Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

সোহেলীর সংসার

রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। দুয়েকটি রিকশা, ভ্যান চলছে। মফিজ ও সেলিম দ্রুত সোহেলীর কাছে পৌঁছাল। সোহেলীর কাছে গিয়ে সেলিম বলল, তোমাকে নিয়ে যেতে হলে অনেক টাকা দিতে হবে। এখন আমার কাছে অতো টাকা নেই। আগামী কাল এসে টাকা দিয়ে তোমাকে নিয়ে যাব।

সোহেলী অবাক হয়ে শুধু সেলিমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাবতে লাগল এমন মানুষও পৃথিবীতে আছে ! কি বিচিত্র এই পৃথিবী। এই নীল আকাশের নিচে কখন কার ভাগ্যে কি ঘটে কে রাখে তার খোঁজ। গতকালও তার ভাগ্যের আকাশে ছিল ঘোর অন্ধকার। এখন তার ভাগ্যাকাশে সোনালী সূর্য উঠার অপেক্ষায়।
পরের দিন।

সূর্যটা কেবল তার তেজ হারিয়ে দিগন্তের কোলে ঢোলে পড়তে শুরু করেছে। রাস্তায় ব্যস্ত মানুষ যে যার মতো ছুটাছুটি করছে। এর মধ্যে সেলিম বাস থেকে নেমে ভিড়ের মধ্যে জনঅরণ্যে হারিয়ে গেল। সেলিম চলছে বিশাল এক চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে। যেন জীবনের মহাসমুদ্রে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে সে একা। ঝড়ের সাথে তাকে লড়াই করে জিততে হবে। সে রিক্সা নিয়ে থানার পথে চলছে। অমসৃণ রাস্তায় বারবার ঝাঁকি খাচ্ছে। তবুও সে জীবন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে জীবনের পাতা উল্টে যাচ্ছে। সব পরাজয় আর বেদনার ইতিহাস লেখা সেখানে। রিক্সা গড়িয়ে থানার সামনে এসে থামল। সেলিমের কোন খেয়াল নেই। সে অন্যমনষ্কভাবে বসে আছে।
রিক্সাওয়ালা সেলিমের দিকে তাকিয়ে বলল, থানায় এসে পড়েছি নামেন। ততক্ষণে সেলিম যেন পৃথিবীতে ফিরল। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ওসি সাহেবের খোঁজে থানায় ঢুকে পড়ল। থানায় ঢুকতেই এক কনস্টেবলের মুখোমুখি হতেই নানা অপ্রাসাঙ্গিক প্রশ্নের পর সে বলল স্যার আছে।

সেলিমকে দেখে ওসি রীতিমত অবাক। সে ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত সেলিম পিছু হটে যাবে। ওসি বলল, আমার জীবনে আনেক অবাক হওয়ার মতো ঘটনা দেখেছি কিন্তু আজকের মত নয়। আমার মনে হয় আপনি অনেক বড় মাপের মানুষ নয়তো আপনার মাথায় কোন সমস্যা আছে।
‘হতে পারে , মানুষকে দেখার সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়।’ সেলিম বলল।
-সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েকে বিয়ে করে অনেক মানুষের সংসার টেকে না। যাকে সমাজ ঘৃণা করে তাকে নিয়ে আপনি সংসার করতে পারবেন?
-এই পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মের বাইরেও অনেক কিছুই ঘটে থাকে। আর এটা ঘটে বলেই মানুষ আশা করে। স্বপ্ন দেখে, বেঁচে থাকে। কেউ আছে কোন একটি মঙ্গলের জন্য বুকে বোমা বেধে নিজেকে উড়িয়ে দেয়। এটাই তার সবচেয়ে আনন্দ আর না পারলে দুঃখের সীমা থাকে না। আমি যা করছি সেটাই আমার কাছে আনন্দের বিষয়।

