সেদিন পৃথিবীতে আগমনের পর শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে চিৎকার করে জানিয়েছিলে, তোমার আগমন। তুমি এসেছ...
মানুষ বলেছিল, আহারে এটা তো মেয়ে, ছেলে হলে ভালো হত, বংশ বাঁচত। বংশ বাঁচানোর চক্রে তোমার পরে আরো দুটি মেয়ের আগমন হল।
তুমি মায়ের বুকের দুধ পাচ্ছিলেনা তিন/সাড়ে তিনমাস পরই, ব্যাকুল হয়ে মা বাবাকে বলেছিল, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় একটা দুধের টিন নিয়ে আসবার জন্য।
মানুষ বলেছিল, ও তো মেয়ে, দুধের কি দরকার? সুজি রেঁধে খাইয়ে দাও। যা কিনা ৬ মাস পর্যন্ত কোন সন্তানকেই দেয়া উচিৎ না, কিন্তু কে শোনে কার কথা? তুমি তো আর ছেলে নও? তুমি তো আর ভবিষ্যতে সংসার দেখবেনা, তুমি শুধুই পরের সম্পত্তি। তোমার পিছনে এতো টাকা কেন নষ্ট করবে?
তুমি বড় হলে, এক সময় নিজ ইচ্ছার কথা জানালে, কি বিষয়ে পড়াশুনা করে জীবন গড়তে চাও তা জানালে, মায়ের কাছে সেটা খুবই ভালো লাগল, কিন্তু মানুষ বলল, পড়াশুনা করে বড় হয়ে কি লাভ? তুমি তো আর চাকরি করে মা বাবার দেখাশুনা করবে না। ছেলে হলে সেটা করা যেত। অযথা তোমার পিছনে টাকা নষ্ট কেন করবে?
তুমি মানুষের মত মানুষ হবে, পড়াশুনা করে অনেক বড় হতে চাও, তাই উচ্চ ডিগ্রির জন্য দেশের বাইরে যেতে চাইলে...
মানুষ বলেছিল, মেয়ে তো, বাইরে যাবার কি দরকার? বিয়ে করে পরের বাড়ি যাবে...
তুমি আর সামনে এগিয়ে যেতে পারনি, তোমার স্বপ্নের উপর অনেক ভারি একটি পর্দা দিয়ে অন্ধকার করতে সাহায্য করেছিল সেই মানুষগুলো। যারা একটি ছেলে দিয়ে বংশ বাঁচাতে ব্যাকুল ছিল।
তুমি পরের বাড়ি গেলে, সেখানেও একই ব্যাপার। শুধুমাত্র জায়গার বিভেদ। ভালো কিছু রান্না করা হলে, তুমি কখনই আগে খাবেনা, বাড়ির ছেলেরা খাবে।
সংসারের কোন আলাপে তুমি অংশীদার হবেনা, বাড়ির ছেলেরা তো আছেই।
তুমি মা হলে, মানুষ বলল, আহহা, বউটার তো দেখি মেয়ে হল... ছেলে হলে ভালো হত, বংশ বাঁচত !!!
বংশ বাঁচাতে ব্যাকুল সেই মানুষেরা সবাই কিন্তু মেয়ে মানুষ ছিল। আশ্চর্য এক ব্যাপার, মেয়েদের সামনে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে কোন দেয়াল বাঁধা দেয় না। কোন গাছের কাঁটা রাস্তায় থাকেনা। কোন রাস্তা ভাঙ্গা থাকেনা। সামনে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে একমাত্র বাঁধা শুধুমাত্র মেয়ে মানুষ।
আর একটি গল্প বলি, বাড়ির প্রথম ছেলের বউ গর্ভবতী, আল্ট্রাসোনোগ্রাম করে জানা গেলো গর্ভের শিশুটি মেয়ে। বাড়ির সবার মুখ অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। একে একে বউটিকে তিন বার এবরশান করাতে বাধ্য করা হল। ফলাফল, আজীবন বন্ধ্যা। বংশ বাঁচাতে তো হবে, বউটির জায়গায় আরেকটি মেয়ের জায়গা হল। এখানে বউটির কি দোষ ছিল? সমাজ কি তা ভেবেছে কখনো? মেয়ে হবার শাস্তি এর চেয়ে বড় হয়ত আর কিছুই হতে পারেনা।
আমাদের সমাজ আধুনিক হচ্ছে। আমাদের চিন্তাভাবনা আধুনিক হচ্ছে। কিন্তু একটি জায়গায় গিয়ে আমরা সবাই সেই আগের দিনের দাদি নানীর চিন্তাভাবনা থেকে বের হতে পারিনি এখনো। এখনো আমাদের মনে একটাই আশা, সন্তান মানেই ছেলে...
