ত না হলে তারা হয়তো পৌঁছে যেতো সুপার সিক্সে। ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গ্রুপ পর্বে দুই জয়ে সুপার এইটে উঠেও বাংলাদেশের কাছে অপ্রত্যাশিত হারে সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ হয় সে সময়ের অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া। ফলাফল ফাইনালে ওঠার আগেই বিদায়।

সর্বশেষ ২০১১ সালে গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের কাছে হারলেও, বাকি পাঁচ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, বাংলাদেশ, নেদারল্যান্ডস ও আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালেও উঠেও, ২২১ রান চেজ করতে গিয়ে ৪৯ রানে হারতে হয় নিউজিল্যান্ডের কাছে। এভাবেই শেষ হয় বিশ্বকাপের দশম আসরে দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্য বিড়ম্বনার কাহিনী। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার পর ১৯৯৮ সালে হ্যানসি ক্রনিয়ের নেতেৃত্বে ঢাকায় প্রথম নক আউট (বর্তমানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) বিশ্বকাপের ট্রফি জয় ছাড়া আর কোনো সাফল্য নেই সব আসরে অন্যতম ফেবারিটের তমকা আকা দলটির। বিশ্বকাপের এক একটি আসর শেষ হওয়ার পর তাদের ক্রিকেট ইতিহাসে আরেকটি হতাশার কাব্য লেখা হয়। এবিডি ভিলিয়ার্সের নেতৃত্বে এবারের দলটিও সব মিলিয়ে ছিলো ব্যালেন্সড। ‘চিরকালের দুর্ভাগা’ দলটির জন্য এবারের বিশ্বকাপেও লেখা হলো আরেকটি ব্যর্থতার দলিল! পারলোনা অভিশপ্ত ইতিহাস পেছনে ফেলে শেষ হাসি হাসার। বড় আজব এই ক্রিকেট!


২০১৫ইং এর প্রোটিয়াস ট্র্যাজেডি