আকাশ মোবাইলে ফেইসবুক ওপেন করে বসে ছিল ওর কক্ষে।দরজা খুলে ওর বোন আনিকা কখন ঘরে প্রবেশ করেছে সেদিকে ওর বিন্দুমাত্র খেয়াল ছিলনা বরং ওর মনোযোগ পূর্বের মতই ছিল মোবাইলের উপর।কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়েই আনিকা প্রশ্ন করে-“কিরে আজ তো তোর এক্সাম ছিল।তা কেমন দিলি?”
-“ভালো” আকাশের নির্লিপ্ত উত্তর।
-“গুড।তা সব কোশ্চেনের আনসার করেছিলি তো?”
-“হুম” আকাশ এবারও মোবাইল থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই উত্তর দেয় আনিকার প্রশ্নের যেন আনিকা থাকাতে ও বিরক্তই হচ্ছে কেবল কিন্তু এটাকেও পাত্তা দিল না আনিকা বরং কন্ঠটাকে পূর্বের মত স্বাভাবিক রেখেই বলে-“আমি সারাদিন অফিস শেষে বাসায় এলাম।কোথায় আমার সাথে একটু ঠিকভাবে কথা বলবি, সময় দিবি, তা না বরং মোবাইল নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে আছিস! খেয়াল করছি, আজকাল সারাদিন-রাত যখনি তোকে দেখি, মোবাইল হাতে নিয়ে পড়ে থাকিস।পড়ালেখা তো প্রায় ছেড়েই দিতে বসেছিল।বিগত সেমিস্টারগুলোতে রেজাল্ট এত খারাপ হচ্ছে তোর তারপরও নিজেকে সুধরে নেয়ার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা তোর মাঝে দেখতে পাচ্ছিনা।সারাটা সময় মোবাইল আর মোবাইল তা কি এমন করিস মোবাইলে শুনি?” আনিকার এত বড় লেকচারেও ঠিক হয়না আকাশ বরং প্রতিউত্তরে আনিকাকে কিছু না বলেই বরাবরের মত ফেইসবুক চালাতে থাকে।
-“আকাশ…?” এবার অনেকটা ক্ষেপে গিয়ে আকাশকে ডাকে আনিকা কিন্তু আকাশ প্রতিউত্তরে কেবল বলে-“হুম বল, শুনতে পাচ্ছি।” আনিকার এতগুলো কথাও আকাশের মস্তিষ্কে গেল না ভাবতেই ক্ষেপে যায় আনিকা।আর আকাশের এহেন ব্যাবহারে ক্ষিপ্ত হয়েই ওর হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বলে-“আমিও তো দেখি পরিবার থেকেও কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে তোর মোবাইলে।” মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে আনিকা পুনরায় বলে-“ওহ! ফেইসবুক! সারাদিন-রাত কি এমন করিস ফেইসবুকে? এই ফেইসবুক ফেইসবুক করেই নিজের ক্যারিয়ার/লাইফ সব নষ্ট করে ফেলছিল সেদিকে কি খেয়াল আছে তোর?!” আকাশ প্রতিউত্তরে আনিকার হাত থেকে ওর মোবাইলটা কেড়ে নিতে যায় আর মুখে কেবল বলে-“এটা কি হলো আপু? কথা বলছিস বল, আমি কি কিছু বলেছি? তুই আমার মোবাইল নিয়েছিল কেন? দিয়ে দে বলছি এখনি।”
-“তুই বললেই দিয়ে দিতে হবে? এমন কি মন্ত্রী সাহেব হয়ে গিয়েছিস? এই মোবাইল আর তুই তোর ফাইনাল শেষ হওয়ার আগে পাবিনা।এটা আমার কাছেই থাকবে।
-“এটা কিন্তু তোর বাড়াবাড়ি হচ্ছে আপু।বলছি আমার মোবাইল আমাকে এখনি দিয়ে দে নয়ত পরিণাম কিন্তু ভালো হবেনা।”
-“তুই যেটা মনে করিস সেটাই।এখন আমার মোবাইলটা আমাকে ফেরত দে বলছি।”
-“না দিব না।যা পারিস করেনে।” নাছোড়বান্দা আনিকার সাথে পেরে না উঠে আকাশ দৌড়ে গিয়ে ওর মাকে ডেকে নিয়ে আসে আর আনিকার বিরুদ্ধে বিচার দিয়ে বলে-“তোমার মেয়েকে কিছু বলো মা।”
-“কেনরে? কি হয়েছে আবার তোদের মাঝে?”