-জীবন আপনার, সিধান্তও আপনার। যাই হোক আমি মফিজকে আসতে বলছি টাকার বিষয়টা ওর সাথে মিটিয়ে ফেলুন। সবেমাত্র সন্ধ্যা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি নিজে আপনার বিয়ের ব্যবস্থা করছি।
সেলিম এতদিন জানত পুলিশ মানুষ নয়, মানুষের মুখশে একটা আজব প্রাণী ওসি সাহেবের কথা শুনে আজ যেন তার ধারনা পাল্টে গেল। মনে হলো তারাও মানুষ। বিবেক, মানুষত্ববোধ কারো কারো আছে।
মফিজ আসার পর সেলিমের সাথে সব লেনদেন মিটে গেল। মফিজ একটা হাসি দিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিয়ে পকেটে পুরল। ওসি মফিজকে একটা ঠিকানা দিয়ে বলল ঐ মেয়েটা এবং ওনাকে এইখানে নিয়ে যাও। একটা বিয়ের আয়োজন কর একটু পরে আমি আসছি।

মফিজ সেলিমের দিকে তাকিয়ে বলল আসেন আমার সাথে।
সেলিম মফিজকে অনুসরণ করে ওসির রূম থেকে বেরিয়ে গেল। পথ আবছা অন্ধকার। তবুও সেলিমের হৃদয়ে জ্বলছে মানবতার আলো। সে আলো তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে একটা আনন্দের রেখা ফুটে উঠেছে। কিছু সময় পর দু’জনে সোহেলীর কাছে গিয়ে হাজির হলো। সোহেলীর মুখোমুখি হতেই সেলিম বলল তোমাকে নিতে আমি আবার আসলাম। আজ আমাদের বিয়ে।

সোহেলীর কাছে মনে হলো তার সামনে কোন এক দেবতা দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সে হারিয়ে ফেলেছে তার ভাষা। শুধু ঠোঁট দু’টো তার কাঁপছে। আর চোখ থেকে সমস্ত বেদনা গলে গলে আনন্দের অশ্রু হয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে। যেন সে স্বপ্ন দেখছে। সে স্বপ্নকে দুহাতে আঁকড়ে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চাইছে কিন্তু ঘটনার বিহ্বলতায় তার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। সে আর নড়তেও পারছে না। মফিজ তার স্বপ্ন ভঙ্গ করল।
মফিজ বলল, চল, তাড়াতাড়ি কর। আরও অনেক কাজ আছে।
সোহেলীর জামা কাপড় ছাড়া নেওয়ার মত তেমন জিনিসপত্র কিছুই ছিলনা। মাত্র কয়েক মিনিট সে সময় নিল। তারপর সেলিম ও সোহেলী মফিজের সাথে বেরিয়ে পড়ল। আধঘন্টার মধ্যে নিদৃষ্ট স্থানে তারা পেীঁছে গেল। সেখানে গিয়ে ফ্রেশ হতে না হতেই ওসি সাহেব কাজী ও একজন স্থানীয় মৌলানা নিয়ে হাজির হলো। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল।

অতি সাধারণ একটা বিয়ে। কোন অনুষ্ঠান নেই, লোকজনের বাহাল্য নেই। কোন আলোকসজ্জা নেই, নেই কোন উৎসব। এমনকি নব দম্পতির জন্য বাসর সজ্জা রচনা করা হয়নি। তবুও দু’জনের মনে সানাইয়ের সুর বেজে চলছে। সেলিম চিন্তা করছে একজন মানুষকে অন্ধকার জগৎ থেকে আলোতে আনতে পেরেছে এটাই সবচেয়ে আনন্দের কথা। সে সোহেলীর জীবনকে আলোতে আলোতে ভরিয়ে দেবে। মুছে দেবে অতীত দিনের বেদনার স্মৃতি। সোহেলীর মনে পড়ছে প্রথম বিয়ের কথা । কত স্বপ্নতে সাজানো ছিল সে ঘর। কিন্তু সে শুধুই স্বপ্ন| বাস্তবতায় তার ঠাঁয় মিলেছে চার দেওয়ালের অন্ধকার ঘরে। সে কখনও আর মুক্তির আশা করেনি। তবুও আজ সে মুক্ত।

