Site maintenance is running; thus you cannot login or sign up! We'll be back soon.

আহসান কবির

৭ বছর আগে

সেতারের নিরাপদ ধুন!

২৩ এপ্রিল ২০১৬। সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের কিছু বেশি। শালবাগান বাজারের মোড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরতে হাঁটছিলেন তিনি। হঠাৎ কি তার মনে হয়েছিল সেতারটাকে পরম যত্নে রেখে আসা হয়নি? তার কি মনে হয়েছিল যে একাকী নদীর মতো বিছানায় পড়ে আছে তার প্রিয় সেতার? আমরা কেউ এখনও জানি না হাঁটার সময়ে কেউ তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল কিনা! কেউ তাকে স্যার বলে সম্বোধন করেছিল কিনা! নাকি পেছন থেকে ঘাতকের চাপাতি তাকে আঘাত করেছিল? তখন কি প্রিয় স্বদেশের মুখটা তার মনে হয়েছিল? মনে হয়েছিল প্রিয়তম স্ত্রী আর ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভের মুখ? আমরা এসবের কিছুই জানি না। শুধু জানি প্রিয় সেতারের একা পড়ে থাকার মতো তাকেও মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে হয়েছিল রাস্তায়। কবরের অন্ধকার কিংবা নিঃসঙ্গ সেতারের মতো একা! নাকি বাংলাদেশটা মুখ থুবড়ে পড়েছিল লজ্জায়?
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত একযুগে চারজন শিক্ষককে এভাবেই খুন করা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে রাজশাহীর বিনোদপুরের নিজ বাসার সামনে খুন হন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. ইউনুস। ভোরের শিশির আর শান্ত প্রকৃতিকে স্বাক্ষী রেখে মুক্ত পাখির গান শুনে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে ঘাতকেরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। মুক্তবুদ্ধির মানুষদের ওপর এমন আঘাত স্বাধীনতার আগে থেকেই অব্যাহত ছিল। একারণে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ পরিকল্পনা করে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের খুন করা হয়েছিল।
২০০৬ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন ভূ-তত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড.এস তাহের। দুইদিন পর তার বাসার পেছনের সেফটিক ট্যাংক থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ড. তাহেরের হত্যাকাণ্ডে একই বিভাগের শিক্ষক মিঞা. মো. মহিউদ্দীনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছিল।

২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় একই কায়দায় খুন হয়েছিলেন লালনভক্ত অধ্যাপক খ্যাত শিক্ষক শফিউল ইসলাম। শিক্ষক রাজনীতির আওয়ামী ধারার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। লোক সংগীতের প্রতি দারুন আগ্রহ ছিল মানুষটার। গান শুনতে এবং শোনাতে পছন্দ করতেন। মুক্তবুদ্ধির মানুষের যে জীবনযাপন সম্ভবত এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র তাকে বাড়াবাড়িই মনে করে। আর তাই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটা অকপটে বলতে পারেন কোনও কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়!!
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় এবং সমপ্রেমীদের মুখপাত্র কথিত রূপবান পত্রিকার সঙ্গে জড়িত জুলহাজ মান্নান ( সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনির খালাতো ভাই) নিজ বাসায় খুন হয়েছেন। এই ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন- এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দেশ নিরাপদে আছে!
আসলে কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ? রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্যারকে যারা কুপিয়ে হত্যা করেছে তারা হয়তো জানতো না যে এই মানুষটা ব্লগার কিংবা সমপ্রেমী ছিলেন না। কখনও ধর্মবিরোধী কোনও লেখা তিনি লেখেননি। লিখতেন পথের পাঁচালি, বাইসাইকেল থিফ, সিলডার লিস্ট কিংবা মেঘে ঢাকা তারার মতো ক্লাসিক ছবি নিয়ে। মানুষটার মাথায় ঝোক চেপেছিল সিনেমার। তার মনে হয়েছিল ক্লাসিক ছবিগুলো তিনি তার প্রিয় শিক্ষার্থীদের দেখাবেন। একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ছবি দেখার আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। ডিপার্টমেন্ট একটা প্রজেক্টর কেনার টাকা দিতে চায়নি কিংবা তিনি চেয়েছিলেন কিনা আমরা জানতে পারিনি। রেজাউল করিম স্যার প্রজেক্টর নিজেই কিনেছিলেন। শিক্ষার্থীদের ছবি দেখাতেন পরম তৃপ্তি নিয়ে।