-“কি হয়েছে বুঝও না? সেটা তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেই পারো!”
-“আমার মেয়ে? তোর কিছু না?!” মায়ের প্রশ্নের উত্তরে অভিমানে আকাশ মুখ ফিরিয়ে নেয়।
-“অদ্ভুত! কিছু বলবি না যখন তো ডেকেছিস কেন? হ্যাঁরে আনিকা, মা আমার! তুই-ই বল কি হয়েছেরে?”
-“কি হয়েছে সেটা আমাকে কেন? যে তোমাকে ডেকে এনেছে তাকে জিজ্ঞেস করলেই পারো!”
-“উফ! তোদের নিয়ে আর পারিনা।ঠিক আছে কাউকেই কিছু বলতে হবেনা।আমারো অনেক কাজ পড়ে আছে তোদের অহেতুক নাটক দেখার সময় কোথায় আমার এত!” বেগম রোকেয়া হোসেন চলেই যাচ্ছিলেন কিন্তু তখনই পিছন থেকে ডাকল আকাশ-“কি ব্যাপার মা, তুমি বিবাদ মিমাংসা না করেই চলে যাচ্ছ যে?!”
-“তাহলে কি করব? তোরা তো কিছুই বলছিস না। কিহয়েছেতাতোআগেবলবি?!”
-“কি আর হবে বলো? তোমার এই গুণধারী মেয়ে, আমার মোবাইল নিয়ে গেছে।সেটা ফেরত দিতে বলো এখনি।” আকাশের কথায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে বেগম রোকেয়া হোসেন আনিকার দিকে তাকাতেই আনিকা বলে-“নিবই বা না কেন বলো মা? সারাটাদিন মোবাইল আর ফেইসবুক চ্যাটিং নিয়ে পড়ে থাকে।দিনে দিনে রেজাল্টের কি বাজে হাল হচ্ছে, ফ্যামিলিকে সময় দিচ্ছে না।এটা কি ঠিক তুমি বলো? এখন বলো মোবাইল নিয়েছি তো কি এমন ভুল করে ফেলেছি?! এটা আর ও ফাইনাল শেষ হওয়ার আগে পাচ্ছেনা।” আনিকার যুক্তিতে এবার সহমত প্রকাশ করেই মা বলেন-“হ্যাঁরে আকাশ, আমিও এটা বেশকিছু দিন যাবত খেয়াল করেছি তুই আজকাল মোবাইল নিয়েই পড়ে থাকিস।খাওয়া/পড়ালেখা/ঘুম কোনকিছুর প্রতি তোর কোন নিয়ম নেই।তোদের এই ইন্টারনেট জগত আমি বুঝিনা।আচ্ছা স্বীকার করছি এটা তোদের জন্য দরকার কিন্তু তাই বলে বাস্তব জগত থেকে দূরে সরে থাকবি এটা কেমন কথা বল?!”
-“আমি বাস্তবতায়ই আছি মা।তুমি অতকিছু বুঝবে না।তুমি বরং আমার মোবাইলটা আমাকে এখনি ফেরত দিতে বলো।” আকাশের চিৎকারে এবার পাশের রুম থেকে ওর বাবা ছুটে আসেন-“কি হচ্ছে এখানে?” ওদের বাবা খুবই গম্ভীর স্বভাবের তাই তাকে দেখে কিছুটা চুপসে যায় আকাশ কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঠিকই ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে।আকাশ/আনিকাকে নিশ্চুপ দেখে ওদের মা-ই সবকিছু খুলে বলেন।সবকিছু শুনে বাবা আনিকার পক্ষপাতিত্ব করেই বলেন-“আনিকা ঠিকটাই করেছে।আমি তো বলি তোর মোবাইল ব্যাবহার করাই বন্ধ করে দিতে হবে।এখন সময় হচ্ছে জীবনটা ঠিক করে নেয়ার সাজিয়ে নেয়ার, ফালতু কাজে সময় ব্যয় করার না।ঠিকমত পড়ালেখা না করলে জীবনে কি করবি? তোর বোনকে দেখেছিস? ওকে দেখেও তো কিছু শিখতে পারিস?!”