মানুষ যখন হতাশ হয়ে আর কিছুই চায় না তখন কখনও কখনও বিনা চেষ্টায় অনেক বড় কিছু পেয়ে যায়। সোহেলীরও তাই। আজ তার আনন্দের দিন। তারপরও অতীত দিনের বেদনার একটা ছুরি তার হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। তার যন্ত্রণা অসীম। তা কেউ দেখতে পায় না। শুধু নিরবে সহ্য করতে হয়। নিজের যত যন্ত্রনাই থাকুক না কেন সেলিমকে সে কখনই কোন কষ্ট পেতে দেবে না। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও সে সেলিমকে খুশি করার চেষ্টা করবে। এইসব ভাবনার মধ্যে সেলিমের কথায় তার ভাবনায় ছেদ পড়ল।
সেলিম ওসি সাহেবকে বলল ‘আপনারা একটু বসেন। আমি দোকান থেকে কিছু মিষ্টি নিয়ে আসি। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

ওসি বলল আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি দোকানে বলে এসেছি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই একজন মিষ্টি নিয়ে হাজির হলো। সবার মিষ্টি খাওয়া শেষ হলে ওসি সাহেব বলল রাত বেড়ে যাচ্ছে সবাইকে উঠতে হবে। এখানে আর থাকা যাবে না। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আমি উঠলাম। সেলিমের দিকে তাকিয়ে বলল আপনারা সুখি হউন।

ওসি সাহেব বের হবার পরপর সেলিম ও সোহেলী বাইরে বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। মফিজের দিকে একসাথে দু’জনই চাইলো কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারল না। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে এলো। খানিকটা আসতেই মফিজের ডাকে সোহেলী পিছনে মুখ ফিরালো। দেখল মফিজ কিছু বলার জন্য দু্রত তাদের দিকে আসছে। কাছাকাছি হতেই মফিজ সোহেলীকে বলল, ‘জীবনে অনেক খারাপ কাজ করেছি। অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছি। সেসব করেছি শুধু বেঁচে থাকার জন্য। বেঁচে থাকার মত সামান্য একটা কাজের জন্য মানুষের দারে দারে ঘুরেছি। কোথাও আশ্রায় মেলেনি।

সেলিমের দেওয়া সব টাকা সোহেলীর দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘টাকাগুলো রাখ তোর সংসারে খরচ করিস। জীবনের পাতায় পাতায় শুধু পাপ লেখা। অন্ততঃ একটা পূণ্য লেখা থাক। তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমাকে মাফ করে দিস, দোয়া করি তোরা সুখি হ।’ কথাগুলো শেষ করে সে কারোর দিকে না তাকিয়ে উল্টো পথে সোজা চলে গেল।

যে মফিজ টাকার জন্য সোহেলীকে রেখেছিল অন্ধকার জগতে সে আজ সোহেলীর সুখের জন্য টাকা দিয়ে আর্শীবাদ করে গেল। হায়রে মানুষের মন ! কখন কিভাবে যে বদলে যায় তা কেউ জানে না।
পরের দিন। সেলিমের বাড়িতে।
সোহেলীকে এখানে কেউ চেনে না। এখনে সে নতুন পরিবেশে নতুন মানুষ। তার নতুন বাঁধন, নতুন হাসি। সেলিমের বাড়ি আজ মুখরিত। নতুন বউ দেখে সবাই খুশি। সবাই বলছে সেলিমের বউ খুব ভালো হয়েছে। তাই দেখে সেলিমের মায়ের যেন আর খুশি ধরে না। এই রকমই সে চেয়েছিল।

হাসি আর আনন্দের তলায় চাপা পড়ে গেল সোহেলীর জীবনের অন্ধকার অধ্যায়। শুরু হলো নতুন জীবন। এই জীবনকে সে এক সময় স্বপ্নে কামনা করতো। সেই জীবন আসলো। কিন্তু মাঝখানে চাঁদের কলঙ্কের মতো দাগ রেখে গেল। যখন সে আর কিছুই চায়নি। কোন কিছুর আশা করেনি। সেই সময় স্বপ্ন সত্য হলো। এরকমই হয়। যখন মানুষ কোনকিছু আপ্রাণ চেষ্টা করে পায়না হতাশ হয়ে আশা ছেড়ে দেয়। ভুলে যায় তার কথা। জীবনের কোন এক সময় তা এসে ধরা দেয় বিনা চেষ্টায়। কি বিচিত্র জগতের খেলা।

