সারা পৃথিবীতে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল পদ্ধতি হলো জন্মবিরতিকরণ পিল। এই পিলগুলো মূলত ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন নামক দুইটি হরমোনের বিভিন্ন অনুপাতের সংমিশ্রন। এইসব সমন্বিত পিলের জন্মনিয়ন্ত্রণের সাফল্যও খুব বেশি, শতকরা প্রায় ৯৮ শতাংশের কাছাকাছি। জন্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়াও মেয়েদের বিভিন্ন রোগে (যেমনঃ স্তনের বিভিন্ন নন-ক্যান্সারাস টিউমার, অনিয়মিত মাসিক, ডিম্বাশয়ের টিউমার বা সিস্ট, অস্বাভাবিক গর্ভধারণ ইত্যাদি) ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এসব পিল। কিন্তু তারপরও প্রতিটি ঔষধের যেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, আর শরীরের অনেক অবস্থাতেই খাওয়া যায় না অনেক ঔষধ- জন্মনিয়ন্ত্রক পিলও তার ব্যতিক্রম নয়! তাই নব-দম্পতি বা যে কেউই যদি পরিবার পরিকল্পনার জন্য ডাক্তারের কাছে যান, তবে অবশ্যই নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের কথা ডাক্তারকে জানাতে ভুলবেন না।
যেসব অবস্থায় জন্মবিরতিকরণ পিল খাওয়া একেবারেই নিষিদ্ধঃ
ক্যান্সার-
বিশেষত স্তন কিংবা যৌনাঙ্গের ক্যান্সার হলে। গর্ভাশয় বা জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। কারণ ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন সমন্বিত পিল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
যকৃতের কোন অসুখ-
আপনার লিভারে কোন অসুখ থাকলে বা পূর্বে হেপাটাইটিস বি বা সি হওয়ার কোন ইতিহাস থাকলে তা অবশ্যই ডাক্তারকে জানান। আপনার লিভারে পূর্বে কোন অপারেশন হয়ে থাকলে তাও জানিয়ে নিন ডাক্তারকে।
হৃদরোগ-
বিভিন্ন হৃদরোগে জন্মবিরতিকরণ পিল নিষিদ্ধ বলে চিকিৎসকেরা মনে করেন। এর মাঝে রয়েছে থ্রম্বোএমবলিজম (রক্তনালিকায় কোন কিছু জমে নালী বন্ধ হয়ে যায়)। বিভিন্ন থ্রম্বোএমবলিক ডিজঅর্ডারের মাঝে রয়েছে স্ট্রোক, হার্টে বা আর্টারিতে কোন ব্লক থাকা ইত্যাদি। তাই হৃদরোগের কোন চিকিৎসা নিয়ে থাকলেই সেটা পরামর্শ নেবার সময় ডাক্তারকে জানিয়ে রাখুন।
রক্তে লিপিডের মাত্রা-
ইস্ট্রোজেন সব সময়ই রক্তে লিপিডের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। তাই যাদের অনেক আগে থেকেই রক্তে লিপিডের পরিমান বেশি, জন্মবিরতিকরণ পিল খাওয়ার আগে তাদের জন্য বাড়তি সচেতনতা জরুরি। বিশেষত যাদের শরীরে জন্মগতভাবেই লিপিডের মাত্রা উচ্চ- তাদের জন্য এইসব পিল একেবারেই নিষিদ্ধ।
অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ-
যদি আপনার যোনিপথে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ/ রক্তস্রাব হয় এবং তার কারণ না জানা যায়, তবে এর চিকিৎসা হওয়ার আগ পর্যন্ত জন্মবিরতিকরণ পিল খাওয়া অনুচিত।
যেসব সমস্যার সময় পিল খেলেও ডাক্তারের বিশেষ নজরদারি জরুরি-
চল্লিশোর্ধ নারী-