জানি না কতোটা বেদনা ছিল স্যারের। নিজের বেদনাগুলো বাজাতেন, করুন সুর হয়ে বের হতো সেটা সেতার থেকে। অনেকেই যখন হাঁটতেন বিরুদ্ধ পথে, টাকা পয়সার জন্য খুব সহজেই নত হয়ে যেতেন কোনও না কোনও প্রলোভনের কাছে, তখন তিনি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিকে না বলে দিয়েছিলেন। নিজ গ্রাম রাজশাহীর বাগমারাতে শিশুদের জন্য একটা গানের স্কুল খুলেছিলেন। সেখানে নাকি ঘুড়ি উৎসব আর ঘৌড়দৌড়ের আয়োজন করতেন। যে মানুষটা অর্থনৈতিকভাবে দারুন সৎ ছিলেন সেই তিনি নিজ গাটের পয়সা খরচ করে এদের পুরষ্কার দিতেন। সংসারে এ কারণে কতোটা কষ্ট নেমে আসতো সেটা হয়তো স্যারের স্ত্রী হোসনে আরা আর ছেলে সৌরভ বলতে পারবেন। স্যারের স্মরণ সভার প্রতিটা মুহূর্ত এই দুইজন মানুষ শুধুই কেঁদেছেন। সম্ভবত কারও-কারও জন্ম হয় শুধু কাঁদার জন্য। রেজাউল করিম স্যারের স্ত্রী আর ছেলে সেই বিরল সৌভাগ্যবানদের(!) দুইজন!
জঙ্গি ভরণ-পোষণের সব ধরনের সহযোগিতা করে বদনাম কামানোর পরেও ইসলামী ব্যাংক রাষ্ট্রীয় বহু অনুষ্ঠানের স্পনসর হতে পারে! উল্টোদিকে শুধুমাত্র মুক্তবুদ্ধির চর্চা (ব্লগে লেখালেখির নামে যারা ধর্মকে ব্যঙ্গ করে, যুক্তিহীন গালাগালি করে তারা ব্লগার কিনা সন্দেহ আছে) করার কারণে সুব্রত শুভ, রাসেল পারভেজ কিংবা মশিউর রহমানকে গ্রেফতার হতে হয়। অভিজিৎ, দীপন, নাজিমুদ্দিন সহ আরও অনেককে খুন হয়ে যেতে হয়!
কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্ণধার যারা তাদের লজ্জা নামের অনুভূতি আছে বলে মনে হয় না। আগেও একাধিক লেখায় লিখেছি, আবারও লিখতে বাধ্য হচ্ছি কিন্তু রাষ্ট্র যেমন ছিল তেমনও থাকছে না। মনে হচ্ছে আরও বেশি পেছনের দিকে যাত্রা শুরু করেছে! এদেশে যারা হিন্দু কিংবা মুসলিম, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান, সেও রীতিমত অসহায়। রাষ্ট্রের কাছে সে অনাকাঙ্ক্ষিত। রাষ্ট্রের এই বিশ্বাসের অন্ধত্ব (বিশ্বাসের ভাইরাস শুধু মানুষকেই রোগী বানায় না, রাষ্ট্রকেও অসুস্থ করে তোলে) ভিন্নমত বা ধর্মাবলম্বী, সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসীদের দারুণভাবে নিরাপত্তাহীন করে তোলে। আর তাই ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার বলা হলেও রাষ্ট্র সবার হয়ে ওঠে না!

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ শ্রদ্ধেয় রেজাউল করিম স্যার আপনার পরে চাপাতির নিচে আবার কার জীবন যাবে আমরা তা এখনও জানি না। আমাদের বর্তমান সময়ে আপনি হয়তো খানিকটা বেমানানই ছিলেন। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে যাননি, কোনওরকম করপোরেট দালালি করেননি, নতুনদের আধুনিক করে গড়ে তোলার জন্য লিটলম্যাগ বের করতেন। ঋত্বিক ঘটকের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা থেকে লিটলম্যাগের নাম দিয়েছিলেন কোমলগান্ধার! আপনার রেখে যাওয়া সেতারটা এখন কে বাজাবে আমরা জানি না। খুব ভালো হতো কান্নারত সেতারটা যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পাঠানো যেত! তিনি নিশ্চয়ই সেতার বাজাতে বাজাতে বলতেন- সেতারে এখন যে ধুনটা তুলবো সেটার নাম নিরাপদ ধুন! এদেশে তনুরা ধর্ষিতা বা খুন হয় না! এদেশে আইএস বলে কোনও কিছু নেই! এদেশে রেজাউল করিম স্যাররা খুন হয়ে গেলেও রাষ্ট্র সীমাহীন নিরাপদে থাকে! নিরাপদ শব্দটা যে আবিষ্কার করেছিল তারে যদি একবার হাতের কাছে পেতাম!

০ Likes ০ Comments ০ Share ৩৯৫ Views