যার জন্য সোহেলী নতুন জীবন ফিরে পেল সে হলো তার স্বামী সেলিম। সোহেলী তাকে খুশি করার জন্য সারাক্ষণ ব্যাস্ত থাকে। তাকে খুশি দেখলে যেন জগতের সব সুখ সে খুঁজে পায়। সেলিম তার নিয়মিত দরকারি জিনিসগলো সব সময় না চাইতেই হাতের কাছে পায়। সেলিমের কাছে মনে হয় তার জন্য সোহেলী সব রেডি করে নিয়ে বসে থাকে। চাওয়ামাত্র সে হাজির করে। সেই সাথে সোহেলীর উচ্ছ্বাস। এসব দেখে দেখে ধীরে ধীরে ভালোবাসা আর প্রশান্তিতে কানায় কানায় পূর্ণ হলো তার শুণ্য হৃদয়। শেষ পযর্ন্ত সে তার ভালাবাসায় মুগ্ধ হয়ে গেল।

দিন পেরিয়ে মাস আসল। মাস পেরিয়ে বছর গেল। ক্রমে ক্রমে কালের চাকা ঘুরে ঘুরে দু’বছর পেরিয়ে গেল। দিন দিন যেন তাদের ভালোবাসা আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হলো। দেহের সৌন্দর্য নয়, ভালোবাসা নির্ভর করে পরস্পরকে বুঝার উপর। পরস্পরকে বুঝার গভীরতা যত ভালোবাসার গভীরতাও তত।
তারা একে অপরের মাঝে যেন হারিয়ে গিয়েছে। দুটি দেহে এক মন। এরই মধ্যে অতীতের হতাশার স্মৃতি তারা ভুলে গেছে। তাদের মন এখন ভাসছে সুখের সাগরের শীতল বাতাসে। ছোট্ট একটি সংসার যেন সবকিছুতেই কানায় কানায় পূর্ণ। তাদের চাহিদা তেমন বড় নয় তাই অভাবও নেই। সুখি পরিবার।

সুখ চিরকাল চঞ্চল। স্থির হয়ে বেশিদিন কোথাও থাকতে পারে না। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে শুধু ছুটে বেড়ায়। আর যাওয়ার সময় একটা ঝড় বয়ে চলে যায়। সেই ঝড়ে সব এলোমেলো হয়ে যায়। তখন দুঃখ আর হতাশা এসে বাসা বাঁধে।
সোহেলী বেশকিছুদিন যাবত শরীর ভালো যাচ্ছে না। কি যে হলো দিন দিন যেন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসায় কিছুই হচ্ছে না। শেষমেষ ডাক্তার বলল, একবার ঢাকায় গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখে সমস্ত বডি চেক আপ করাতে। সেলিম এখন সোহেলীর জন্য সব করতে পারে। সেলিমের ভুবন জুড়ে শুধুই সোহেলী। সে এখন প্রেমিক।

যে সোহেলী বিনোদনের পসরা খুলে সন্ধ্যায় বসে থাকত, টাকা দিলেই মিলত তাকে। তার জন্য এত টান ! তার জন্য এত ভালোবাসা ! সেই সোহেলী সেলিমের কাছে এখন সম্পত্তি নয় মূল্যবান সম্পদ। বিচিত্র মানুষের মন। মনের চোখ দিয়ে যখন কাউকে দেখে তার মত পৃথিবীতে আর কেউ হয় না।
সেলিম দু’একদিনের মধ্যে টাকার ব্যবস্থা করে সোহেলীকে নিয়ে ঢাকায় ডাক্তারের কাছে আসল। ডাক্তার রাজ্যের যত রকমের টেস্ট আছে প্রায় সবগুলো করতে লেখে দিল এবং বলল টেস্টগুলো করানোর পর টেস্টের রির্পোট জমা দেবেন।