মেয়ে মানেই অসহায়। মেয়ে মানেই অবলা। মেয়েরা সংসারের কোন কাজে আসেনা। সন্তান জন্মদান করাই হচ্ছে তাঁদের একমাত্র কাজ। আপাত চোখের দৃষ্টিতে এটাই প্রধান ও একমাত্র কাজ।
আমাদের সমাজে একেকটি মেয়ের জীবনে এমন হাজারো গল্প রয়েছে। যে মেয়েটি সব চড়াই উৎরাই পেরিয়ে জয়ী হয়েছে, সেই মেয়েটি জানে, এই হাজারো গল্প পাড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার পথটা কত ভঙ্গুর ছিল।
উপরে যে গল্পদু’টি লেখা হল, সে গল্পদু’টি হয়ত আমাদের সমাজেরই এক একটি মেয়ের গল্প। আমরা ভেবে নেই মেয়েটি আর সামনে এগিয়ে যেতে পারেনি। জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। কিন্তু তার মেয়েটিকে ঠিকই দেখিয়েছিল সেই আলোর মুখ।
ভেবে নেই সেই দ্বিতীয় বউটিরও মেয়ে হয়েছে, দুই মা মিলে মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলেছে।
ভেবে নেই, একদিন আমাদের সমাজ, দেশ অনেক উন্নত হবে। সেখানে মেয়েদের কেউ নারী বলে পিছিয়ে রাখবেনা। একদলা মাংসপিন্ড মনে করবেনা। শুধুমাত্র সন্তান জন্মদান করাকেই একমাত্র কাজ বলে ভাববে না। ছেলেদের সাথে সমানে সমানে কাজ করে দেশকে এগিয়ে রাখার ব্যাপারে সমান সহায়তা করবে।
৮ মার্চ নারী দিবস বলে কোন পুরুষের কাছ থেকে উপেক্ষা জাতীয় কটূক্তি শুনতে হবেনা। এমন একটি সমাজে বাস করতে চাই, যেখানে সন্ধ্যা নামলেই মেয়েদের ঘরে ফেরার তাড়া থাকবেনা বিপদের ভয়ে।
নারীদের জয়ী হওয়ার পিছনের গল্পগুলো রূপকথার মত মনে হবেনা। জীবনের একটা অংশ কেটে যাবেনা, “কি?” “কেন?” “কি জন্য?” “কোথায়?” “কি কারন?” এর উত্তর দিতে দিতে...
নারী তুমি স্বপ্ন দেখো প্রান ভরে...
নারী তুমি এগিয়ে চল সামনের দিকে...
নারী তুমি না শুনোনা...
নারী তুমি একলা চলতে ভয় পেয়োনা...
বিঃদ্রঃ কিছুদিন আগে লিখেছিলাম। পোস্ট দেরিতে করা হল। লেট লতিফ বলে কথা।
Comments (3)
আমি খুব একটা ভালো নয়
এইতো সেদিন হলো পরিচয়,
যতটুকু চিনেছো সবটুকু নয়
পরতে পরতে রয়েছে ভীষণ ভয়।
ভালো লাগলো ভাই ।
খুব সুন্দর । ভালো লাগলো