-“খুব সুন্দর! সবাই আপুর দিকটাই দেখ।আপুই তো তোমাদের সব, আমি তো তোমাদের কেউ না।আপু কিছু করলে সেটা ঠিক আর আমি কিছু করলেই দোষ! আপু নাচ-গান শিখুক এটা খুব ভালো আর আমি ক্রিকেটের প্রতি, গিটারের প্রতি আসক্ত হলেই দোষ! সময় নষ্ট?! আপুর ল্যাপটপ/ট্যাব/মোবাইল থাকুক, এটা ওর জন্য দরকার আর আমি শুধু মোবাইল চালালেও দোষ?! এটাও নিয়ে নিতে হবে! আমার জীবনে যেন দরকার বলে কোনকিছু থাকতে নেই তাই না?” আকাশ ক্ষোভের বশে বকে যায়।
-“আকাশ! এসব কি বলছিস তুই?” বিস্ময় ঝড়ে পড়ে আনিকার কন্ঠে।
-“যা বলছি ঠিকই বলছি।আর তুমি আপু, আমার ভালো চাওয়ার এত অভিনয় করতে হবেনা তোমাকে।তুমি এমনিতেও আম্মু-আব্বুর চোখের মণি হয়েই আছো!”
-“আকাশ! ছিঃ! তুই এভাবে বলতে পারলি? আমি তোর ভালো চাওয়ার অভিনয় করি? ভেবে অবাক হচ্ছি এমন ভাবনা তোর চিন্তায় আসতে পারল? এই মোবাইলের জন্য এত কথা বললি তো? বাহ! বেশ! এইনে তোর মোবাইল।আজ যথেষ্ট শুনিয়ে দিয়েছিস আমাকে।আমি আর কখনও তোর বিষয়ে কিছু বলতে আসব না।” আকাশের হাতে মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়েই আনিকা চলে যায় ওর রুমে।আর আকাশ বুঝতে পারে ওর কথাগুলো অনেক রুডলি হয়ে গেছে।আকাশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।ওর বাবা ওকে বলে-“আকাশ আমার সাথে একটু আয় তো বাবা।” আকাশ ওর বাবার পিছু পিছু তার রুমে যায়।রুমে পৌঁছে আকাশকে চেয়ারে বসতে বলে আলমারি থেকে কিছু ছবি বের করে সেগুলো নিয়ে আকাশের পাশের চেয়ারে বসে এবং ছবিগুলো ওর হাতে দিয়ে বলে-“তুই যখন ছোট ছিলি তখনকার ছবি এগুলো।তোর প্রথম হাসতে শেখা, প্রথম হাঁটতে শেখা, প্রথম জন্মদিন, তোর প্রথম স্কুলে যাওয়া, প্রথম কলেজে যাওয়া, তোর এই প্রতিটা স্মৃতি ক্যামেরাবন্দী কে করেছিল জানিস? তোর বোন, আনিকা।তোর প্রতিটা স্মৃতি, প্রতিটা মুহূর্ত তুলে রেখেছে ও কতটা যত্নে।সময়ের বহমান ধারায় কোনটাকেই মলিন হয়ে যেতে দেয়নি।জানিস, যখন প্রথম তুই পৃথিবীতে এলি, আর এই সংবাদ তোর বোনকে দেয়া হয়, তখন আনিকা ফাইভে পড়ে, সেই বাচ্চা মেয়ে সেইসময় খুশিতে পাগল ছিল প্রায়।তোকে মাথার উপরে তুলে রাখত যেন সবসময়।কত যত্নে তোকে খাইয়ে দিত, তোকে আদর করত।তোর দোষগুলো পর্যন্ত নিজের উপর তুলে নিয়ে নিজে বকা শুনত, কখনও তোর উপর সামান্য আঁচ পর্যন্ত আসতে দেয়নি।তুই যেন ওর কাছে কেবল একটা ভাই না এরচেয়ে বেশিকিছু।