ডাক্তারের রুমে ঢোকামাত্র কি কি টেস্ট করাতে হবে প্রায় সবগুলোই লোখা হয়ে যায়। যে দু’য়েকটা বাকি থাকে তা রোগীর সাথে অর্ধেক কথা বলে ডাক্তার লেখে। যেন তারা সব জানে এত কিছুর শোনার প্রয়োজন নেই।
এত টেস্ট দেখে সোহেলী ভড়কে গেল। সেলিমকে জিজ্ঞাসা করল তার কি কঠিন কিছু হয়েছে। সেলিম উত্তরে বলল, ঢাকার সব বড় বড় ডাক্তারতো তাই বেশি বেশি টেস্ট।
-কিজানি আমার কিরকম লাগছে। মনে হচ্ছে আমার বড় ধরনের কিছু হয়েছে।
-তোমার যতসব ফালতু ধারনা।

তখনও সেলিম জানে না তার জন্য ভয়ংকর দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। সব টেস্টের রির্পোট জমা দেওয়ার পর দেখে ডাক্তার বলল, আগামীকাল আসবেন। এবং রক্তের আরো কয়েকটি টেস্ট করাতে হবে। টেস্টের কথা শুনে সেলিমের ডাক্তারের উপর প্রচন্ড রাগ হলেও মুখে কিছুই বলল না। ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে সেলিম রাগের সাথে বলল, যতসব টাকা নেওয়ার ধান্দা।
বিপদের গন্ধ পেলে মেয়েদের সিক্স সেন্সথ প্রবলভাবে কাজ করে। ‘আমার কিন্তু কেমন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে বড় কিছু হয়েছে। সোহেলী আবারও বলল। সেলিমকে এবার কিছুটা চিন্তিত দেখা গেল।

পরের দিন রির্পোট জমা দিয়ে দুরু দুরু বুকে ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বেঞ্চে বসে ডাকের অপেক্ষা করছে। ডাক পড়ল। দুজন ভিতরে বসলে ডাক্তার তাদের সাথে গল্প জুড়ে দিল। যেন কত দিনের চেনা। ডাক্তার সম্পর্কে তাদের আর কোন ক্ষোভ রইল না। এক পর্যায়ে ডাক্তার সোহেলীকে বলল আপনি একটু বাইরে গিয়ে বসুন। আমি উনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। সোহেলীর বুকটা ধক্‌ করে উঠল। ডাক্তার কি তার অতীতের কথা জানতে চাইবে ? নাকি তার কঠিন কিছু হয়েছে তার সামনে ডাক্তার বলবে না। মনে একগুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে সোহেলী ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো।
ডাক্তার বলল কিছু কিছু কথা আছে সহ্য করা কঠিন। তবুও শুনতে হয় এবং আমাদের বলতে হয়। আপনার স্ত্রীর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। হয়তো আগামী ছয় মাসের মধ্যে তাকে হারাতে হতে পারে। এর কোন কার্যকর চিকিৎসা নেই। তবে বারবার ব্লাড চেইন্‌জ করে দেখতে পারেন।

ডাক্তারের মুখ থেকে ব্লাড ক্যান্সার শব্দটা শুনার সাথে সাথে সেলিমের কানের কাছে যেন একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটল। আর কিছুই সে শুনতে পেল না। চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখল। তারপর আস্তে আস্তে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসল। তখন বুঝল জলে চোখ ভর্তি হয়ে গেছে তাই সে কিছু দেখতে পারছে না। আর বারবার কানের কাছে একই কথার যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় নিল। কিছু পরামর্শ নিয়ে বেরিয়ে আসলো। নিজেকে সোহেলীর কাছে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো এবং সোহেলীর ব্লাড ক্যান্সারের কথা গোপন রাখল।
- তোমাকে কি বলল ডাক্তার ? সোহেলীর জিজ্ঞাসা।
-তেমন কিছু নয়। ডাক্তারের ভিজিটের ব্যাপারে কিছু কথা বললেন। জীবনের প্রয়োজনে সময় অসময়ে মিথ্যা কথা না বললেই নয়। সেলিম মিথ্যা বলল।