জন্মবিরতিকরণ পিল মূলত তরুণীদের জন্য উপযোগী। তাই চল্লিশোর্ধ কেউ যদি জন্মনিয়ন্ত্রণের এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে চান, তবে অবশ্যই তার উচিৎ ডাক্তারের সাথে নিয়মত যোগাযোগ রাখা। কারণ এ বয়সের পরে নারীদের শরীরে হরমোনের নানা ধরণের পরিবর্তন আসে এবং শরীরও দুর্বল হতে থাকে। মেনোপজের সময় এগিয়ে আসার সাথে সাথে হাড়ক্ষয় ও হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ে এ বয়স থেকেই।
-ধূমপায়ী পঁয়ত্রিশোর্ধ নারী-
যখন একজন নারী ধূমপায়ী হন বা মদে আসক্ত হন তখন তিনি অনেকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার শিকার থাকেন। শুধুমাত্র অভিজাত সমাজে নয়, অনেক দরিদ্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজেও নারীদের ধূমপান করতে দেখা যায়। এসব ধূমপায়ী নারীদের জন্মবিরতিকরণ পিল খেতে দেওয়ার আগে ডাক্তার ও রোগী উভয়কেই সচেতন হতে হবে।
স্তন্যদানকারী নারী-
যদিও ডাক্তাররা বলে থাকেন, বাচ্চাকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে বাচ্চা জন্ম হবার প্রথম ছয় মাসে নারীদের গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা কম থাকে। তবুও অনেকে ঝুঁকি এড়াতে এ সময় জন্মবিরতিকরণ পিল ব্যবহার করার পক্ষপাতি। তবে অনেকেই জানেন না যে পিলের উপাদান ইস্ট্রোজেন মায়ের দুধের পরিমান কমিয়ে দেয়, ফলে শিশু খেতে পায় না। তাই স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য রয়েছে শুধু প্রোজেস্টেরন সমৃদ্ধ বিশেষ পিল। এদেরকে মিনিপিল বা মাইক্রোপিলও বলা হয়ে থাকে। অনেকে না জেনেই বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় সমন্বিত পিল খেয়ে বাচ্চাকে যেমন বঞ্চিত করেন তেমনি নিজেরও স্বাস্থ্যহানি ঘটান।
তবে মিনিপিল বা মাইক্রোপিলের ক্ষেত্রে বুকের দুধ কমার আশংকা বা হৃদরোগের ঝুঁকি কমলেও এই পিলের কার্যক্ষমতা ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরনের সমন্বিত পিলের চেয়ে কম।
আরও কিছু সমস্যা-
আরও বেশ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যায় পিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন থাকা জরুরি। এর মাঝে রয়েছে কিডনীতে কোন সমস্যা থাকলে, পিত্তথলির পাথর অপারেশন হয়েছে এমন ক্ষেত্রে, মাইগ্রেইনের সমস্যা থাকলে, খিঁচুনী বা মৃগী রোগ হলে, ডায়াবেটিস হলে, অনিয়মিত মাসিক বা মাসিকের সময় প্রচন্ড পেট ব্যথা থাকলে জন্মবিরতিকরণ পিল ব্যবহারে ডাক্তারের বিশেষ পরামর্শ অনুযায়ী জীবন-যাপন করা জরুরি।
আর হ্যাঁ, এই সব অবস্থাই মেয়েদের জন্মবিরতিকরণ পিলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পুরুষের জন্মবিরতিকরণ পিলও রয়েছে তবে তার কার্যক্ষমতা আর জনপ্রিয়তা এখনও খুব বেশি নয় বলে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও খুব বেশি গবেষণা হয়নি।
সবশেষে এটুকুই বলার থাকে যে, অনেকেই অনেক সময় লজ্জাবোধ করে- ডাক্তারের কাছে না গিয়ে অন্য মানুষের কাছ থেকে জন্মবিরতির বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া কোন কাজের কথা হতে পারে না। তাই ডাক্তারের পরামর্শ নিন, সচেতন থাকুন, সুস্থ্ থাকুন!