আর আজ তুই তোর বোনের মনে এভাবে আঘাত করলি আকাশ? কতটা কষ্ট পেয়েছে আনিকা বুঝতে পারছিস? তোকে নিয়ে ওর অনেক স্বপ্নরে, অনেক আশা-প্রত্যাশা আছে ওর তোকে নিয়ে। তোকে জীবনে অনেক সাকসেসফুল দেখতে চায় ও। শুধু এই জন্য তোর সব বিষয়ে খুব সেনসিটিভ হয়ে যায়। ও চায়না তুই তোর জীবনে কোন ভুল করিস। এটা কি ওর দোষের কিছু তুই বল?!” আকাশ ওর বাবার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা। মাথা নিচু করে বসে থাকে কেবল। নিজের প্রতি ক্ষোভে ওর চোখে জল আসে।
কোনকিছু না বলেই আকাশ উঠে দাঁড়ায় আর ধীর পায়ে আনিকার রুমের কাছে এগিয়ে যায়। দরজা খোলার আগে হাতে ধরে থাকা ছবিগুলোর দিকে একবার তাকায়।
এরপর আকাশ রুমে প্রবেশ করে দেখতে পায় আনিকা দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে খাটের উপরে। আকাশ নিঃশব্দে এগিয়ে যায়। কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে আনিকার সামনে, হাঁটু গেড়ে বসে আকাশ ডাকে আনিকাকে। প্রতিউত্তরে আনিকা কেবল মুখ থেকে হাত দু’টো সরিয়ে নিয়ে চোখ তুলে তাকায় আকাশের দিকে কিন্তু মুখে বলেনা কিছুই।
-“আপু...আমি তোকে কিছু কথা বলতে চাইরে......”-“আরো কিছু বলার বাকি রয়ে গেছে তোর!?” অভিমান ঝড়ে পড়ে আনিকার কন্ঠে আর ওর এই রুডলি কথার বিপরীতে মুখটা ভারী হয়ে আসে আকাশের। আকাশ একটু থেমে ছবিগুলো আনিকার হাতে তুলে দিয়ে বলে-“আমাকে মাফ করে দে আপু। আমি ক্ষোভের বশে তোকে কথাগুলো বলে ফেলেছিলাম। আমি জানি তুই আমার ভালো চাস বলেই আমার প্রতিটা বিষয়ে এতটা সেনসিটিভ, এতটা কেয়ারফুল। আমি তোকে ভুল বুঝে ফেলেছিলাম কিন্তু এখন আর এটা নেই আর কখনও থাকবেও না। আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে আপু। প্লিজ এবারের মত মাফ করে দে আমায়। আমি তোকে কথা দিচ্ছি আপু আমি আর কখনও তোর কথার অবাদ্ধ হবনা। তুই যা বলবি আমি তাই শুনব, যা করতে বলবি তাই করব, যেভাবে চলতে বলবি সেভাবেই চলব। এইনে আমার মোবাইল ফোনও লাগবে না। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করব তুই শুধু এবারের মত মাফ করে দে আমায় প্লিজ...” আকাশ বলতে থাকে। আনিকার কাছে খাটের সাথে মুখ নিচু করে ক্ষমা চাইতে থাকে। প্রতিউত্তরে আনিকা চোখের জল মুছে মিষ্টি হাসে আর মোবাইল ফোনটা আকাশের হাতে তুলে দিয়ে বলে-“বোকা ভাই আমার! আমি জানতাম তুই আমার বিশ্বাসটা রাখবি। আর আমি কি তোর উপরে কখনও রেগে থাকতে পারি! কত্ত আদুরে ভাই-টা আমার তুই!...”
Comments (5)
চমৎকার...!
ধন্যবাদ বাদল ভাই।