তিনমাস কেটে গেল। ডাক্তারের কাছ থেকে আসার পর সেলিম যখন একা থাকে তখন অন্যমনস্ক থাকে। সোহেলী সেটা লক্ষ্য করছে। তার সিক্সথ সেন্স বলছে তার বড় কিছু একটা হয়েছে। সেলিম সেটা এড়িয়ে যাচ্ছে। একদিন সে সেলিমের সাথে জোরাজুরি শুরু করল। শেষ পর্যন্ত সেলিম বলতে বাধ্য হলো। শুনামাত্র সোহেলীর মনে হলো পৃথিবী যেন কেঁপে উঠলো। চোখের তারায় যে রঙ ছিল একটিমাত্র সংবাদে সব মুছে গেল। সে আর কিছুই দেখল না। চোখে অস্পষ্টভাবে ভেসে উঠলো সেলিমের মলিন মুখের ছবি।

আর মাত্র কদিন পর এই মুখ আর সে দেখবে না। সকালে চোখ মেলে যখন এই মুখ দেখত তখন প্রাণে এক আবেশী শিহরণ জাগিয়ে দিত। সারাদিন হেসে খেলে কখন কিভাবে সময় চলে গিয়ে আবার সকাল আসত। ছোট্ট এই ঘরে ঠাসা ছিল মুঠো মুঠো স্বপ্ন।| সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল। নিজের চেয়ে সেলিমের ভাবনা তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিল। সেলিমের শুন্য বুক সে এক ফোঁটাও খালি থাকতে দেয়নি। সে যখন থাকবে না তখন সেই শুন্যতা নিয়ে কি করবে সেলিম ?
চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিল। বাম হাতে চোখ মুছতে মুছতে সেলিমকে বলল আমি মারা গেলে তুমি আবার বিয়ে করো। দেখো, হয়তো সেও তোমাকে আমার মত করে দেখবে। তার মধ্যে আমি তোমার কাছে বেঁচে থাকব।

সেলিমের কানের মধ্যে যেন কিছুই ঢুকছে না। সোহেলী থাকবে না একথা মনে হলেই সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কি যেন ভাবে। একেবারে ভাবনার তলদেশে হারিয়ে যায়। সোহেলী তা দেখে সমস্ত কষ্টকে চেপে রেখে বলল, ‘অনেক দিনতো কোথাও বেড়াতে যাইনি, চল আমরা সমুদ্রসৈকত দেখি আসি। কোনদিন দেখিনি। হয়তো আর তোমার সাথে বেড়ানোর সময় নাও পেতে পারি।
সেলিম সোহেলীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘খুব একটা ভালো কথা মনে করেছ। সমুদ্র দেখার আমারও সখ ছিল। কিন্তু দেখতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।’
দু’দিন পর।

নীল সমুদ্র কি বিশাল জলরাশি! দুজনে সমুদ্রের কিনার ধরে হাঁটছে। ছোট ছোট ঢেউ এসে তাদের পা ধুয়ে আবার চলে যাচ্ছে। সমুদ্রের ধারে এসে দুজনই যেন কিশোর কিশোরী হয়ে গেল। তাদের উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। সোহেলী আচমকা একগাদা পানি সেলিমের গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে সেলিমের মুখের দিকে চেয়ে রইল। সেলিম তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে সেলিমের নাগালের বাইরে আরো বিপরীত দিকে ছুটে গেল।
সেলিম সোহেলীকে ধরার জন্য তাড়া করল সেই সাথে একটা মিষ্টি হাসির কলরব তাকে মোহবিষ্ট করে দিল। একটু যেতেই সে সোহেলীকে ধরে ফেলার উপক্রম করতেই সোহেলী জলের মধ্যে নেমে গেল। সেলিমও নামতে কোন দ্বিধা করল না। কোমর পানি হতেই তাকে ধরে ফেলল। সোহেলী হাঁপাচ্ছে কিন্তু তার হাসি থামছে না। দুজন পানি নিয়ে খেলা শুরু করে দিল।

সমুদ্রের একটা নিজেস্ব ভাষা আছে। সে ভাষাতে মানুষকে কাছে ডাকে। সে ডাক কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। মনের অজান্তেই জলে নেমে পড়ে। যে একবার তার বুকে পা রাখে সে অনেক দুরে গেলেও সেই সমুদ্রের ডাক সে শুনতে পায়। আবার যেতে ইচ্ছা করে।
এক সময় দু’জনই থামল। সোহেলী দুর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন উদাস হয়ে গেল বলল, ‘দেখ কি সুন্দর পৃথিবীর রূপ ! অথচ কয়দিন পরে আমি আর থাকব না। চিরদিনের মত তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে।
কথা শুনে সেলিমের বুক হু হু করে উঠল। মনটা ভারী হয়ে গেল। সেলিম বলল’ চলো উঠি। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল।
সোহেলী বলল আর একটু থাকি না। এখানে বেশ ভালই লাগছে।
সেলিম আর বাধা দিল না। নিরবে সোহেলীর উচ্ছ্বাসে ভরা ছেলেমানুষি দেখতে লাগল। যেন তার চোখের ক্যামেরা দিয়ে সব দৃশ্য একে একে ধারণ করে হৃদয়ে গেঁথে নিচ্ছে একটা একটা করে। আর কোনদিন হারাতে দেবে না।

সমুদ্র দেখে ফিরে আসার কয়েক দিন পর সোহেলী অসুস্থ হয়ে পড়ল। সোহেলীর উচ্ছল সমুদ্র ভ্রমনটা ছিল প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠার মতো। সেলিম জানে তার চেষ্টায় আর কোন লাভ হবে না। তবুও ডাক্তারের কাছে নিয়ে প্রাণপনে চেষ্টা করল কিন্তু সোহেলী সেলিমের বুক খালি করে দিয়ে তাকে রেখে চিরদিনের মতো চলে গেল চির অচেনার দেশে।
সেলিমের জীবন সোহেলী কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছিল। সে যাবার সময় সব নিয়ে গেল। খালি করে দিয়ে গেছে সব। অসীম শুন্যতা সেলিমের বুকে। সোহেলী ছাড়া শুন্য এ ঘরে সে একা। ঘরের প্রতিটি জিনিসে ছিল সোহেলীর স্পর্শ। যেদিকে তাকায় সেদিকেই সে দেখে সোহেলীর ছবি। আনমনা হয়ে বসে থাকে। ভুলে নাম ধরে ডেকে ওঠে। আবার বাস্তবে ফিরে দেখে কিছু নাই। না পাওয়ার তীক্ষ্ণ বেদনার একটা ছুরি এসে তার বুকে বিঁধে। ছটফট করে অসহ্য যন্ত্রণায়।

রাতের আঁধার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে সে ব্যথা। কাটতে চায় না রাত। হায়রে মানুষের মন ! এক সময়ের অন্ধকার জগতের এক মেয়ের জন্য তার এই ব্যথা, এতো ভালোবাসা ! সে নেই তাই সেলিমের পৃথিবীতে কিছু নেই ! সব ফাঁকা ! গভীর রাত। যতই সোহেলীকে মনে পড়ছে ততই তার কাছে অসহ্য লাগছে এই পৃথিবী। একটার পর একটা স্লিপিং পিল খেয়ে তার ঘুম আসছে না। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। একটার পর একটা জীবনের ব্যর্থতার পাতা তার সামনে খুলে যাচ্ছে। আনন্দ দিয়ে ভরিয়েছিল সোহেলী তার জীবন। এখন সে নাই। আবার বুকে বেজে উঠল হাহাকার। ঘুমাতে চেষ্টা করল। সে আর পারছে না। শেষে তিরিশ-চলিশটা স্লিপিং পিল একটা গ্লাসের মধ্যে গুলে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল।

পরের দিন দুপর হয়ে গেলে এক প্রতিবেশী সেলিমের সাড়াশব্দ না পেয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখে দরজা খোলা। ভিতরে ফ্যান চলছে। সেলিম চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেল না তখন চাদর সরিয়ে গায়ে ধাক্কা দিতেই চমকে উঠল। কোন চেতনা নেই। মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আতঙ্কে ছুটে গিয়ে লোক ডাকাডাকি করে সবাই মিলে অতি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল। সবাইকে নিরাশ করল ডাক্তার। বলল আমাদের কিছু করার সুযোগ সে দিল না। আমরা দুঃখিত। আপনারা লাশটা নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করুন।

০ Likes ০ Comments ০ Share ৬০৭ Views